লোকসঙ্গীত মূলত বাংলার নিজস্ব সঙ্গীত। বিংশ শতাব্দীতে এই লোকসঙ্গীতের সংস্কৃতির ব্যুৎপত্তি ঘটে। গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ দুঃখের কথা ফুটে ওঠে এই সঙ্গীতে। আমরা সকলেই লোকসঙ্গীত একবার হলেও শুনেছি, গানের বোলের সাথে নিজের জীবনের কোনো না কোনো পরিস্থিতির মিল খুঁজে পেয়েছি। তাই তো সকলেই এই সঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়ে যান। তবে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেকেরই অজানা। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা লোকসঙ্গীত ও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আলোচনা করবো।
লোকসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য, characteristics of folk song
লোকসঙ্গীতের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেগুলি হল :
- লোকসঙ্গীত মৌখিকভাবে লোকসমাজে প্রচারিত।
- সম্মিলিত বা একক কণ্ঠে গাওয়া যায়।
- প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের মুখে মুখে এর বিকাশ হয়।
- সাধারণত নিরক্ষর মানুষের রচনায় এবং সুরে এর প্রকাশ ঘটেছিল।
- আঞ্চলিক ভাষায় এর বোলগুলি উচ্চারিত হয়।
- এই ধরনের সঙ্গীতে প্রকৃতির প্রাধান্য বেশি ।
- দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ এই সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
এই সঙ্গীতের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার মানুষের জীবন যাপন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
লোকসঙ্গীতে বিভিন্ন ধারার গানের ঐতিহ্য, Different genres of music in folk music
লোকসঙ্গীতের আবার বেশ কয়েকটি ভাগ রয়েছে। এই ভাগগুলো একটি নির্দিষ্ট দেশের বা দেশের যেকোনো অঞ্চলের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। যেমন ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, গম্ভীরা ইত্যাদি। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে বাংলা লোকসঙ্গীতে বিভিন্ন ধারার গানের পরিচয় পাওয়া যায়। সেই গানগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিছু গান একক কণ্ঠে গাওয়া হয়, আবার কিছু গান গাওয়া হয় সমবেত কণ্ঠে। যেমন : বাউল, ভাটিয়ালী, প্রভৃতি গানগুলির রচয়িতা ব্যক্তিবিশেষ। কবিগান, আলকাপ গান, গম্ভীরা গান ইত্যাদি হল সমবেত কণ্ঠে গাওয়ার মত গান; অর্থাৎ দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে এসব গান পরিবেশন করে। অন্যদিকে কিছু গান আঞ্চলিক, আবার কিছু আছে সর্বাঞ্চলীয়। কিছু লোকসঙ্গীত আছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত; আবার কতগুলি গান এমনও আছে যা শুধু বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত।
ভাওয়াইয়া –
এই ধরনের গানের মধ্য দিয়ে মনের অনুভূতি প্রকাশ করা হয়। আব্বাসউদ্দিনকে ‘ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট’ বলা হয়। ‘ভাওয়া’ শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া নামের উৎপত্তি, আর এই ‘ভাওয়া’- র মানে গোচারণভূমি। ভাওয়াইয়া গান দুই প্রকার- দীর্ঘ সুরবিশিষ্ট ও চটকা সুরবিশিষ্ট। ভাওয়াইয়া গান মূলত এক প্রকার পল্লীগীতি, যা বাংলাদেশের রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে ও আসামের গোয়ালপাড়ায় প্রচলিত। এই ধরনের গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।
পূর্বে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদী-নালা কম থাকার কারণে গরুর গাড়িতে চলাচলের প্রচলন ছিল। গাড়ির গাড়োয়ান রাত্রে গাড়ি চলাবস্থায় বিরহ ভাবাবেগে কাতর হয়ে আপন মনে গান ধরতো, যাত্রাপথের উঁচু-নিচু রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়লে গানের সুরেও ভাঁজ পড়ে। সুরে এইরূপ ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়া গীতরীতিই ‘ভাওয়াইয়া’ গানে লক্ষণীয়। প্রেম-বিয়োগে উদ্বেলিত গলার স্বর জড়িয়ে সুরের ভাঁজ উঁচু স্বর হতে ক্রমশঃ নীচের দিকে নেমে আসে। গানের সুরে এধরনের ভাঁজ পড়া ভাওয়াইয়া গানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য।
ভাটিয়ালী –
বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান হল ভাটিয়ালী। নদ-নদী পূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালী গানের সৃষ্টি হয়েছিল, ওই অঞ্চলগুলো এই ধরনের গানের চর্চাস্থল এবং সেখানে এ গানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ভাটিয়ালী গান হলো বাউলদের প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান। ভাটিয়ালী গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাঁড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে। গানগুলো গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ নারীর প্রেমপ্রীতি, ভালবাসা, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলনে রচিত।
ভাটিয়ালী অর্থাৎ নদীর স্রোতের টানে ভাটিয়ে যাওয়ার সুর এই গানে বিদ্যমান। দেখতে গেলে নদীর স্রোতের সাথে জীবনের চলার এক অপূর্ব সাদৃশ্য আছে, নদীর স্রোত সমুদ্রের দিকে চলেছে, উজানগামী সে কখনই নয়। জীবনও পরিণতির পথে প্রবহমান, যে মুহূর্ত অতিক্রম করা হয় সেটি আর ফিরে আসে না।
গম্ভীরা –
গম্ভীরা হল বাংলার লোকসঙ্গীতের অন্যতম একটি ধারা। গম্ভীরার প্রচলন বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে রয়েছে। এই ধরনের গান দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। এটি মূলত বর্ণনামূলক গান। সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম দেবতা শিবের উৎসবে শিবের বন্দনা করে যে গান গাওয়া হত, সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায় ‘গম্ভীরা’। এই গম্ভীরা গান সাধারণত দুপ্রকার হয় — আদ্যের গম্ভীরা এবং পালা-গম্ভীরা। দেবদেবীকে সম্বোধন করে নিজের সুখ-দুঃখ পরিবেশন করলে সেই গান আদ্যের গম্ভীরা বলে পরিচিত। অন্যদিকে, দাদু-নাতির ভূমিকায় দুজন ব্যক্তির গানের মধ্য দিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে সমস্যা তুলে ধরা হলে, তা পালা-গম্ভীরা হিসেবে পরিচিত।
বাউল –
বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ হল বাউল গান। বাউল গানের মধ্য দিয়ে বাউলরা তাদের দর্শন ও মতামত প্রকাশ করে থাকে। উনিশ শতক থেকে লালন সাঁইয়ের গানের মাধ্যমে বাউল গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। তিনিই বাংলার শ্রেষ্ঠ বাউল গান রচয়িতা।
বাংলার বাউল গান বর্তমানে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকো এই স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেসকো বাংলাদেশের বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়েছে এবং একে বিশ্ব সভ্যতার সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই স্বীকৃতির ফলে দেশ-বিদেশে বাউল গান নিয়ে বর্তমানে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়।
কবিগান –
বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা হল কবিগান। এই ধারায় গায়ককে কবি হতে হয়। তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে গান গেয়ে থাকেন।
এই কবিগান পরিবেশনকারীরা কবিয়াল হিসেবে পরিচিত। সজনীকান্ত দাশ নিজের বাংলার কবিগান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ‘বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন সাংগীতিক ধারার মিলনে কবিগানের জন্ম’। এই ধারাগুলির নামও বহু বিচিত্র – তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, দাঁড়া কবিগান, বসা কবিগান, ঢপকীর্তন, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদি। কবিয়ালদের প্রকৃত বিকাশকাল হল ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়।
আলকাপ –
বঙ্গদেশের মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজস্ব লোকসংগীত হল আলকাপ। তবে মুর্শিদাবাদ ছাড়াও বীরভূম, মালদহ এবং বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে এই গানের প্রভাব রয়েছে। এই ধরনের গান বিভিন্ন আসরে গাওয়া হয়ে থাকে। এর প্রধান উপজীব্য হলো ছড়া ও গান। এই গানের সংস্কৃতিতে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক মিলনের সূত্র রয়েছে। লৌকিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি নানা বিষয় আলকাপ গানের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে রাধাকৃষ্ণের কথাও আলকাপ গানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।
আলকাপ গান দলবদ্ধভাবে পরিবেশন করা হয়, দলের প্রধানকে সরকার বা মাস্টার বলে, আর তার সাথে থাকে আরো এক চরিত্র, যাকে আলকাপের ভাষায় বলা হয় “কাপ্যাল”। সরকার এবং কাপ্যালের চরিত্র সব সময় দুই ভাই হিসেবে দেখা যায় আলকাপ গানে। এই দলে দুজন পুরুষ মানুষ গানের সময় মেয়ে সেজে নাচ- গান আর অভিনয় করে। এদেরকে “ ছোকরা”, “ ছুকরি”, “ছুরকি” নামে ডাকা হয়। এছাড়াও গানের দলে থাকে যন্ত্র বাদক। তারা ঢোলক, হারমোনিয়াম, ডুগি, তবলা, খঞ্জনি, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র গানের সাথে ব্যবহার করে।
শেষ কথা, Conclusion
লোকসঙ্গীত হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারণকারী সংস্কৃতি। ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাঙালি সংগীতপ্রিয় জাতি, আর লোকসঙ্গীত গুনগুন করতে সকলেরই বেশ ভালোই লাগে। অবচেতন মনে আমরা প্রায় সকলেই লোকগীতি গেয়ে উঠি অনেক সময়। এর কারণ হয়তো এই যে লোকসঙ্গীতের বোল আমাদের মনে ছাপ রেখে যায়, নিজের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে আমরা এই গানের মিল পাই। তাইতো সুদূর অতীত সময় থেকে আজ অবধি এই ধরনের গানের মূল্য অক্ষুন্ন রয়েছে।