বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তন আজ আমাদের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উষ্ণতা বাড়ছে, বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতর হচ্ছে—সব মিলিয়ে মানব সভ্যতা এক গভীর সংকটে। এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতেই বিজ্ঞানীরা বারবার নতুন নতুন পথ খুঁজে চলেছেন। সম্প্রতি এমনই এক অভিনব পরিকল্পনা সামনে এসেছে, যা প্রথমে শুনতে কিছুটা অবাস্তব মনে হলেও, গবেষণার ভিত্তিতে তা যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। পরিকল্পনাটি হল—পৃথিবীর উষ্ণতা কমাতে বায়ুমণ্ডলে প্রতি বছর ছড়ানো হবে প্রায় ৫০ লাখ টন হিরার গুঁড়ো!
কী এই পরিকল্পনা?
এই পরিকল্পনাটি মূলত একটি বিশেষ প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি—স্ট্রাটোস্ফিয়ারিক অ্যারোসল ইনজেকশন। এটি ‘সোলার জিওইঞ্জিনিয়ারিং’-এর একটি শাখা। এই পদ্ধতিতে সূর্যের তাপকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পৌঁছানোর আগেই প্রতিফলিত করে ফিরে পাঠানো হয়। অর্থাৎ, সূর্যালোককে ফিরিয়ে দিয়ে পৃথিবীতে তাপ শোষণ কমানো হয়। গবেষকদের মতে, হিরার গুঁড়ো ব্যবহারে এই প্রতিফলন প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।

গবেষণায় কী বলা হয়েছে?
এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকী ‘জিয়োফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স’-এ। তাতে বলা হয়েছে, হীরার গুঁড়ো সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে সেটিকে পুনরায় মহাকাশে পাঠাতে সক্ষম। যদি এই প্রক্রিয়া ৪৫ বছর ধরে অব্যাহত রাখা যায়, তবে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ২.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত কমে আসতে পারে। এটি বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে এক বিশাল পদক্ষেপ হতে পারে।
কেন হিরার গুঁড়ো?
গবেষণায় দেখা গেছে, হীরার গুঁড়ো অন্যান্য প্রচলিত অ্যারোসলের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। এটি দীর্ঘ সময় ধরে বায়ুমণ্ডলে ভেসে থাকতে পারে এবং জমাট বাঁধার প্রবণতা কম। তুলনামূলকভাবে সালফার-জাত অ্যারোসল অ্যাসিড বৃষ্টির সৃষ্টি করে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, যেখানে হীরার গুঁড়ো এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত।
বাস্তবায়নে বাধা কী?
এত বড় পরিসরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ নয়। প্রথমত, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। গবেষকদের হিসেব অনুযায়ী, ৪৫ বছরের জন্য এই প্রকল্প চালাতে প্রায় ২০০ লাখ কোটি ডলার খরচ হতে পারে। তাছাড়া, এত পরিমাণ হীরার গুঁড়ো সংগ্রহ ও ছড়ানোর জন্য প্রয়োজন হবে বিশাল পরিমাণ প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ।
পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব

যদিও গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল আশাব্যঞ্জক, তবুও এটি পরিবেশ ও সমাজের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা আগে থেকেই ভালোভাবে যাচাই করা প্রয়োজন, কারণ, এর সম্ভাব্য ঝুঁকি—আবহাওয়াগত পরিবর্তন, কৃষি উৎপাদনে প্রভাব, সামাজিক বৈষম্য ইত্যাদি নানা দিক থেকেই মারাত্মক হতে পারে। এক শ্রেণির বিজ্ঞানী এই ধরনের প্রকল্পকে ‘মরিয়া চেষ্টা’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন, যা ভুলভাবে প্রয়োগ হলে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় বিকল্প পথ খুঁজে বের করাটা জরুরি। তবে যে কোনও বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পরিবেশগত মূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। হীরার গুঁড়ো দিয়ে পৃথিবী ঠান্ডা করার এই পরিকল্পনা যুগান্তকারী হতে পারে, আবার তা অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।
আমাদের উচিত, সম্ভাব্য সব উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা, কিন্তু এগোনোর আগে সেই পথ কতটা নিরাপদ তা নিশ্চিত হওয়া—এটাই ভবিষ্যতের পৃথিবী রক্ষার একমাত্র পথ।