গাজীপুর জেলা সম্পর্কে বিস্তারিত, Details about Gazipur District in Bengali

গাজীপুর জেলা সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল হল গাজীপুর জেলা। উক্ত জেলা নিজের অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের একটি বিশেষ শ্রেণীভুক্ত জেলা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে গাজীপুরেই ১৯ মার্চ সংঘটিত হয় প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। এছাড়াও গাজীপুরে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে।

ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত গাজীপুর শিল্প নগরী হিসেবেও পরিচিত। তবে এই জেলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানও কিন্তু পর্যটকদের দৃষ্টি এড়ায় না। এই জেলার গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে বাংলাদেশের প্রায় সকল স্থানেও যাওয়ার জন্য গাড়ি পাওয়া যায়।

গাজীপুর এর পূর্ব নাম কি ছিল, What was the former name of Gazipur?

এক সময়ের প্রাচীন জনপদ ‘ভাওয়াল’ পরগনা বর্তমানে গাজীপুর নামে পরিচিত। ভাওয়াল নামকরণের পিছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক পটভূমি। ভাওয়াল নাম নিয়ে বেশ কিছু মতভেদ রয়েছে। গবেষক নুরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্নের মতানুসারে, চন্ডাল রাজাদের পতনের পর ভাওয়াল গাজীদের অধিকারে আসে। অনেকের মতে, ভদ্রপাল বা ভবপাল নাম থেকে ভাওয়াল নামকরণ হয়।

পরবর্তী পর্যায়ে মুসলমানদের বঙ্গ বিজয়ের পর থেকে এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম শক্তির উত্থান ঘটে। এই ধারাবাহিকতায় ভাহওয়াল (ভাওয়াল) গাজী শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং একে একে তিনি এ অঞ্চলের চেদী রাজ্যগুলো দখল করে নেন। অতঃপর নিজের নামানুসারে এই জনপদের নামকরণ করেন ভাওয়াল। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভাওয়ালের বীর গাজীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার ‘গাজীপুর’ নামটি অনুমোদন করে। এভাবে গঠিত হয় গাজীপুর মহকুমা।

গাজীপুর জেলার ইতিহাস, History of Gazipur District :

শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ ও কাপাসিয়া এই ৫টি উপজেলা নিয়ে গাজীপুর সদর ঢাকা জেলা থেকে বিভক্ত হয়ে যায়। এরপর ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ গাজীপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালে গাজী নামে এক কুস্তিগীর এখানে থাকতো, তাই ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে এই কুস্তিগীরের নাম থেকেই সম্ভবত এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে।

তবে অনেকেই এই মতের বিরোধিতা করেছেন, কিছু মানুষের হিসেবে সম্রাট আকবরের সেনাপতি ঈশা খাঁর ছেলে ফজল গাজীর নামে এই জনপদের নামকরণ করা হয়েছে।

গাজীপুর জেলার উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ, Highlights of Gazipur District: :

গাজীপুর জেলার উল্লেখযোগ্য বিষয়
  • গাজীপুর জেলায় জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তরসহ ১৯টি কেপি আই, ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়, ২টি ক্যান্টনমেন্ট ও দেশের একমাত্র হাইটেক পার্কসহ বহু সংখ্যক সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
  • এই জেলায় ক্ষুদ্র/মাঝারী ও ভারী শিল্পকারখানা সহ দেশের পোশাক তৈরির শিল্প কারখানা রয়েছে। গাজীপুরের মধ্যেই দেশের ৭৫ শতাংশ গার্মেন্টস শিল্প অবস্থিত।
  • বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সিটি কর্পোরেশন হল গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, যার আয়তন ৩৩০ বর্গ কিঃমিঃ।
  • গাজীপুর জেলার বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
  • গাজীপুরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্বীকৃত একমাত্র জাতীয় উদ্যান ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ও এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় সাফারি পার্ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক অবস্থিত।
  • বাংলাদেশের একমাত্র টাকশাল বা টাকা তৈরির কারখানা এই জেলায় রয়েছে, যেখানে দেশের সকল টাকা তৈরি করা হয়।
  • বাংলাদেশের একমাত্র অস্ত্র তৈরির কারখানাও গাজীপুরে অবস্থিত।
  • বাংলাদেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার গাজীপুরে অবস্থিত।
  • বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ তুলা গবেষণা ইন্সটিটিউট গাজীপুরে অবস্থিত।
  • এছাড়াও গাজীপুর জেলায় বাংলাদেশের একমাত্র সমরাস্ত্র কারখানা অবস্থিত

গাজীপুর জেলার জনসংখ্যা, Population of Gazipur district :

  • ২০২২ সাল অনুযায়ী গাজীপুর জেলার জনসংখ্যা মোট ৪৪,০৩,৯১২।
  • জনঘনত্ব ২,৫০০/বর্গকিমি অর্থাৎ ৬,৪০০/বর্গমাইল।
  • গাজীপুর জেলার সাক্ষরতার হার : ৮০.৭%।

গাজীপুর জেলার অবস্থান ও আয়তন, Location and area of ​​Gazipur district :

বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার উত্তর দিকে রয়েছে ময়মনসিংহ জেলা ও কিশোরগঞ্জ জেলা, আবার দক্ষিণে আছে ঢাকা জেলা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা, অন্যদিকে এই জেলার পূর্ব দিকে কিশোরগঞ্জ জেলা ও নরসিংদী জেলা এবং পশ্চিম দিকে আছে ঢাকা জেলা ও টাঙ্গাইল জেলা। গাজীপুর জেলার মোট আয়তন ১,৭৭০.৫৮ বর্গকিমি অর্থাৎ ৬৮৩.৬২ বর্গমাইল।

গাজীপুর জেলার অবস্থান ও আয়তন

গাজীপুর জেলার প্রশাসনিক এলাকাসমূহ, Administrative Areas of Gazipur District::

১৯৮৪ সালে গাজীপুর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই জেলা নিম্নলিখিত উপজেলাগুলিতে বিভক্ত :

  • গাজীপুর সদর উপজেলা
  • কালিয়াকৈর উপজেলা
  • শ্রীপুর উপজেলা
  • কাপাসিয়া উপজেলা
  • কালীগঞ্জ উপজেলা

গাজীপুর জেলার প্রধান নদী কোনটি, Which is the main river of Gazipur district??

বাংলাদেশের অন্যতম জেলা গাজীপুর এর প্রধান নদী হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদী; যদিও এখানে আরো অনেকগুলো নদী আছে।

গাজীপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত, What is Gazipur district famous for??

গাজীপুর জেলা আফিম কারখানার জন্য সুপরিচিত, যা 1820 সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখনও বিশ্বের বৃহত্তম আইনী আফিম কারখানা, যা বিশ্বব্যাপী ওষুধ শিল্পের জন্য ওষুধ উৎপাদন করে।

জেলার শিক্ষাব্যবস্থা, Education system of the district :

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উপকন্ঠে অবস্থিত গাজীপুর জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বহুসংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজ রয়েছে।

গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ

এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :-

বিশ্ববিদ্যালয় :

  • জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
  • উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
  • ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
  • বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়
  • ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি

কলেজ ও উচ্চবিদ্যালয় :

  • ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ
  • টংগী সরকারি কলেজ
  • গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ
  • রাণী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়

গাজীপুর জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ, Sightseeing places of Gazipur district :

ভাওয়াল রাজবাড়ী
  • ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান
  • বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
  • ভাওয়াল রাজবাড়ী, গাজীপুর সিটি
  • নুহাশ পল্লী, গাজীপুর সদর
  • কাশিমপুর জমিদার বাড়ি, গাজীপুর সদর
  • আনসার একাডেমী, কালিয়াকৈর
  • শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ী, কালিয়াকৈর
  • বলিয়াদী জমিদার বাড়ী, কালিয়াকৈর

গাজীপুর জেলার বিখ্যাত খাবার, Famous food of Gazipur district :

গাজীপুর জেলায় আপনি জনপ্রিয় অনেক খাবার পাবেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাঁঠাল, পেয়ারা, রসগোল্লা, চমচম, বিরিয়ানি, হালুয়া, পায়েস।

গাজীপুর জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব সমূহ, Notable personalities of Gazipur district :

গাজীপুর জেলা
  • মেঘনাদ সাহা – তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
  • মোঃ সামসুল হক – স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
  • ফকির শাহাবুদ্দীন – বাংলাদেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল।
  • তাজউদ্দিন আহমেদ – বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
  • ব্রিগেডিয়ার আ স ম হান্নান শাহ – রাজনীতিবিদ, সাবেক পাটমন্ত্রী।
  • আহসানউল্লাহ মাস্টার – রাজনীতিবিদ; সাবেক সংসদ সদস্য।
  • এম জাহিদ হাসান – পদার্থবিদ,
  • আবু জাফর শামসুদ্দীন – একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
  • আর্চবিশপ পৌলিনুস ডি কস্তা – বাংলাদেশের প্রাক্তন সর্বোচ্চ ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতা।
  • আ.ক.ম মোজাম্মেল হক – এমপি (গাজীপুর ১) এবং মাননীয় মন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
  • জাহিদ আহসান রাসেল – এমপি গাজীপুর আসন নং ২ ও মাননীয় প্রতিমন্ত্রী যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
  • আনিছুর রহমান মিঞা – অবসরপ্রাপ্ত সচিব; চেয়ারম্যান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
  • মেহের আফরোজ চুমকি – রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য।
  • সিমিন হোসেন রিমি – সাংসদ গাজীপুর আসন নং ৪।
  • রহমত আলী – রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
  • ইকবাল হোসেন সবুজ – সাংসদ গাজীপুর আসন নং ৩।
  • মারাজ হোসেন অপি – খেলোয়াড়।
  • জায়েদা খাতুন – মাননীয় মেয়র (নগর মাতা), গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন।
  • চৌধুরী তানবীর আহমেদ সিদ্দিকী – বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ।
  • মোহাম্মদ ওবাইদ উল্লাহ – রাজনীতিবিদ; সাবেক সংসদ সদস্য।
  • সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন – বাংলাদেশী মহিলা রাজনীতিবিদের মধ্যে অন্যতম।
  • রুমানা আলী – রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য মহিলা আসন।
  • ফকির আবদুল মান্নান শাহ – রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী।
  • মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ (গাজীপুরের রাজনীতিবিদ) – বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য (সাবেক)।
  • এ কে এম ফজলুল হক মিলন – রাজনীতিবিদ ও সাবেক সংসদ সদস্য।
  • মোহাম্মদ সানাউল্লাহ (চিকিৎসক) – সাবেক সংসদ সদস্য।
  • এম. এ. মান্নান (গাজীপুরের রাজনীতিবিদ) – রাজনীতিবিদ এবং গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও সাবেক মন্ত্রী।
  • মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন – আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরিচালনাকারী।
  • জাহাঙ্গীর আলম (রাজনীতিবিদ) – সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মেয়র, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন।
  • হাসান উদ্দিন সরকার – সাবেক সাংসদ, গাজীপুর আসন নং ২।
  • তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ – সাবেক প্রতিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
  • মোঃ আতাবুল্লাহ – বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক।

শেষ কথা, Conclusion :

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝতে পারছেন যে, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সংশ্লেষে কালোত্তীর্ণ মহিমায় আর বর্ণিল দীপ্তিতে ভাস্বর অপার সম্ভাবনায় ভরপুর গাজীপুর জেলা। মোগল-ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে গাজীপুরের রয়েছে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। আপনাদের কখনো বাংলাদেশে ভ্রমণের সুযোগ হলে গাজীপুর অবশ্যই গিয়ে আসতে পারেন।

Frequently asked questions :

গাজীপুর জেলা কোথায় অবস্থিত?

বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল হল গাজীপুর জেলা।

গাজীপুর জেলার প্রধান নদী কোনটি?

বুড়িগঙ্গা নদী।

গাজীপুর জেলার জনসংখ্যা কত?

২০২২ সাল অনুযায়ী গাজীপুর জেলার জনসংখ্যা মোট ৪৪,০৩,৯১২।

Contents show

RIma Sinha

Rima Sinha is working as a writer and also as a journalist. she got her bachelor of arts degree from Tripura University. She has also completed Master of Arts in Journalism and mass communication from Chandigarh University.

Recent Posts