ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের অন্যতম বড় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। এই ব্যাংকটি ইসলামি শরীয়াহ অনুসারে পরিচালিত হওয়ায় দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
ইসলামী ব্যাংকের কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য, Some important information about Islami Bank:
- প্রতিষ্ঠা ও আকার: ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকটি দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংকগুলোর অন্যতম। এর ৬২৩টি শাখা রয়েছে।
- মালিকানা: ব্যাংকটি যৌথ মালিকানায় পরিচালিত। এর ৩৬.৯১% স্থানীয় এবং ৬৩.০৯% বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে।
- অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য: বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে লাভজনক ব্যাংক হিসেবে পরিচিত।
- আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: ‘দ্য ব্যাংকার’ ম্যাগাজিনের তালিকায় বিশ্বের ১,০০০ শীর্ষ ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত।
কেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এত জনপ্রিয়? Why is Islami Bank Bangladesh Limited so popular?
- ইসলামি শরীয়াহ: ইসলামি শরীয়াহ অনুসারে পরিচালিত হওয়ায় মুসলিম গ্রাহকদের জন্য এই ব্যাংকটি বিশেষ আকর্ষণীয়।
- বৃহৎ নেটওয়ার্ক: দেশজুড়ে বিস্তৃত শাখা নেটওয়ার্কের কারণে গ্রাহকরা সহজেই ব্যাংকের সেবা গ্রহণ করতে পারেন।
- আর্থিক স্বচ্ছতা: ব্যাংকটির আর্থিক স্বচ্ছতা এবং স্থিতিশীলতা গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে।
- আধুনিক ব্যাংকিং সেবা: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড আধুনিক ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ইসলামি শরীয়াহ অনুসারে পরিচালিত হওয়া এবং দেশজুড়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কারণে এই ব্যাংকটি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংকের মূলনীতি :
- সুদ নিষিদ্ধ: ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদ গ্রহণ বা প্রদান করে না।
- লাভ-লোকসানের ভাগাভাগি: ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়ই বিনিয়োগের লাভ-লোকসানের ভাগ নেয়।
- স্বচ্ছতা: সমস্ত লেনদেন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হয়।
- সামাজিক দায়িত্ব: ইসলামী ব্যাংকগুলো সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখে।
ইসলামী ব্যাংকের সেবা :
- জমা: মুদারাবা, মুশারাকা ইত্যাদি পদ্ধতিতে জমা গ্রহণ।
- ঋণ: মুদারাবা, মুশারাকা ইত্যাদি পদ্ধতিতে ঋণ প্রদান।
- বিনিময়: বিভিন্ন ধরনের বিনিময় সেবা।
- বীমা: ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বীমা সেবা।
ইসলামী ব্যাংকের সুবিধা :
- নৈতিকতা: সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
- লাভের সুযোগ: বিনিয়োগের লাভে অংশীদার হওয়ার সুযোগ।
- সামাজিক উন্নয়ন: সামাজিক কল্যাণে অবদান।
ইসলামী ব্যাংকের ইতিহাস, History of Islami Bank :
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার সূচনা
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার শুরু একদম স্বাধীনতার পর থেকেই। ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা শুরু হয়।
প্রাথমিক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা
১৯৭৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ মহসিন দুবাই ইসলামি ব্যাংকের অনুরূপ বাংলাদেশে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য পররাষ্ট্র সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে সুপারিশ করেন। এরপর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা ও পরিকল্পনা শুরু করে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা পরিচালক এ এস এম ফখরুল আহসান বিভিন্ন দেশের ইসলামি ব্যাংক পরিদর্শন করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেন, যেখানে তিনি বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।
প্রথম ইসলামি ব্যাংকের জন্ম
বহুমাত্রিক চেষ্টার ফলস্বরূপ ১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড নামে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম শরীয়াভিত্তিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ মীর কাশেম আলী সহ ১৯জন বাংলাদেশি ব্যক্তিত্ব, ৪টি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান এবং আইডিবিসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ১১টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা এবং সৌদি আরবের দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তারূপে এগিয়ে আসেন।
ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা ও বিকাশ
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। শরিয়াহ-সম্মত নীতিমালা অনুসারে পরিচালিত হওয়ায় ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে এই ব্যাংকের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে এবং দেশের অন্যান্য ব্যাংককেও ইসলামী ব্যাংকিং পণ্য ও সেবা চালু করতে অনুপ্রাণিত করেছে।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার সূচনা এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই ব্যাংক শুধুমাত্র একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি ইসলামী মূল্যবোধকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগের একটি উদাহরণ।
ব্যবসায়িক তথ্য :
- সর্বমোট জোন – ১৭ টি
- সর্বমোট শাখা – ৬২৩ টি
- শাখা – ৩৯৪ টি
- উপশাখা – ২২৯ টি
- এডি শাখা – ৭০ টি
- কর্পোরেট শাখা – ৮ টি
- এটিএম বুথের সংখ্যা – ১৮৫২ টি
- সিআরএম মেশিন – ৫৩১ টি
- এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা- ২৭০৬ টি
- শেয়ারধারীর সংখ্যা – ৩৩,৬৮৬ জন
- জনবল – ১১,৩৮১ জন
প্রধান অংশীদারগণ :
- ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি)
- জর্ডান ইসলামীক ব্যাংক, জর্ডান
- ইসলামীক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কর্পোরেশন, দোহা, কাতার
- বাহরাইন ইসলামীক ব্যাংক, বাহরাইন
- ইসলামীক ব্যাংকিং সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং এস.এ.
- মুদ্রা বিনিময় ও বাণিজ্যের জন্য আল-রাজি কোম্পানি
- শেখ আহমেদ সালাহ জমজুম, জেদ্দা, কেএসএ
- ফুয়াদ আব্দুলহামিদ আল-খতিব (প্রয়াত), কে.এস.এ
- দুবাই ইসলামী ব্যাংক
- দ্য পাবলিক ইনস্টিটিউশন ফর সোশ্যাল সিকিউরিটি, সাফাত
- কুয়েত ফিন্যান্স হাউস
- কুয়েতের তিনটি মন্ত্রণালয়
- ব্যাংকটির ৬৩.০৯% শেয়ার উপরিউক্ত বিদেশী অংশীদারগণের আর বাকি ৩০.৯১% এর মালিকানা বাংলাদেশের ৬০,০০০ শেয়ারহোল্ডারগণ।
ডিজিটাল সেবা :
- আই ব্যাংকিং।
- সেলফিন।
- এসএমএস ব্যাংকিং।
- মোবাইল ব্যাংকিং।
- এটিএম সেবা।
- এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা।
- সিআরএম/সিডিএম সেবা।
ইসলামী ব্যাংকের পুরস্কার প্রাপ্তি, Award received by Islami Bank :
- দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে ‘সার্ক অ্যানিভ্যার্সারি এওয়ার্ড ফর কর্পোরেট গভর্নেন্স’ এর প্রথম পুরস্কারে ভূষিত করে।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্স’, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে ১৯৯৯, ২০০০, ২০০৪, ২০০৫ এবং ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা ইসলামী ব্যাংক হিসেবে ভূষিত করে।
- দেশে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় বা বৈদেশিক রেমিট্যান্স আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে। দেশে ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণের পুরস্কারস্বরূপ সেন্টার ফর এনআরবি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে গোল্ড রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ২০১৯ ও ২০২০ সালের রেমিট্যান্স পুরস্কার পেয়েছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড শুধুমাত্র একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি সমাজের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন:
ব্যাপক পরিসরে সামাজিক কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যাংকটি ৩৮ মিলিয়ন টাকা ফান্ডের ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন নামে একটি পৃথক ফাউন্ডেশন গঠন করেছে। এই ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সামাজিক কল্যাণ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের সামাজিক কল্যাণমূলক কার্যক্রমসমূহ মধ্যে রয়েছে:
- ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল
- ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী
- কমিউনিটি হাসপাতাল
- মনোরোম: ইসলামী ব্যাংক নৈপুণ্য ও ফ্যাশন ঘর
- সেবা কেন্দ্র
- ইসলামী ব্যাংক প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট
- ইসলামী ব্যাংক আন্তর্জাতিক স্কুল ও কলেজ
- ইসলামী ব্যাংক ফিজিথেরাপী ও পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্র
- উন্নয়ন আলোচনা কেন্দ্র
- বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ইসলামী ব্যাংক, Islami banks are at the center of the controversy :
২০২২ সালের নভেম্বর মাস:
ইসলামী ব্যাংকের নাম জড়িয়ে পড়ে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটি থেকে ভুয়া নথিপত্র ও ঠিকানা ব্যবহার করে একাধিক কোম্পানি সর্বমোট ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ঋণ তুলে নিয়েছে। এরপর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত আরেকটি সংবাদে উঠে আসে, আরজেএসসি থেকে রেজিস্ট্রেশনের মাত্র ১৪ দিনের মধ্যে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে আরেকটি কোম্পানি ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
এরপর ৩০ নভেম্বর, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি থেকে বিভিন্ন সময়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ তুলে নিয়েছে, যেখানে নিয়মানুসারে গ্রুপটি ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার অধিকার রাখে।
আরও একটি উদ্বেগের বিষয়:
২০২০ সালের মার্চ মাসে ইসলামি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও প্রশ্নের জন্ম দেয়।
প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি:
ইসলামি ব্যাংকের এই ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্তের জন্য এসব কোম্পানিকে নতুন করে ঋণ ছাড় বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে, হাইকোর্ট রিট আবেদন করার পরামর্শ দেয়।
ইসলামী ব্যাংকের এই ঘটনাবলি ব্যাংকিং খাতে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ভুয়া নথিপত্র ও ঠিকানা ব্যবহার করে অবৈধভাবে ঋণ তোলা, নিয়ম-কানুন অমান্য করা এবং পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেওয়া—এসব ঘটনা ব্যাংকটির পরিচালনায় গুরুতর ত্রুটির ইঙ্গিত দেয়। এই ঘটনাবলির তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন এবং দোষীদের বিচার করা অত্যন্ত জরুরি।
শেষ কথা, Conclusion :
ইসলামী ব্যাংক হলো এমন একটি ব্যাংক যা ইসলামী শরীয়তের নীতিমালা অনুসারে পরিচালিত হয়। এই ব্যাংকগুলো সুদ লেনদেনকে নিষিদ্ধ করে এবং লাভ-লোকসানের ভাগাভাগির উপর ভিত্তি করে কাজ করে। ব্যাংকটি সামাজিক কল্যাণমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে চলেছে।