ঘূর্ণিঝড়ের কারণ ও ফলাফল, Causes and effects of Cyclones in Bengali

ঘূর্ণিঝড়ের কারণ ও ফলাফল

ঘূর্ণিঝড় হলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় বা বায়ুমন্ডলীয় একটি উত্তাল অবস্থা যা বাতাসের প্রচন্ড ঘূর্ণায়মান গতির ফলে সংঘটিত হয়। এটি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের একটি। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বহুবার এইরূপ ঝড়ের কবলে পড়ে বিভিন্ন এলাকা ভয়াবহ ক্ষতি সাধন হয়েছে। আজকের প্রতিবেদনে আমরা ঘূর্ণিঝড়ের কারণ ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা করবো।

ঘূর্ণিঝড় বলতে কি বুঝ? What do you mean by cyclone?

ঘূর্ণিঝড় বা ঘূর্ণিবাত্যা হল ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সংবলিত আবহাওয়ার একটি নিম্ন-চাপ প্রক্রিয়া যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে। এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়।

ঘূর্ণিঝড়

ঘূর্ণিঝড় কেন সৃষ্টি হয় ? Why do cyclones occur?

জল কম চাপের একটি এলাকার চারপাশে ঘোরে, যাকে প্রযুক্তিগত শব্দ চোখ বলা হয়। চোখ এই ঝড়ের ঠিক কেন্দ্রে থাকে এবং ঘূর্ণায়মান ঝড়ের বাইরের অংশগুলি প্রচুর বাতাস এবং বৃষ্টিপাতের জন্ম দেয়।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণ হল গরম বাতাসের ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং চারপাশের শীতল বাতাস দ্বারা শূন্যস্থান পূরণ করা ।

ঘূর্ণিঝড় কত প্রকার? What are the types of cyclones?

ঘূর্ণিঝড়ের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে: গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, মেরু ঘূর্ণিঝড়, মধ্য-অক্ষাংশের ঘূর্ণিঝড় এবং মেসোসাইক্লোন । গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় হল ঘূর্ণিঝড় শব্দটি শুনলে বেশিরভাগ লোকেরা যা মনে করে।

আটলান্টিক এবং পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এদেরকে হারিকেন এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে টাইফুন বলা হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রতিশব্দ জেনে নিন, Know the synonyms of Cyclone :

ঘূর্ণিঝড়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘সাইক্লোন’। উক্ত শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘কাইক্লোস’ (Kyklos) থেকে এসেছে, যায় অর্থ কুন্ডলী পাকানো সাপ। ঘূর্ণিঝড়ের উপগ্রহ চিত্র দেখলে এই নামকরণের যথার্থতা বোঝা যায়।

ব্রিটিশ-ভারতীয় বিজ্ঞানী ও আবহাওয়াবিদ হেনরী পিডিংটন ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত সামুদ্রিক দুর্যোগ বিষয়ক পুস্তক The Sailor’s Horn-book for the Law of Storms -এ প্রথমবারের মতো সাইক্লোন শব্দটি ব্যবহার করেন।

মহাদেশভেদে ঘূর্ণিঝড়ের বিভিন্ন নাম, Different names of cyclones all around the world :

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়কে আমেরিকা মহাদেশে ‘হারিকেন’, দূরপ্রাচ্যে ‘টাইফুন’, দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে বলা হয় সাইক্লোন এবং বাংলায় ঘূর্ণিঝড়। পাশ্চাত্যে হারিকেনকে মানুষের নামেও চিহ্নিত করা হয়। বাংলায় এর আরেকটি প্রচলিত নাম ‘তুফান’ যা চীনা শব্দ ‘টাইফুন’ থেকে এসেছে।

ঘূর্ণিঝড় সাধারণত গভীর সমুদ্রে সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশসমূহ বিমান থেকে নিরীক্ষণ এবং ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সরাসরি অনুসন্ধানকর্ম পরিচালনা করে থাকে। সম্প্রতি সাধারণত উন্নত ও অনুন্নত দেশসমূহে ঘূর্ণিঝড় পরীক্ষা-নিরীক্ষণ এবং অনুসন্ধানকর্মের সূত্রপাত ঘটেছে।

অন্যান্য গ্রহেও ঘূর্ণিঝড় হয়, Cyclones occur in other planets also :

Wizard's Eye

ঘূর্ণিঝড় শুধু পৃথিবীতেই হয় যে এমনটা নয়, বরং এই ধরনের ঝড় অন্য গ্রহগুলোতেও দেখা যায়। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে- নেপচুনের ছোট কালো স্পট, যা জাদুকরের চোখ (Wizard’s Eye) হিসাবেও পরিচিত। উক্ত কালো স্পটটির ব্যাস হল গ্রেট ডার্ক স্পটের এক তৃতীয়াংশ। এটি দেখতে ঠিক যেন একটি চোখের মত, তাই এটার নাম “জাদুকরের চোখ”।

অন্যদিকে মঙ্গল গ্রহেও ঘূর্ণিঝড় দেখা যায়, যার নাম হল মহা লাল বিন্দু।

ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য দুর্যোগসমূহ, Notable Disasters Caused by Cyclone :

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ঘূর্ণিঝড়ে সবচাইতে বেশি লোক নিহত হয়েছিল ১৯০০ সালে টেক্সাসের গ্যালভেস্টন উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ে। প্রায় দশ হাজার লোক এতে নিহত হয়েছিল।

লুইজিয়ানা-মিসিসিপি উপকূলে আঘাত হানা বিখ্যাত হারিকেন ক্যাটরিনা ছিল সম্পদের ক্ষতি হিসাবে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঘূর্ণিঝড়। প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ এতে ধ্বংস হয়েছিল, যদিও ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬০০।

বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রায় ৩ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ লোক মৃত্যু হয়।

আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে ১৫৮২ সালের বাকেরগঞ্জ তথা বর্তমান বরিশালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা যায়, যেটিতে প্রায় ২ লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল।

ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কারণগুলো কি ? What are the causes of cyclones ?

ঘূর্ণিঝড়ের কারণ হল গরম বাতাসের ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং চারপাশের শীতল বাতাস দ্বারা শূন্যস্থান পূরণ করা। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কারণগুলোর ব্যাখ্যায় বলা যায় :

ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির কারণ

সমুদ্রের তাপমাত্রা :

সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬-২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকলে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একটি নির্দিষ্ট গভীরতা (কমপক্ষে ৫০ মিটার)পর্যন্ত এ তাপমাত্রা থাকতে হয়, তবেই ঝড়ের সৃষ্টি হয়। এজন্য কর্কট ও মকর ক্রান্তিরেখার কাছাকাছি সমুদ্র গুলিতে গ্রীষ্মকালে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়।

নিরক্ষরেখা থেকে দূরত্ব :

নিরক্ষীয় অঞ্চলগুলোতে গ্রীষ্মকালে পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে যায়। এর ফলে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। বায়ুর এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য মেরু অঞ্চল থেকে শীতল বায়ু উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণে নিরক্ষরেখার দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়।

তবে পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রভাবে সৃষ্ট করিওলিস শক্তির প্রভাবে এই বায়ু সোজাসুজি প্রবাহিত হয় না, বরং উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বায়ু পথ বেঁকে যায়। নিরক্ষরেখার ০ ডিগ্রী থেকে ৫ ডিগ্রীর মধ্যে কোন ঘূর্ণিঝড় হতে দেখা যায় না। সাধারণত, নিরক্ষরেখার ১০ ডিগ্রী থেকে ৩০ ডিগ্রীর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়।

বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা :

বায়ুমন্ডলের নিম্ন ও মধ্যস্তরে অধিক আর্দ্রতা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

বিরাজমান বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি :

ঘূর্ণিঝড় স্বতস্ফুর্তভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। সমুদ্রে পূর্ব থেকেই বিক্ষুব্ধ কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, ঘূর্ণিঝড় সাধারণত সেটাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। অন্যদিকে, পশ্চিমমুখী নিম্ন বায়ুচাপসম্পন্ন স্রোত আবহাওয়ায় উচ্চতার সাথে সাথে বায়ুর গতি ও দিকের স্বল্প পরিবর্তন এবং দ্রুত শীতলীকরণের ফলে নির্গত তাপ ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব

ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বিপদ কি কি? What are the dangers caused by cyclones?

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাসস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, গাছ ইত্যাদির ক্ষতি করতে পারে যার ফলে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ভারী এবং দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টির কারণে নদী বন্যা এবং বৃষ্টির কারণে নিচু এলাকা তলিয়ে যেতে পারে এবং জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়ের ১০টি ক্ষতিকর প্রভাব? 10 harmful effects of cyclone?

  • ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রবল বন্যা, ভূমিধস এবং নদী উপচে পড়ে মানুষের জীবন ও আশেপাশের পরিবেশকে প্রভাবিত করে।
  • ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবগুলি হল অবকাঠামোর ক্ষতি, প্রাণহানি, গাছ উপড়ে ফেলা, উপকূলীয় অঞ্চলগুলি বন্যার সংস্পর্শে আসা, মাটি ক্ষয় করা ইত্যাদি।
  • ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কখনও কখনও বহু মানুষ প্রাণ হারায়।
  • ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় বিপজ্জনক হতে পারে। তারা চরম বাতাস, বন্যার সাথে ভারী বৃষ্টিপাত এবং ক্ষতিকর ঝড়ের জলোচ্ছ্বাস তৈরি করতে পারে যা নিম্ন-উপকূলীয় অঞ্চলগুলিকে প্লাবিত করতে পারে ।
  • ঘূর্ণিঝড় পরিবহন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করতে পারে এবং ফসলের ক্ষতি করতে পারে, যার ফলে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয় এবং দাম বৃদ্ধি পায় ।
  • ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবগুলি ভোক্তাদের ব্যয় এবং ব্যবসায়িক কার্যকলাপ হ্রাস করতে পারে, যা মানুষের জীবিকাকে প্রভাবিত করতে পারে।
  • ঘূর্ণিঝড় জল দূষিত করে যা ব্যাপক রোগ ও প্রতিকূল স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে।
  • ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রবল বন্যা, ভূমিধস এবং নদী উপচে পড়ে মানুষের জীবন ও আশেপাশের পরিবেশকে প্রভাবিত করে।
  • ঝড়ের জলোচ্ছ্বাস সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করে বন্যার ফলে সামুদ্রিক এবং প্রাণীজগতের ক্ষতি হয় এবং উপকূলীয় অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
  • ঘূর্ণিঝড় কখনও কখনও টর্নেডোর দিকে পরিচালিত হয়, তা নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলিকে ধ্বংস করে দিতে পারে যা পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকর প্রভাব

শেষ কথা, Conclusion :

একটি অঞ্চলে সৃষ্ট নিম্নচাপের ফলে একটি কেন্দ্রাভিমুখী ঘূর্ণায়মান প্রচন্ড বায়ুপ্রবাহ থেকেই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়। আশা করি উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আপনারা ঘূর্ণিঝড়ের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।

Contents show

RIma Sinha

Rima Sinha is working as a writer and also as a journalist. she got her bachelor of arts degree from Tripura University. She has also completed Master of Arts in Journalism and mass communication from Chandigarh University.

Recent Posts