দেশি মুরগি পালন পদ্ধতি, Desi Murgi (Chicken) farming Methods in Bengali

দেশি মুরগি পালন পদ্ধতি

দেশি মুরগির চাহিদা বাজারে কতটা রয়েছে, তা হয়তো আলাদা করে বলে দেওয়ার কিছু নয়। তাই বহু মানুষ মুরগি পালনের প্রতি উদ্যোগী হয়েছেন। এর নেপথ্যে মূল কারণ হল আর্থিক স্বচ্ছলতা। জেনে রাখা ভালো যে, দেশি মুরগি পালন এতটা কঠিন কাজ নয়। তবে সঠিক পদ্ধতি জানা জরুরী। বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার, পোকামাকড়, কেঁচো, কচি ঘাসপাতা ইত্যাদি খাওয়ানোর মাধ্যমেই পালন করা যায় ১০-১৫টি মুরগি।

বলাই বাহুল্য যে, এসব দেশি মুরগি পালন বেশ লাভজনক। শুধু কিছু রোগের উপস্বর্গ দেখে সঠিকভাবে ও উপযুক্ত সময় চিকিৎসা করলে একটি মুরগিও মরবেনা। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা দেশি মুরগি পালন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো।

বাড়িতে মুরগি পালন, Chicken Farming at home :

বাড়িতে মুরগি পালন অনেকের কাছেই ঝামেলা বলে মনে হয়। কখনও মুরগি অজানা রোগে মারা যায়, আবার কখনো এগুলোকে শেয়াল, কুকুরে খেয়ে ফেলে। সেক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ব্যাপারে নজর দিয়ে হবে, তবেই মুরগি পালন সহজ হয়ে উঠবে। সেই বিষয়গুলো হল ;

বাড়িতে মুরগি পালন
  • শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মুরগিকে প্রতিদিন সকালে খাঁচা থেকে বের করে দিতে হবে এবং প্রতি রাতে সন্ধ্যার সময় খাঁচায় রাখতে হবে।
  • দিনে দুবার খাঁচা থেকে ডিম তুলতে হবে।
  • স্যানিটেশন এবং গন্ধ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য খাঁচা সাপ্তাহিক পরিষ্কার করা উচিত।
  • মুরগির খাবার সবসময় শুকনো ও পরিষ্কার রাখতে হবে। বেশি দিন জমা রাখলে ছত্রাক সংক্রমণ ঘটে।

সবমিলিয়ে দেখা গেছে যে, দেশি মুরগি পালন লাভজনক। তাছাড়া সংকরায়ণ পদ্ধতিতে দেশি মুরগির সঙ্গে উন্নত মোরগ রেখে প্রাকৃতিক প্রজনন ঘটিয়ে দেশি মুরগির জিনগত উৎকর্ষতা বাড়ানো যায়।

দেশি মুরগির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে নিন, Know about the features of Desi chicken :

দেশি মুরগি মাংস এবং ডিমগুলো অন্য জাতের তুলনায় বেশি স্বাদযুক্ত হয়। তাই, তাদের কম বৃদ্ধি এবং ছোট আকার হওয়া সত্ত্বেও, দেশি মুরগী পালন করা কিছুটা ব্যয়বহুল হয়।

তবে দেশি মুরগি সাধারণত ১ বছরে ৩০-৪০ টি ডিম দিয়ে থাকে। কিন্তু তাদের ডিমগুলো অন্য মুরগির ডিম থেকে আকারে ছোট হয়। তবুও তাদের ডিম ও মাংশের দাম বাজারে বেশি থাকে।

দেশি মুরগি পালনের আয়, Income through Desi Murgi Farming :

দেশি মুরগি পালনের মধ্য দিয়ে যেকোনো ব্যক্তি কম টাকা ব্যয়ে করে বেশি আয় করতে পারবেন। অন্যদিকে কেউ যদি চায় তবে লেখাপড়া বা কোন চাকরি করার পাশাপাশি নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলতে পারবে দেশি মুরগির খামার।

দেশি মুরগির রোগ বালাইও কম থাকে, তাই এটি পালন পদ্ধতিতে তেমন কোন ঝুঁকি থাকে না। তাছাড়া কিছু বিষয়ে পালনকারীর সঠিক ধারণা থাকলে সমস্যা বা রোগ বালাই দমন করা যায়।

দেশি মুরগির জন্য খাবার, Feed for Desi Murgi :

মুরগি চরানোর সময়, মুরগি পোকা মাকড়কে খেয়ে থাকে তাই তাদের বেশি বাড়তি খাদ্য দিতে হয় না। এতে মুরগি মালিকের খরচ ও কম হয়, তাদের বাড়তি খাবার এত বেশি দিতে হয় না।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাড়ির প্রতিদিনের বাড়তি বা বাসী খাদ্য যেমন ফেলে দেওয়া ভাত, তরকারি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গম, ধান, পোকামাকড়, শাক সবজির ফেলে দেওয়া অংশ, ঘাস, লাতা পাতা, কাঁকর, পাথর কুচি ইত্যাদি মুরগি কুড়িয়ে খায় এবং এই সবের মাধ্যমেই তারা যথেষ্ট পুষ্টি পায়।

তবে তাদের সুস্বাস্থ্য ও সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে কিছু কেনা খাবারও দিতে হয়। এতে মুরগির বিভিন্ন পুষ্টি পূরণ হয় এবং তারা সুস্থ থাকে।

দেশি মুরগির পালনের জন্য ঘর তৈরি, Building house for chickens :

দেশি মুরগির পালনের জন্য ঘর তৈরি

দেশি মুরগির চাষ বা পালন করার জন্য খোলামেলা ঘর তৈরি করতে হবে।

  • ১.৫ মিটার (৫ ফুট) লম্বা X১.২ মিটার (৪ ফুট) চওড়া এবং ১ মিটার (৩.৫ ফুট) উঁচু ঘর তৈরি করতে হবে।
  • ঘরের বেড়া বাঁশের তরজা বা কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি করতে হবে। তবে কেউ চাইলে মাটির দেয়ালও তৈরি করতে পারবে। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যে বেড়া বা দেওয়ালের মধ্য দিয়ে যেন আলো বাতাস চলাচল করার জন্য ছিদ্র থাকে।
  •  ঘরের চাল খড়, টিন বা বাঁশের দরজার সাথে পলিথিন ব্যবহার করে তৈরি করা যাবে।

 এরকম ঘরে ১০-১৫টি মোরগ মুরগি পালন করা যাবে।

স্বল্প পুঁজি এবং স্বল্প আয় পদ্ধতি, Low capital and low income method :

ভারত – বাংলাদেশে সাধারণত বেশির ভাগ দেশি মুরগিগুলো সনাতন পদ্ধতিতে পালন করা হয়। উক্ত সনাতন পদ্ধতি হল ছেড়ে দিয়ে মুরগি পালন করার পদ্ধতির অন্য নাম। এক্ষেত্রে রয়েছে স্বল্প পুঁজি এবং স্বল্প আয়।

দেশের মানুষেরা ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করে থাকেন। তবে এই চাষের প্রচলন থাকলেও রয়েছে নানা অসুবিধা।

তাছাড়া এই পদ্ধতি অবলম্বন করে মুরগি পালন করে লাভ কম। এই পদ্ধতিতে মুরগির উৎপাদন চক্রে বেশি সময় লাগে, তারা কম ডিম পাড়ে, পাশাপাশি তাদের কম বাচ্চা হয়; অন্যদিকে এই পদ্ধতিতে মুরগির বেশি রোগ দেখা দেয় এবং প্রায়ই দেখা যায় যে মুরগি ও বাচ্চা মারা যায়।

দেশি মুরগির উৎপাদন চক্র সনাতন পদ্ধতিতে শেষ হতে প্রায় ১৪০-১৭০ দিন লেগে যায়।

দেশি মুরগির উৎপাদন চক্র, Production cycle of Desi Murgi :

 উৎপাদন চক্রকে সাধারণত ৪ ভাগে ভাগ করা হয়- যথা ,

  • ডিম পাড়া –১৮থেকে ২৪ দিন
  • ডিম কুচি বা তা –২১ দিন
  • বাচ্চা পালন –৯০-১০০ দিন
  • বিশ্রাম -১০-১৫ দিন

দেশি মুরগির পালনের আধুনিক পদ্ধতি, Modern methods of Farming Desi Murgi :

 খুব কমই এমন দেখা যায় যে, আধুনিক পদ্ধতি বা আবদ্ধ অবস্থায় দেশি মুরগি পালন করা হচ্ছে। আধুনিক পদ্ধতিতে মুরগি পালন করা হয় আবদ্ধ অবস্থায়।

এই পদ্ধতির যদিও একটু বেশি পুঁজি লাগে কিন্তু সেই পুঁজির হিসেবে লাভ কম হয়। সেজন্য খুব কম ক্ষেত্রে এই ভাবে দেশি মুরগি পালন করা হয়। এভাবে পালন করলে তাদের বৃদ্ধি কম হয় এবং মুরগি ছোট আকারের হয়।

মুরগির পায়খানা বা বিষ্ঠার ব্যবহার, Use of chicken Excrement :

জৈব সারের একটি ভালো উৎস হল মুরগির পায়খানা বা বিষ্ঠা । সারা উঠোন জুড়ে মুরগি যখন চড়ে বেড়ায় তখন বিভিন্ন স্থানে বিষ্ঠা ছড়িয়ে দেয় যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।

বাজার সম্ভাবনা, Market Potential: :

মুরগির পায়খানা বা বিষ্ঠার ব্যবহার

দেশি মুরগির বাজার সম্ভাবনার কথা বলতে গেলে, এদের স্থানীয় বাজার ছাড়াও বড় বাজারে বিক্রি করা যায়। এছাড়াও বাড়িতে পালিত মুরগির ডিম প্রতিবেশীদেরকে, স্থানীয় দোকানগুলোতে বা বাজারে পাইকারি বা খুচরা বিক্রি করা যেতে পারে।

দেশি মুরগির রোগ সমূহ, Diseases of Desi Murgi :

দেশি মুরগির রাণীক্ষেত রোগ, গামবোরা রোগ, পুলোরাম রোগ, বসন্ত রোগ, ফাউল কলেরা রোগ, হিট স্ট্রোক রোগ, আমাশয় রোগ ইত্যাদি রোগ হতে পারে।

রাণীক্ষেত রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জেনে নিন :

  • সাদা চুনের মত পাতলা মল ত্যাগ।
  • ঘাড় বেঁকে যায়।
  • কখনও কখনও মুরগি একই স্থানে দাঁড়িয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
  • নাক দিয়ে সর্দি পড়ে ।
  • মুখ দিয়ে লালা ঝরে।
  • শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয়, অনেক ক্ষেত্রে মুখ খোলা রেখে নিঃশ্বাস নেয়।
  • মাথা নিচু ও চোখ বন্ধ রেখে ঝিমাতে থাকে।

রোগের প্রভাব বেশি হলে মুরগী দূর্বল হয়ে যায় এবং ঠোঁট ও বুক মাটিতে লাগিয়ে বসে পড়ে। কিছু মুরগি এই রোগের প্রভাবে খাওয়া বন্ধ করে দেয়।

দেশি মুরগি পরিচর্যা, Taking Care of Desi Murgi :

দেশি মুরগি পরিচর্যা করার জন্য যা করতে হয় :

  •   সকালে মুরগির ঘর খুলে কিছু খাবার দিতে হবে।
  • সন্ধ্যায় মুরগি ঘরে ঢুকে পড়ার আগে আবার কিছু খাবার দিতে হবে।
  • মুরগিগুলো ঘরে ঢুকে পড়লে দরজা বন্ধ করে দিতে হবে।
  • মুরগির পায়খানা ঘরের মেঝেতে যেন লেপ্টে না যায় সেজন্য ঘরের মেঝেতে ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া পুরু করে বিছিয়ে দিতে হবে।
  • পায়খানা জমতে জমতে শক্ত জমাট বেঁধে না যায় তাই কিছুদিন পর পর পরিষ্কার করতে হবে।

দেশি মুরগিকে কি কি ভ্যাকসিন দিতে হয়? What vaccines should be given to Desi Murgi?

দেশি মুরগিকে কি কি ভ্যাকসিন দিতে হয়?

রাণীক্ষেত, গামবোরো এবং ফাউল পক্স, ফাউল কলেরা রোগের টিকা প্রদান করতে হবে।

একটি মুরগির খাবারে কয়টি স্তর থাকে? How many layers are in a chicken feed?

প্রায় 16 সপ্তাহ বয়স থেকে মুরগিকে একটি ভালো মানের লেয়ার ফিড খাওয়ানো উচিত। একটি মুরগি প্রতিদিন 100 থেকে 150 গ্রাম ফিড খাবে।

দেশি মুরগি চাষ কি লাভজনক? Is Desi Murgi farming profitable?

স্থানীয় মুরগি লাভজনক হতে পারে যদি আপনি একটি ব্যবসার মতো আপনার মুরগির খামার প্রতিষ্ঠান চালান, একটি সঠিক মুরগির ব্যবসা পরিকল্পনার সাথে। স্থানীয় মুরগি পালনের ব্যবসা শুরু করা খুবই সহজ। কোন প্রাথমিক মূলধন প্রয়োজন হয় না, বিশেষ করে যদি আপনি একটি শখ হিসেবে করে থাকেন।

শেষ কথা, Conclusion :

আশা করি উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আপনারা দেশি মুরগি পালন ও পরিচর্যার পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা করতে সক্ষম হয়েছেন। কেউ যদি মুরগি পালন শুরু করতে চায় তবে উল্লেখিত তথ্যগুলো অবশ্যই মনে রাখবেন।

Frequently Asked Questions

মুরগিতে প্রোটিন বেশি খেলে কি হয়?

মুরগি অত্যধিক প্রোটিন খেলে পাখির স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

মুরগির খাবারের পরিমাণ কত?

মুরগি প্রতিদিন প্রায় ¼-পাউন্ড ফিড বা প্রতি সপ্তাহে 1.5 পাউন্ড ফিড খায়। আপনি যদি 50-পাউন্ড ফিডের ব্যাগ কিনছেন তবে এটি আপনার মুরগিকে প্রায় 33 সপ্তাহের জন্য খাওয়াবে।

দেশি মুরগির কি কি রোগ হয় ?

রাণীক্ষেত রোগ, গামবোরা রোগ, পুলোরাম রোগ, বসন্ত রোগ, ফাউল কলেরা রোগ, হিট স্ট্রোক রোগ, আমাশয় রোগ

Contents show

RIma Sinha

Rima Sinha is working as a writer and also as a journalist. she got her bachelor of arts degree from Tripura University. She has also completed Master of Arts in Journalism and mass communication from Chandigarh University.

Recent Posts