বাবা আমাদের জীবনে এমন একজন মানুষ যিনি নিজের কথা না ভেবে আগে পরিবারের কথা ভাবেন। পৃথিবীর সকল বাবা-ই নিজের সন্তানের কাছে সুপার হিরো। পিতা এবং পিতৃত্বের প্রতি সম্মান জানাতে “বাবা দিবস” পালন করা হয়। অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন তারিখে এটি পালিত হয়, তবে দিবসটি উৎযাপন করার নেপথ্যে কারণটি সর্বত্র একই। প্রতিটি মানুষের জীবনে তাদের মা-বাবাই সবচেয়ে আপনজন। বাবার প্রতি ভালোবাসা জানাতে সারাবিশ্বেই পালিত হয় দিনটি।
বাবা দিবসের গুরুত্ব, Importance of Father’s Day :
একজন বাবা সারাটি জীবন ব্যয় করেন সন্তানদের পেছনে, নিজের পরিবারের পেছনে। সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই দেশে দেশে বাবা দিবস পালিত হয়।
বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই দিবসটি পালন করার প্রথা শুরু হয়েছে। ‘বাবা’ এমন একজন, যার হাত ধরে হাঁটতে শেখা, পৃথিবীর কঠিন পথে চলতে শেখা। বাবাদের কথা উঠলেই মাথায় আসে শত ত্যাগ স্বীকার করা নিঃস্বার্থ এক মানুষের কথা।
বাবার কাছে সন্তানের যে ঋণ, তা কখনই পূরণ করা সম্ভব নয়। তবু ভালোবাসার প্রতিদানে শুধুমাত্র বাবাদের জন্য রয়েছে এক বিশেষ দিন – তা হল বাবা দিবস। এক কথায় বলতে গেলে, বাবা দিবস শিশুদের জন্য, তাদের পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর একটি বিশেষ দিন।
ছোটবেলা থেকে যিনি শত আবদার পূরণে আমাদের হাজারও উপহার দিয়ে আসছেন, সেই বাবার জন্য এই বিশেষ দিনে বাচ্চাদের সেরা উপহার দেওয়ার সুযোগ থাকে। তবে উপহার ছোটো হোক কিংবা বড়, পৃথিবীর সব সন্তানেরা বাবার জন্য কিছু করতে পারলে, আনন্দ পায় অনেক।
সন্তানের জীবনে বাবার ভূমিকা, Father’s role in child’s life:
বাবারা হল পরিবারের মেরুদণ্ড এবং আমাদের শক্তির স্তম্ভ। আমাদের বাবা আমাদের পরামর্শদাতা, গাইড, শক্তি, বন্ধু এবং চিয়ারলিডার। বলতে গেলে বাবা হিসেবে তিনি বহু ভূমিকা পালন করেন নিজের সন্তানদের জীবনে।
বাবারা পরিবারের নায়ক, আত্মবিশ্বাসের স্তম্ভ এবং নিঃসন্দেহে প্রয়োজনের সময় কান্নার কাঁধ। একজন বাবা শিশুদের জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে, নৈতিকতা প্রদানে এবং সম্ভাব্য প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদানে বড় ভূমিকা পালন করে।
বাবা দিবসের প্রচলন, Traditions of Father’s Day: :
অনেকের মতে বাবা দিবস পালন শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯০৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় একটি চার্চে দিনটির প্রচলন হয়।
অন্যদিকে কিছু কিছু মানুষের মতে, ওয়াশিংটনের ভ্যাংকুভারে প্রথম বাবা দিবস পালন করা হয়। তবে বিভিন্ন মতভেদের মাঝেও মনে করা হয় যে, বাবা দিবসের প্রবক্তা সনোরা স্মার্ট ডোড। যখন সনোরার বয়স ১৬, তখন তার মা ষষ্ঠ সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। সেই পরিবারে সনোরাই ছিলেন একমাত্র কন্যা।
পূর্ব ওয়াশিংটনের এক গ্রামের ফার্মে ডোডের বাবা নবজাতকসহ তার পাঁচটি সন্তানকে একা মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ক্রমে সনোরা বড় হয়ে অনুভব করলেন যে ছয়টি সন্তানকে একা মানুষ করতে কী ভীষণ পরিশ্রমই না করতে হয়েছে তার বাবাকে।এভাবে বাবা উইলিয়াম নিজের মেয়ের চোখে হয়ে উঠেছিলেন সাহসী, নিঃস্বার্থ একজন ভালো বাবা, যিনি সন্তানদের জন্য নিজের সব সুখ-শখ, আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছিলেন।
বাবাকে সম্মান জানাতে ‘বাবা দিবস’ ঘোষণা করার বিষয়টি নিয়ে সনোরা চিন্তা করেন ১৯০৯ সালে। সে বছর ‘মা দিবস’-এর অনুষ্ঠানে চার্চে যান সনোরা ডোড। সেখান থেকে এসে তিনি ভাবেন যে, বাবাদের জন্যও একটি দিবস উৎযাপন করা প্রয়োজন, যেখানে বাবাদেরও সম্মান জানানো হবে।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের স্পোকেন মন্ত্রিসভার কাছে বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে তাঁর পিতার জন্মদিন ৫ জুনকে ঘোষণা করার প্রস্তাব পাঠান সনোরা। মন্ত্রিসভা তার এই প্রস্তাবের প্রশংসা করলেও, ৫ জুনকে বাবা দিবস ঘোষণা করতে রাজি হয়নি; বরং তারা জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকেই এই দিনটি উৎযাপন করা শুরু হয় “বাবা দিবস” হিসেবে।
বাবা দিবস উৎযাপনের তারিখ, Dates of Father’s Day Celebration: :
বিশ্বের কয়েকটি দেশ ভিন্ন মাসের ভিন্ন তারিখে বাবা দিবস পালন করলেও, বিশ্বের একটি বিশাল অংশ যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চিলি, কলাম্বিয়া, কোস্টারিকা, কিউবা, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, জ্যামাইকা, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়েসহ আরও কিছু দেশে জুনের তৃতীয় রোববার এ বিশেষ দিনটি পালিত হয়।
আফ্রিকান ঐতিহ্য অনুযায়ী বাবা দিবস পালন, Celebration of Father’s Day According to African Traditions :
- মিশর : মিশরে প্রতি বছর 21 জুন বাবা দিবস পালিত হয়।
- মোজাম্বিক : মোজাম্বিকে , প্রতি বছর ১৯ মার্চ বাবা দিবস পালন করা হয়।
- সেশেলস : সেশেলে , ১৬ জুন বাবা দিবস উদযাপিত হয়।
- দক্ষিণ সুদান : দক্ষিণ সুদানে, আগস্ট মাসের শেষ সোমবার বাবা দিবস পালিত হয়।
- সুদান : সুদানে ২১ জুন বাবা দিবস পালিত হয়।
- আফ্রিকান ঐতিহ্য অনুযায়ী যে সব দেশে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস উদযাপন করা হয়, সেগুলির নাম হল: আলজেরিয়া, কেনিয়া, মরক্কো, নাইজেরিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা, তানজানিয়া
এশিয়ান ঐতিহ্য অনুযায়ী বাবা দিবস পালন, Celebration of Father’s Day According to Asian Traditions :
- বাংলাদেশ : বাংলাদেশে বাবা দিবস উদযাপনের কোনো ঐতিহাসিক ঐতিহ্য নেই। প্রধানত পশ্চিমা প্রভাব দ্বারা এদেশে বাবা দিবস উৎযাপন বিষয়টি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এদেশে একটি জনপ্রিয় বাক্যাংশ রয়েছে: “প্রতিদিনই বাবা/মা দিবস, তাই আপনি প্রতিদিন আপনার পিতামাতাকে ভালোবাসবেন।”
- চীন : গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে, আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস পালনের কোনো ঐতিহ্য নেই। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্য অনুযায়ী জুন মাসের তৃতীয় রবিবার অনেকে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন। উদাহণস্বরূপ হংকংয়ে, এটি জুনের তৃতীয় রবিবার উদযাপিত হয়। তাছাড়া ম্যাকাওতে , ফাদার্স ডে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার পালিত হয়।
- ভারত : ভারতে পশ্চিমা বিশ্বের অনুসরণ করে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালন করা হয়। ভারতে, দিনটিতে বাচ্চারা তাদের বাবাকে গ্রিটিং কার্ড, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, শার্ট, কফি মগ বা বইয়ের মতো উপহার দেওয়ার মাধ্যমে বাবা দিবস পালন করে।
- ইন্দোনেশিয়া : ইন্দোনেশিয়ায় , ১২ নভেম্বর বাবা দিবস উদযাপিত হয়।
- মঙ্গোলিয়া : মঙ্গোলিয়ান মেনস অ্যাসোসিয়েশন ২০০৫ সালের ৮ আগস্ট বাবা দিবস উদযাপন শুরু করে।
- নেপাল : নেপালের হিন্দুরা এবং নেভাররা কুশে আউন্সি দিনে পিতাদের সম্মান করে , যা আগস্টের শেষের দিকে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে ঘটে। অন্যদিকে হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে, উৎসবটি ভাদ্র মাসের অমাবস্যার দিন উৎযাপিত হয়।
- দক্ষিণ কোরিয়া : দক্ষিণ কোরিয়ায় , পিতামাতা দিবস ৮ মে পালিত হয়।
- সংযুক্ত আরব আমিরাত : সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ২১ জুন বাবা দিবস পালিত হয়।
- থাইল্যান্ড : থাইল্যান্ডে , পিতা দিবস পালন করা হয় ৫ ডিসেম্বর তারিখে, প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের জন্মদিন উপলক্ষ্যে এই দিনটি পিতৃ দিবস হিসেবে পালিত হয়। থাইল্যান্ডে, বাবা দিবস, একই জাতীয় সরকারি ছুটির দিন।
- তাইওয়ান : তাইওয়ানে , বাবা দিবস বছরের অষ্টম মাসের অষ্টম দিনে পালন করা হয় ।
- এশিয়ান ঐতিহ্য অনুযায়ী যে সব দেশে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস উদযাপন করা হয়, সেগুলির নাম হল: জাপান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা।
শেষ কথা, Conclusion :
বাবা দিবস বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। কেউ কেউ বাবাকে ভালো কিছু উপহার দিয়ে এদিন উৎযাপন করেন। অন্যদিকে কেউ বাবার সাথে ভালো সময় কাটিয়ে দিনটি পালন করার চেষ্টা করেন।
কোনো কোনো ব্যক্তি কেক কাটা এবং ভালো খাওয়া-দাওয়ার মধ্যদিয়ে দিনটিকে বিশেষভাবে উৎযাপনের প্রচেষ্টা রাখেন। তবে যেভাবেই পালন করা হোক না কেন, বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা জরুরি, কারণ বাবার দৌলতেই আমরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত উপযুক্ত হতে পারি।
Frequently Asked Questions :
ইউনাইটেড কিংডম জুন মাসে বাবা দিবস উদযাপন করে। কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রীস এবং আরও অনেক দেশের মতো, জুন মাসের তৃতীয় রবিবার লোকজন বাবা দিবসের বার্তা, উপহার এবং কার্ড নিজের বাবাকে পাঠায়।
বাবার প্রতি ভালোবাসা জ্ঞাপন করা এবং আমাদের জীবনে বাবার ভূমিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর বিশেষ দিন হল বাবা দিবস।
এক বার।