বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল হল ফেনী জেলা। একসময়ে এই জেলা বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার অংশ ছিল। ২০১১ সালের জনশুমারী অনুযায়ী এই অঞ্চল চট্টগ্রাম বিভাগের নবম জনবহুল জেলা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। ফেনী শহর হল ফেনী সদর উপজেলার মূখ্য প্রশাসনিক কেন্দ্র।
ফেনী জেলার নামকরণ, Naming of Feni district :
ফেনী নদীর নামানুসারে এ অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে ফেনী। একটি বিশেষ নদীর স্রোতধারা ও ফেরী পারাপারের ঘাট হিসেবে মধ্যযুগে কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় ফনী শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতকে মির্জা নাথানের ফার্সী ভাষায় রচিত বাহরিস্তান-ই-গায়েবীতে ফনী শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে ফেনী-তে পরিণত হয়। তাই ধারণা করা হয় আদি শব্দ ফনী কবি ও সাহিত্যিকদের ভাষায় ফেনীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
ফেনী জেলা উপজেলাগুলোর নাম, Names of Feni district upazilas :
১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর এর পূর্ব অবধি এটি বৃহত্তর নোয়াখালী এবং কুমিল্লার কিছু অংশ সহ নোয়াখালীর একটি মহকুমা হিসেবে পরিচিত ছিল। এরপর এটি জেলায় রূপান্তরিত হয়। ফেনী বাংলাদেশের ৬৪তম জেলা। উক্ত জেলার উপজেলা সংখ্যা ৬টি; সেগুলো হলো: সোনাগাজী, ফুলগাজী, পরশুরাম, দাগনভূঞা, ছাগলনাইয়া এবং ফেনী সদর।
ফেনী জেলার জনসংখ্যা, Population of Feni District :
২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী, ফেনী জেলার মোট জনসংখ্যা ১৪,৯৬,১৩৮। জেলার জনঘনত্ব ১,৬০০/বর্গকিমি (৪,২০০/বর্গমাইল)।
ফেনী জেলার আয়তন ও অবস্থান, Area and Location of Feni District :
ফেনী জেলার মোট আয়তন ৯২৮.৩৪ বর্গ কিলোমিটার। ফেনী জেলার অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ২২°৪৪´ থেকে ২৩°১৭´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১৫´ থেকে ৯১°৩৫´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে। দেশের রাজধানী ঢাকা থেকে উক্ত জেলার দূরত্ব প্রায় ১৫১ কিলোমিটার। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদর থেকে এটি প্রায় ৯৭ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এই জেলার উত্তর দিকে রয়েছে কুমিল্লা জেলা এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণ দিকে আছে নোয়াখালী জেলা ও চট্টগ্রাম জেলা, ফেনীর পূর্ব দিকে আছে ভারতের ত্রিপুরা এবং পশ্চিম দিকে নোয়াখালী জেলা অবস্থিত।
ফেনী জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা, Education System of Feni District :
ফেনী জেলার সাক্ষরতার হার ৫৯.৬০%। জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা নিম্নরূপ :
- বিশ্ববিদ্যালয় : ১টি
- ডিগ্রী কলেজ : ১১টি
- উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ : ১০টি
- ক্যাডেট কলেজ : ১টি (বালিকা)
- কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : ৭টি
- কম্পিউটার ইনস্টিটিউট : ১টি
- মাদ্রাসা : ৯৭টি
- মাধ্যমিক বিদ্যালয় : ১৫৫টি
- শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র : ১টি
- নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় : ১৯টি
- পিটিআই : ১টি
- প্রাথমিক বিদ্যালয় : ৫২৮টি
ফেনী জেলার অর্থনীতি, Economy of Feni district :
বাংলাদেশের ফেনী জেলায় বসবাসকারী জনগণের প্রধান পেশা কৃষি। এই অঞ্চলের অনেকেই প্রবাসী। এ জেলার অর্থনীতির অন্যতম দিকগুলো হল-
- কৃষি ২১%,
- অকৃষি শ্রমিক ২.৫৭%,
- শিল্প ৩৫%,
- ব্যবসা-বাণিজ্য ১৫.৯৮%,
- পরিবহন ও যোগাযোগ ৪.৬৬%,
- নির্মাণ ১.৮%,
- ধর্মীয় সেবা ০.৪৩%,
- ভাড়া এবং রেমিট্যান্স ১১.৪৩%
- অন্যান্য ১২.১৯%।
ফেনী জেলায় মূলত দুটি শিল্প এলাকা রয়েছে। এখানকার মোট বৃহৎ শিল্পের সংখ্যা ৪টি। মাঝারি শিল্প ১৪টি। ক্ষুদ্র শিল্প ৮২৬টি। কুটির শিল্প ৩৪১৯টি। এছাড়াও ফেনী সদর এলাকার অন্তর্গত ধালিয়া ইউনিয়নে একটি গ্যাসক্ষেত্রও রয়েছে। এই অঞ্চলের কৃষি জমির পরিমাণ ৭৫,৯২২ হেক্টর। অন্যদিকে আবাদি জমির পরিমাণ ৭৪,৭২০ হেক্টর।
ফেনী জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা, Communication System of Feni District :
বাংলাদেশের ৬৪ নং জেলা, অর্থাৎ ফেনী জেলায় যোগাযোগের জন্য প্রধান সড়ক হল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক; এছাড়াও আছে ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়ক। উক্ত সড়কগুলোতে সব ধরনের যানবাহনের চলাচল রয়েছে। এছাড়া এ জেলার অন্য জেলাগুলোর সাথে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে।
ফেনী জেলার স্বাস্থ্য পরিষেবা, Health Services of Feni District :
- ফেনী জেলায় ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ১টি আধুনিক হাসপাতাল রয়েছে,
- ৫০ শয্যা বিশিষ্ট ২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্স রয়েছে,
- ৩১ শয্যা বিশিষ্ট ৩টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্স রয়েছে,
- ১০ শয্যা বিশিষ্ট ১টি হাসপাতাল(মঙ্গলকান্দি) রয়েছে,
- ১টি হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল আছে,
- ১টি ডায়াবেটিক হাসপাতাল রয়েছে,
- ১টি বক্ষ ব্যাধি ক্লিনিক আছে,
এছাড়াও আছে ট্রমা সেন্টার, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ৩৩টি ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। অন্যদিকে ১১৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে এই জেলায়।
ফেনী জেলার প্রধান নদ-নদীর নাম, Names of major rivers in Feni district :
ফেনী জেলার প্রধান প্রধান নদীগুলো হল :
- ফেনী নদী,
- মুহুরী নদী,
- ছোট ফেনী নদী,
- কহুয়া নদী,
- সিলোনিয়া নদী
- কালিদাস পাহালিয়া নদী।
ফেনী জেলার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান সমূহ, Places to visit in Feni District :
- ফেনী নদী
- ফেনী বিমানবন্দর
- মুহুরী প্রজেক্ট
- শমসের গাজীর কেল্লা
- বিজয় সিংহ দীঘি
- রাজাঝির দীঘি
- চাঁদগাজী ভূঁইয়া মসজিদ
- শর্শাদী শাহী মসজিদ
- মোহাম্মদ আলী চৌধুরী মসজিদ
- প্রতাপপুর জমিদার বাড়ি
- বাঁশপাড়া জমিদার বাড়ি
- কালীদহ বরদা বাবু জমিদার বাড়ি
- সেনেরখিল জমিদার বাড়ি
- শিলুয়া মন্দির
- সাত মঠ
- ভারত-বাংলাদেশ প্রীতি রাধানগর-কৃষ্ণনগর সীমান্ত হাট
- কৈয়ারা দীঘি
- জগন্নাথ মন্দির ও জয় কালী মন্দির
- ভাষা শহীদ সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর
ফেনী জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব সমূহের নাম ও পেশা, Names and professions of prominent personalities of Feni district :
- খালেদা জিয়া – রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের সাবেক এবং প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী।
- শমসের গাজী – জমিদার, ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী।
- আবদুস সালাম – ভাষা শহীদ।
- জহির রায়হান – ভাষা সৈনিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার।
- আওরঙ্গজেব চৌধুরী – বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রাক্তন প্রধান।
- আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রাক্তন উপাচার্য।
- আবদুল আউয়াল মিন্টু – এফবিসিসিআই সাবেক প্রেসিডেন্ট, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বাংলাদেশী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।।
- ওবায়েদ উল হক – কবি, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, গীতিকার
- আবদুস সালাম – বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম মহাপরিচালক।
- আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী – বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রাক্তন উপাচার্য।
- আমিন আহমদ – প্রাক্তন বিচারপতি।
- এ এফ রহমান – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।
- আমীন আহম্মেদ চৌধুরী – বীর বিক্রম খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
- ইনামুল হক – অভিনেতা, লেখক এবং নাট্যকার।
- এ বি এম মূসা – সাংবাদিক এবং বাংলাদেশী প্রাক্তন সংসদ সদস্য।
- ওয়াসফিয়া নাজরীন – পর্বতারোহী, এভারেস্ট বিজয়ী দ্বিতীয় বাঙালি নারী।
- কাইয়ুম চৌধুরী – চিত্রশিল্পী।
- কাজী এবাদুল হক – ভাষা সৈনিক এবং প্রাক্তন বিচারপতি।
- খাজা আহমেদ – মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,বাংলাদেশী প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
- মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন – ব্যবসায়ী,শিল্পপতি,প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।।
- মাহবুবুল আলম তারা – প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
- জয়নাল হাজারী – বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশী প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
- জয়নাল আবেদিন – বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশী প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
- জাফর ইমাম – বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশী প্রাক্তন মন্ত্রী,প্রাক্তন সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
- নিজাম উদ্দিন হাজারী – সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
- মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী – প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা, সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
- রহিম উল্লাহ – প্রাক্তন সংসদ সদস্য।
- জাহান আরা বেগম সুরমা – রাজনীতিবিদ।
- নজির আহমেদ – ছাত্রনেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিনি প্রথম শিকার।
- মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন – ক্রিকেটার।
- আবদুস সালাম (বীর বিক্রম) -বীর মুক্তিযোদ্ধা।
- রবিউল হক – বীর বিক্রম খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা
ফেনী জেলার সাথে জড়িত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস :
ফেনী সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে শুভপুর ও বিলোনিয়া যুদ্ধ অন্যতম। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ফেনী জেলার অবদান, ফেনীর সূর্যসন্তানদের অবদান অনস্বীকার্য।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে তিন দিক থেকে ফেনীর রয়েছে সীমান্ত। ফলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ফেনীতে ব্যাপক অত্যাচার নিপীড়ন চালায়।
বিলোনিয়া যুদ্ধ একটি অনন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। পাক হানাদাররা ৫ ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে গেলে ৬ ডিসেম্বর ফেনী হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর দিনটিকে ফেনী জেলাবাসী ফেনী মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ফেনীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।
ফেনী জেলার থানা কয়টি ও কি কি? How many and what are the police stations in Feni district?
ফেনী জেলার মোট ৬ টি থানা সমূহ হলো:
- ছাগলনাইয়া থানা,
- ফেনী সদর থানা,
- সোনাগাজী থানা,
- ফুলগাজী থানা,
- পরশুরাম থানা,
- দাগনভূঞা থানা।
ফেনী কিসের জন্য বিখ্যাত? What is Feni famous for?
ফেনী ঐতিহাসিকভাবে বহু প্রাচীন প্রাসাদের মতো ঐতিহ্যবাহী খাবার ও ঐতিহ্যের জন্য সমৃদ্ধ। এই জেলাটি বিভিন্ন ধরণের অনন্য এবং সুস্বাদু খাবারের জন্যও বিখ্যাত এবং খন্দোল মিষ্টি তার মধ্যে একটি যার বয়স প্রায় 50 বছর।
ফেনী জেলার বিখ্যাত খাবার কি? What is the famous food of Feni district?
খন্ডলের মিষ্টি বাংলাদেশের ফেনী জেলার খন্ডল নামক স্থানে উৎপন্ন একটি মিষ্টি যা ফেনী অঞ্চলে বিখ্যাত এবং খুবই জনপ্রিয়। এটি মূলত রসগোল্লার একটি ভিন্ন সংস্করণ। এ মিষ্টিটির বিশেষত্ব হল বাংলাদেশের অন্যান্য সব মিষ্টি ঠান্ডা বা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় খাওয়া হলেও খন্ডলের মিষ্টি ঠান্ডা খাওয়ার পাশাপাশি গরম গরমও খাওয়া হয়।
শেষ কথা, Conclusion :
ফেনী জেলা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আশা করি এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা ফেনী জেলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরেছেন।
Frequently Asked Questions :
ফেনী নদী।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।
১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর