রুই মাছ ভারত ও বাংলাদেশের অতি পরিচিত সুস্বাদু মাছ। ছোটবেলায় পাঠ্য বইয়ে সকলেই পড়েছি যে রুই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Labeo rohita। রুই এর ইংরেজি নাম হচ্ছে Rohu Carp।
রুই মাছ আমাদের মধ্যে অনেকেই নিত্যদিন খেয়ে থাকেন, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এই মাছ সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য জানেন না। এই মাছের উৎপাদন প্রক্রিয়া, উপকারিতা ইত্যাদি জেনে রাখা প্রয়োজন। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা রুই মাছ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
রুই মাছের অপর নাম কি? What are the other names of Rohu fish?
রুই বাংলাদেশ ও ভারতে বহুল পরিচিত মাছগুলোর মধ্যে একটি। আন্তর্জাতিকভাবে রুই মাছের নাম বলা হয়ে থাকে রোহু। স্থানীয় নাম রুই, রোহিতা, রুহিত, রাউ, নলা, গরমা, নওসি।
রুই কি ধরনের মাছ ? What kind of fish is Rohu ?
মিঠে জলের যেসব মাছের মাথায় আঁশ থাকে না কিন্তু বাকি সারা দেহ সাইক্লয়েড (cycloid) আঁশ দিয়ে আবৃত থাকে, তথা দেহগহ্বরে পটকা থাকে তাদের কার্প (carp) জাতীয় মাছ বলা হয়।
অন্যদিকে কার্প জাতীয় মাছের মধ্যে যেগুলো আকৃতিতে কিছুটা বড় এবং দ্রুত বর্ধনশীল হয়, পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে বলা হয় মেজর কার্প। রুই মাছ মেজর কার্প জাতীয় মাছ।
রুই মাছের উৎপাদন, Production of Rohu fish :
রুই মাছ (Labeo rohita) স্বাদু জলে চাষযোগ্য, সুলভ, জনপ্রিয় ও প্রোটিনসমৃদ্ধ সুস্বাদু একটি মাছ। বলাই বাহুল্য যে রুই একটি দ্রুত বর্ধনশীল মাছ এবং স্বাভাবিক অবস্থায় খামারে বছরে ৩৫-৪৫ সেন্টিমিটার (১-১.৫ ফুট) লম্বা হয় এবং ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনবিশিষ্ট হয়।
কিন্তু নদীর রুইয়ের পোনার বৃদ্ধি ২-২ কেজি পর্যন্ত হয়। বাণিজ্যিক চাহিদা আছে বলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর চাষ করা হয়।
তবে শুধু বৃদ্ধি হারের জন্যই নয়, রুই মাছের বিভিন্ন চাষ কেন্দ্রগুলোতে অন্তঃপ্রজননের ফলে ম্যাচে বিভিন্ন জিনগত সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এদিকে রুই মাছের প্রাকৃতিক ও বিশুদ্ধ জিনের পোনা দিন দিন দুর্মূল্য হয়ে উঠছে।
রুই মাছের প্রিয় খাবার কি? What is the favorite food of the Rohu fish?
রুই মাছ শাকাশী। এরা সাধারণত জলের মধ্যস্তরে চলাচল করে৷ এদের মুখ কিছুটা নিচের দিকে নামানো এবং পুরু ঠোঁট থাকার কারণে জলজ উদ্ভিদ, আগাছা এবং মাঝে মাঝে জলের তলদেশ থেকে পঁচা জৈব পদার্থ খেয়ে জীবনধারণ করে৷ এছাড়াও ফিসমিল, খৈলের গুঁড়া, কুঁড়া ইত্যাদি পুকুরে চাষের সময় সম্পূরক খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
কী কী পুষ্টি উপাদান আছে রুই মাছে? What nutrients are there in Rohu fish ?
রুই মাছের বেশ কিছু পুষ্টিকর উপাদান থাকে যা আমদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। এই মাছে আছে -ভিটামিন A, D, E; এছাড়াও আছে ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন ও খনিজ উপাদান।
পুষ্টিবিদদের মত অনুসারে, রুই মাছে কোলিন নামের একটি পদার্থ থাকে যা ডিএনএ সংশ্লেষে সাহায্য করে। পাশাপাশি এটি স্নায়ুতন্ত্র ভালো রাখে, ফ্যাটের বিপাক ক্রিয়া সহজ করতেও সাহায্য করে।
রুই মাছ কখন প্রজনন ঘটায়? When does Rohu fish breed?
রুই মাছের প্রজনন ঘটে জুন জুলাই মাসে। রুই মাছের আইশের সর্বাধিক বৃদ্ধি ঘটে বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে।
রুই মাছ চাষের পদ্ধতি, Method of farming of Rohu fish:
- রুই মাছ দেশি এবং কার্প জাতীয় অন্যান্য মাছের সাথে মিশ্রভাবে চাষ করা যায়। এর জলের মধ্যস্তরে থাকে, যার কারণে জলের উপরের স্তরের- কাতল ও নিচের স্তরের কালো কার্পের চাষ করা হয়। এছাড়াও এই মাছ চাষের ক্ষেত্রে খাদ্য খরচ কম হয়।
- মাছ চাষ করার পূর্বে পুকুর প্রস্তুত করা হয়। পুকুর প্রস্তত করে সেই পুকুরে জল মজুদ করে একটি নির্দিষ্ট আকারের রুই মাছের পোনা ছাড়তে হয়।
- জলের গুণাগুণ ঠিক রেখে দৈনিক ২-৩ বারে এদের ওজনের ৩-৫ শতাংশ সম্পূরক খাবার দিতে হয়। সম্পূরক খাবার তৈরি করার জন্য চালের কুড়া, ফিসমিল, সরিষার খৈল, ফিস গ্রোয়ার সহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
- বাজারে রুই মাছের বেশ চাহিদা আছে, এই মাছ ৬ মাস চাষ করার পর থেকেই খাওয়া ও বাজারজাত করা যায়।
রুই মাছ খাওয়ার উপকারিতা, Benefits of eating Rohu fish :
‘মাছে ভাতে বাঙালি’ কথাটি হয়তো সবাই শুনেছেন। এমন কথা প্রচলনের কারণ হল, বহু প্রাচীন সময় থেকে প্রতিদিনের খাবারে বাঙালির পাতে মাছ থাকা চাই।
মাছের মধ্যে রুই তো বলতে গেলে সবারই পছন্দের। যাচাই করলে দেখা যায় যে, বাঙালি হেঁশেলে রুই-কাতলার আনাগোনাই সবচেয়ে বেশি। এই মাছের ঝোল থেকে কালিয়া সবকিছুই খেতেই সুস্বাদু।
তবে অনেকেই হয়তো জানেন না যে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতেও এই মাছের তুলনা হয় না। রুই মাছ রোজ খেলে দৈহিক অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। রুই মাছ খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিন :
রুই মাছ হৃদযন্ত্রের জন্য ভাল
রুই মাছে ক্যালোরির পরিমাণ খুব কম থাকে, তাই যারা অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চিন্তিত, তারা ডায়েটে এই মাছ রাখতে পারেন।
রুই মাছের তেলে ওমেগা থ্রি নামক অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল এলডিএল ও ভিএলডিএল কম করে দেয় এবং উপকারী কোলেস্টেরল অর্থাৎ এইচডিএলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, এর ফলে হৃদযন্ত্রে চর্বি জমতে পারে না। তাই হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতে রুই মাছ খেতে পারেন।
স্ট্রোকের ঝুঁকি কম করে
আমেরিকার স্কুল অব নিউট্রিশনের একটি জার্নালে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রুই মাছ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কম করে দেয় এবং উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তাও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
অন্যদিকে ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল ইনফর্মেশনের তথ্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, ওমেগা থ্রি রক্তের অণুচক্রিকাকে জমাট বাঁধতে দেয় না, যেহেতু রুই মাছের ওমেগা থ্রি থাকে তাই এটি রক্ত জমাট বাঁধা রোধ করে। আমরা সকলেই জানি যে রক্তনালিতে জমাট বাঁধার কারণে স্ট্রোক হয়।
সেক্ষেত্রে স্ট্রোক প্রতিরোধে রুই মাছের ভূমিকা রয়েছে। বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র এবং পুষ্টিবিদদের মতে, ভালো মানের প্রোটিনের অন্যতম উৎস রুই মাছ। তাই খাবারের তালিকায় এই মাছ রাখতে পারেন।
ত্বককে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে
ত্বকের নানা রকম সংক্রমণ বা প্রদাহের সমস্যাও কমতে পারে। এই মাছে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বককে নানা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে।
জয়েন্ট টিস্যু ভাল রাখে
হাড়ের ব্যথায় যারা ভোগেন, তারা রোজ এই মাছ খেলে হাড়ের সমস্যা কমতে পারে। এতে থাকা উপকারী উপাদান হাড়ের সংযোগস্থল নমনীয় করে, ফলে ব্যথা কমে।
রুই মাছে থাকা প্রোটিন আমাদের জয়েন্ট টিস্যু ভাল রাখতে সহায়ক। ১০০ গ্রাম রুই মাছে ১৯ গ্রাম প্রোটিন থাকে। তাই এই মাছ খেলে গাঁটের ব্যথা থেকে আরাম মিলতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
রুই মাছে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। রুই মাছে থাকা সেলেনিয়াম, জিংক, ভিটামিন A এর মত উপকারী উপাদানগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
রুই মাছ কতটুকু খাবেন ? How much Rohu fish should be consumed?
স্বাস্থ্যের জন্য ভালো বলে অতিরিক্ত রুই মাছ খাওয়াও উচিত হবে না। পরিমিত পরিমাণে রুই মাছ খাওয়া উচিত। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন মানুষের জন্য দৈনিক রুই মাছের একটা বড় টুকরাই যথেষ্ট।
রুই মাছের জনপ্রিয় রান্নার পদ্ধতি, Popular cooking Methods with Rohu Fish:
রুই মাছের ঝোল:
উপকরণ : পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, লঙ্কা, ধনে গুঁড়া।
রান্নার পদ্ধতি: মাছগুলো হালকা ভেজে নিয়ে মসলার সাথে ভালোভাবে সিদ্ধ করে নিন।
রুই মাছ ভাপা:
উপকরণ : সরিষার তেল, সরিষার গুঁড়া, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ কুচি।
রান্নার পদ্ধতি: রুই মাছের টুকরাগুলি মসলা মাখিয়ে ভাপে সিদ্ধ করে নিতে হবে।
রুই মাছ ভাজা:
উপকরণ : হলুদ, লবণ, লঙ্কা গুঁড়া।
রান্নার পদ্ধতি : মাছের টুকরাগুলি মসলা দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে তেলে ভেজে নিন।
রুই মাছের কালিয়া:
উপকরণ : পেঁয়াজ, টমেটো, আদা-রসুন, গরম মসলা।
রান্নার পদ্ধতি: মসলা ভালোভাবে কষানোর পর একটু জল যোগ করে গ্রেভি তৈরি করে তাতে মাছ ছেড়ে একটু সময় ফুটতে দিয়ে নামিয়ে নিন।
শেষ কথা, Conclusion :
আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা রুই মাছ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যেহেতু এই মাছের বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে, সেক্ষেত্রে আপনারা চাইলে এই মাছ নিজের খাদ্যতালিকায় যুক্ত করতে পারেন। আমাদের এই প্রতিবেদন আপনদের মনোগ্রাহী হলে অবশ্যই নিজের পরিবার ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।
Frequently Asked Questions
রুই মাছের প্রজনন ঘটে জুন জুলাই মাসে।
জলজ উদ্ভিদ, আগাছা এবং মাঝে মাঝে জলের তলদেশ থেকে পঁচা জৈব পদার্থ খেয়ে জীবনধারণ করে৷
পরিমিত পরিমাণে রুই মাছ খাওয়া উচিত। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন মানুষের জন্য দৈনিক রুই মাছের একটা বড় টুকরাই যথেষ্ট।