কবুতর এক ধরনের জনপ্রিয় গৃহপালিত পাখি। কবুতরকে সৌন্দর্য্যের প্রতীক বলা হয়। কবুতরগুলো আদিম যুগ থেকেই অতি জনপ্রিয়, কারণ আদিম যুগে এদের মাধ্যমে চিঠি আদান-প্রদান করা হতো অর্থাৎ কবুতরকে সংবাদবাহক হিসেবে ব্যবহার করা হতো, তাছাড়াও এটি খেলার পাখি হিসাবে ব্যবহার হতো। কত গল্পের বইতে আমরা পড়েছি কবুতর দিয়ে জরুরী সন্দেশ পাঠানোর কথা।
কবুতরের গৃহপালন, Domestication of pigeons
গৃহপালিত কবুতরের বৈজ্ঞানিক নাম Columba livia domestica। সব গৃহপালিত কবুতরের উদ্ভব বুনো কবুতর থেকে, যার বৈজ্ঞানিক নাম Columba livia। গবেষণায় দেখা যায় যে কবুতরের গৃহপালন প্রায় ১০,০০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল। কবুতরের ঘরে যাতে জল না আসে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। কবুতরের ঘর সব সময় পরিষ্কার রাখা বাঞ্ছনীয়।
কবুতরের খাদ্য, Kobutorer khadyo
কবুতর দানাদার জাতীয় খাদ্য বেশি পছন্দ করে। কবুতরের খাবার হল গম, চাউল, কাউন, ধান, খুদ, চিনা সরিষা, ডাবলি, রেজা, বাজরা, বিভিন্ন বিজ ইত্যাদি। গৃহপালিত কবুতরের জন্য তৈরিকৃত খাদ্য শর্করা, আমিষ, খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন, চর্বি এবং খনিজ লবণসম্পন্ন সুষম খাদ্য হতে হবে। বিভিন্ন প্রজাতির কবুতরের খাবারও ভিন্ন ভিন্ন।
গোল্লা প্রজাতির কবুতর সাধারণত সব ধরনের শস্যদানাই খায়। আর গিরিবাজ কবুতরে খায় ধান, গম, সরিষা, তিসি, ভুট্টা, কুসুম ফুলের বিচি ইত্যাদি। ফেন্সি কবুতরের খাবার হচ্ছে ডাবি্ল বুট, ছোলা বুট, গম, সূর্যমুখীর বিচি, কুসুম ফুলের বিচি ইত্যাদি। হোমারের খাবার একেবারেই ভিন্ন।
১৭ পদের শস্যদানা পরিমাণমতো মিশিয়ে এদের খাবার তৈরি করা হয়। এ খাবারে অন্তর্ভুক্ত থাকে বাদাম, ডাবি্ল বুট, ছোলা বুট, সূর্যমুখীর বিচি, কুসুম ফুলের বিচি, তিসি, বাজরা, চিনা, মুগ ডাল, মাসকলাই, মসুর, হেলেন ডাল ইত্যাদি।
কবুতরের শারীরবৃত্তিক বিশেষ কিছু তথ্যাদি, Some special facts about the anatomy of pigeons
দেহের তাপমাত্রা ৩৮.৮ – ৪০.০ সেলসিয়াস
দৈহিক ওজন- দৈহিক ওজন কবুতরের প্রজাতির উপর নির্ভর করে।
- (ক) হালকা জাতঃ ৪০০-৪৫০ গ্রাম
- (খ) ভারী জাতঃ ৪৫০-৫০০ গ্রাম
দৈনিক জল পান-
- (ক) শীতকালে প্রতিদিন ৩০-৬০ মিলি
- (খ) গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন ৬০-১০০ মিলি
একটি পূর্ণবয়স্ক কবুতরের ডানায় সাধারণত ১০টি পালক থাকে, পালকগুলিকে কবুতরের বয়স নির্ণয়েও সাহায্য করে।
দৈনিক খাদ্য গ্রহণ ৩০-৬০ গ্রাম (গড়)।
কবুতরের ডিম ফুটানোর সময়কাল = ১৭-১৮ দিন।
কবুতরের প্রজনন, Pigeon breeding
কবুতরের প্রজননের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে এই পাখির জননতন্ত্রে ডিম উৎপন্ন হয়। এদের ডিম্বাশয়ে একসাথে সাধারণত দু’টি ফলিকুল তৈরি হয়। ৫-৬ মাস বয়স থেকে একটি স্ত্রী কবুতর ডিম দিতে শুরু করে। মাসে প্রতিটি স্ত্রী কবুতর দু’টি ডিম পাড়ে।
ডিম পাড়ার ৪০-৪৪ ঘণ্টা পূর্বে এদের ডিম্ব স্খলন হয় এবং ডিম পাড়ার কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা পূর্বে এই ডিম্ব নিষিক্ত হয়, অর্থাৎ ১৬-২০ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিম ডিম্বনালীতে থাকে এবং সেই সময়কালেই তা নিষিক্ত হয়ে থাকে। ডিম পাড়ার পর থেকে মর্দা ও মাদী উভয় কবুতর পর্যায়ক্রমে ডিমে তা দিয়ে থাকে। সাধারণত মাদী কবুতর বিকেল থেকে শুরু করে পরের দিন সকাল পর্যন্ত ডিমে তা দেয় এবং সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মর্দা কবুতর তা দেয়।
সাধারণত ডিম পাড়ার ১৭-১৮ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা কবুতর বের হয়। একটি মাদী কবুতর সাধারণত ১২ মাসে ১০-১২ জোড়া বাচ্চা উৎপাদন করে। বাচ্চা কবুতর জন্মের প্রথম দিন থেকে ২৬ দিন বয়স পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান অবস্থায় থাকে। প্রথমে তাদের সারা দেহ হলুদ পাতলা বর্ণের লোম দ্বারা আবৃত থাকে। তখন এদের নাক ও কানের ছিদ্র বেশ বড় দেখায়।
প্রায় ৪-৫ দিন পর এই বাচ্চার চোখ খোলে। ১৫ দিনে বাচ্চার সমস্ত শরীর পালকে ভরে যায়। জন্মের প্রায় ১৯-২০ দিন পর বাচ্চার দু’টো ডানা এবং লেজ পূর্ণতা লাভ করে, পাশাপাশি ঠোঁটও স্বাভাবিক হয়। ২৬-২৮ দিনে কবুতরের বাচ্চা পূর্ণতা লাভ করে। কবুতর সাধারণত ২০-৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। জঙ্গলী কবুতর ৫ বছর এবং গৃহপালিত কবুতর ১০-১৫ বছর বাঁচে।
কবুতরের রোগব্যাধি, Diseases of pigeons
কবুতর একটি পাখি, তাই পাখি হিসেবে মুরগি/হাঁসের মধ্যে যে রোগগুলো দেখা দেয়, এদের মধ্যেও সেই রোগগুলো দেখা দিয়ে থাকে। যেমন: ককসিডিওসিস বা পাতলা চুনযুক্ত পায়খানা, সালমোনেলা, রানিক্ষেত পি এমভি/নিউ ক্যাসল ডিজিজ, কৃমি, ক্যাংকার বা মুখে ঘা, ক্রনিক রেসপিরেটরি ডিজিজ সি আর ডি, পক্স, বার্ড ফ্লু ইত্যাদি রোগ কবুতরের ক্ষেত্রে হতে দেখা যায়।
কবুতরের ভিন্ন প্রজাতি, Different species of pigeon
পৃথিবীতে ২০০ প্রজাতির কবুতর রয়েছে তার মধ্যে ৩০টি প্রজাতির কবুতর ভারত ও বাংলাদেশে দেখা যায়।
বিভিন্ন রং, বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ, চোখ ইত্যাদি এর উপর ভিত্তি করে নামকরণ বা জাত ঠিক করা হয়। প্রধান কয়েকটি জাত হল :
হোমার:
এই জাতের কবুতর দিয়ে রেস খেলা পৃথিবীর একটি প্রাচীনতম শৌখিন খেলা।
চুইনা:
সমস্ত শরীর সাদা কিন্তু সমস্ত চোখ কালো নয়।
কাগজি:
সমস্ত শরীর সাদা কিন্তু সমস্ত চোখ কালো।
গোররা :
শরীর সাদা কালো মিশ্রণ, যেমন মাথা সাদা, পিঠ কালো, ডানা সাদা), সিলভার গোররা, কালো গোররা।
পটার:
গলার নিচটা ফুটবলের মতো।
গিরিবাজ :
পাক-ভারতীয় সাদা চোখ ও কালো মণী বিশিষ্ট কবুতর গিরিবাজ নামে পরিচিত।
কিং:
এই জাতের কবুতর মূলত প্রদর্শনীতে ব্যবহৃত হয়।
লাহোরী/সিরাজী (শৌখিন):
এদের চোখের চারদিক থেকে শুরু করে গলার সম্মুখভাগ, বুক, পেট, নিতম্ব, পা ও লেজের পালক সম্পূর্ণ সাদা হয় এবং মাথা থেকে শুরু করে গলার পিছন দিক এবং পাখা রঙিন হয়।
গোলা (দেশি কবুতর):
এই জাতের কবুতরের উৎপত্তিস্থল পাক-ভারত উপমহাদেশ। আমাদের দেশে এ জাতের কবুতর প্রচুর দেখা যায় এবং মাংসের জন্য এটার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে।
গোলী:
এ জাতের কবুতর পাকিস্তানের লাহোর ও ভারতের কলকাতায় বেশ জনপ্রিয় ছিল। এদের ঠোঁট ছোট হয় এবং পায়ে লোম থাকে না। এদের বর্ণ সাদার মধ্যে বিভিন্ন ছোপযুক্ত।
ফ্যানটেল/লাক্ষা:
শৌখিন, লেজগুলো দেখতে ময়ূরের মত ছড়ানো। এ জাতের কবুতর লেজের পালক পাখার মত মেলে দিতে পারে বলে এদেরকে ফ্যানটেলও বলা হয়। এদের রং মূলত সাদা তবে কালো, নীল ও হলুদ বর্ণের ফ্যানটেল সৃষ্টিও সম্ভব হয়েছে। এই জাতের কবুতর প্রদর্শনীতে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়াও রয়েছে বাঘা, সোয়া চন্দন, ঘিয়া-সুল্লি, লাল-সুল্লি, সবুজ গলা, লাল গলা ইত্যাদি জাতের পায়রা।
কবুতরের বিশেষ প্রজাতি, Some special species of pigeon
পিঙ্ক-নেকেড গ্রীন কবুতরঃ
পিঙ্ক-নেকেড গ্রীন উজ্জ্বল বর্ণের গাছ-বাসিন্দা কবুতর। এদের বন, ম্যানগ্রোভ, কাঠের অঞ্চল, উদ্যান এবং পার্কে দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের গোলাপী ঘাড়, কমলা স্তনের প্যাচ, ধূসর-নীল মাথা এবং হলুদ পেট থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা অনেক সমতল, উপরে সবুজ এবং নীচে উজ্জ্বল হলুদ-সবুজ রঙের হয়ে থাকে।
নিকোবার কবুতরঃ
নিকোবার কে রঙ বাহারী সুন্দর কবুতর বলা হয়। এই প্রজাতির কবুতর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, ভারতীয় নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ থেকে পূর্ব দিকে থাইল্যান্ড এবং পাপুয়া নিউ গিনির মতো জায়গায় বাস করে। এটি একটি বিশাল কবুতর, যা দৈর্ঘ্যে ৪০ সেমি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ভিক্টোরিয়া ক্রাউনড কবুতরঃ
ভিক্টোরিয়া মুকুটযুক্ত কবুতর বিশ্বের বৃহত্তম কবুতর প্রজাতি। এদের শরীরের সম্মুখভাগের অংশে মেরুন রঙের প্যাচ থাকে, তাদের পালকগুলি নীল-ধূসর রঙের হয়। একটি ভিক্টোরিয়া মুকুটযুক্ত কবুতরের অন্যান্য কবুতরের ১২ টির তুলনায় ১৬ টি লেজের পালক থাকবে। এরা ৭৪ সেন্টিমিটার (২৯ ইঞ্চি ) লম্বা এবং ২-২.৫ কেজি ওজন পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ব্রোঞ্জউইং কবুতরঃ
ব্রোঞ্জউইং অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায়। এরা মাঝারি আকারের কবুতর। এদের পুরুষের হলুদ-সাদা কপাল এবং গোলাপী স্তন থাকে।
স্পিনিফেক্স কবুতরঃ
স্পিনিফেক্স কবুতর, জিওপ্যাফস একটি পাখি হিসাবে পরিচিত যা অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়। এদের প্রায়শই জোড়া বা দলবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। এরা অন্যান্য প্রজাতির থেকে তুলনামূলক ভাবে ছোট। এদের দৈর্ঘ্য ২০ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার (৮ থেকে ৯.৬ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ওল্ড ডাচ কাপুচিন কবুতরঃ
ওল্ড ডাচ ক্যাপুচিন কবুতর হল নেদারল্যান্ডসের দেশীয় অভিনব কবুতরের একটি জাত। এরা ছোট থেকে মাঝারি আকারের সুন্দর কবুতর। এরা সাধারনত গৃহে পালিত হয়।
আফ্রিকান গ্রীন কবুতরঃ
আফ্রিকান সবুজ কবুতর (ট্র্যারন ক্যালভাস) কলম্বিদে পরিবারে পাখির একটি প্রজাতি। এরা যে কোন জায়গায় ফল বা খাদ্যের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। উপ-সাহারান আফ্রিকাতে এই সুন্দর কবুতর বিস্তৃত আছে।
নীল ক্রাউনড কবুতরঃ
নীল মুকুটযুক্ত পায়রা হলো বৃহত্তম কবুতর। এরা প্রায় ২.৫ কেজি ওজন পর্যন্ত হয়। নীল মুকুটযুক্ত কবুতরের নীল স্তন এবং নীল ক্রেস্ট দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এরা উত্তর-পশ্চিম নিউ গিনির নিম্নভূমি রেইন ফরেস্টের বসবাসকারী সুন্দর কবুতর।
কবুতরের গুরুত্ব, Importance of pigeon
কবুতর প্রকৃতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বীজ বিচ্ছুরণকারী , কারণ তারা বিভিন্ন ধরণের বীজ গ্রহণ করে এবং তারপর তাদের বিষ্ঠার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়, বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্ভিদের জনসংখ্যা পুনরুত্থিত করতে সহায়তা করে। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় কবুতর শিকারীদের খাদ্যের উৎস হিসেবেও কাজ করে।
কবুতর কি বাড়ির জন্য শুভ? Are pigeons auspicious for the home?
কবুতর যখন স্বাভাবিকভাবে এসে আপনার বাড়িতে বাসা বাঁধে, তখন তা শুভ বলে মনে করা হয় । বাস্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে বাড়িতে পাখির আগমন জীবনের ভাগ্যের উন্নতি বোঝায়।
অনেকে আবার একে অশুভ বলেও দাবি করেন, তাই কবুতর বাড়িতে বাসা বাঁধলে তা অপসারণ করে দেন। কিছু সংস্কৃতিতে, পায়রা শান্তি, ভালবাসা এবং সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। অন্যদের মধ্যে, তাদের বার্তাবাহক বা সুরক্ষার প্রতীক হিসাবে দেখা যেতে পারে। তবে একটি কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই ব্যাখ্যাগুলি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করা, যার সর্বাপেক্ষা সর্বজনীন তাৎপর্য নাও থাকতে পারে।
পরিশেষে, To conclude
কবুতর একটি শান্ত প্রকৃতির পাখি। এটি বিভিন্ন স্থানে কবুতর বা পায়রা বা কপোত বা পারাবত ইত্যাদি নামে পরিচিত। আশা করি এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা কবুতর সম্পর্কে বেশ কিছু নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন।
Frequently Asked Questions
Columba livia domestica।
ককসিডিওসিস বা পাতলা চুনযুক্ত পায়খানা, সালমোনেলা, রানিক্ষেত পি এমভি/নিউ ক্যাসল ডিজিজ, কৃমি, ক্যাংকার বা মুখে ঘা, ক্রনিক রেসপিরেটরি ডিজিজ সি আর ডি, পক্স, বার্ড ফ্লু ইত্যাদি রোগ
প্রায় ৪-৫ দিন পর।