বর্তমানে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমে বেড়েই চলেছে। কখনো ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে, কখনো সকাল সন্ধ্যা জুড়ে ধোঁয়াশায় ঘিরে থাকছে বিভিন্ন শহরাঞ্চল, আবার কখনো প্রবল বৃষ্টিতে বন্যা ইত্যাদি। তবে এসব ছাড়াও যেসব জটিল সমস্যায় আমাদের সভ্যতা তথা পৃথিবী জর্জরিত তার মধ্যে অন্যতম হল গ্রীন হাউস এফেক্ট। তাই আমাদের গ্রীন হাউস এফেক্ট কি এবং এই সমস্যার কারণ সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি, যাতে আমরা সকলে মিলে এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারি। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা গ্রীন হাউস এফেক্টের কারণ ব্যাখ্যা করবো।
গ্রীন হাউস এফেক্ট কি ? What is Green House Effect?
প্রধানত উদ্ভিদ বিজ্ঞানে গ্রীন হাউস কথাটি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত শীত প্রধান দেশে দেখা যায় যে উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য এক প্রকার কাঁচের ঘর ব্যবহার করা হয়। এই কাঁচের ঘরের মধ্যে যে পরিমান সূর্যালোক প্রবেশ করে তা কাঁচের ঘর ভেদ করে বাইরে বেরোতে পারেনা বলে এই কাঁচের ঘরের উষ্ণতা বাইরের থেকে অনেকটাই বেশি হয় যা উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে আমাদের পৃথিবীও এক বিশাল গ্রিন হাউসে পরিনত হতে চলেছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত কাঁচের ঘরের মতো পৃথিবীকেও বেষ্টন করে রয়েছে বায়ুমণ্ডল। দিনের বেলা এই বায়ুমণ্ডল ভেদ করে যে পরিমান সূর্যালোক প্রবেশ করে রাতের বেলা তা পার্থিব বিকিরনের মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে যায়, এর ফলে পৃথিবীতে তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় থাকে।
কিন্তু আমাদের এই বায়ুমণ্ডলের চাদরে কিছু কিছু গ্যাস রয়েছে যাদের মধ্যে তাপ শোষণ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। যেমন – কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (CFC), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O), ওজোন (O3) ও জলীয় বাষ্প (H2O) প্রভৃতি। বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন প্রকার গ্যাস একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে রয়েছে, যা আমাদের জীবনধারণের সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির পাশাপাশি দেখা গেছে যে পৃথিবী থেকে পার্থিব বিকিরন রূপে যে পরিমান তাপ নির্গত হওয়ার কথা তা হচ্ছে না, এর কারণ উক্ত গ্যাসগুলি সূর্যের বিকিরিত তাপের বেশকিছু অংশ শোষণ করে নিচ্ছে, যার ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা কে বলা হয় গ্রীন হাউস এফেক্ট এবং উপরিক্ত গ্যাসগুলি গ্রীন হাউস গ্যাস হিসেবে পরিচিত।
গ্রীনহাউস গ্যাসগুলো তাপ-আটক গ্যাস হিসাবে পরিচিত, এর কারণ হল তারা তাপ আটকে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে এইসব গ্যাসের ভারসাম্য সঠিকভাবে বজায় না থাকার কারণে পৃথিবী ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রাথমিক গ্রিনহাউস গ্যাস গুলোর মধ্যে আছে জলীয় বাষ্প,কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড এবং ওজোন ইত্যাদি।
গ্রীন হাউস এফেক্ট এর কারণসমূহ, Causes of Green House Effect
আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের ফলেই বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। এরফলে এই সব গ্যাসগুলির দ্বারা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপ শোষণের পরিমানও, ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আগের তুলনায় অনেকটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে সব কারণে এই গ্রিন হাউস গ্যাসগুলি বৃদ্ধি পেয়ে গ্রিন হাউস এফেক্ট কে ত্বরান্বিত করছে, তা হল –
১. জীবাশ্ম জ্বালানির দহন –
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়লা, পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানিগুলো বিভিন্ন কলকারখানা, যানবাহন চলাচলে তথা অন্যান্য বহু কাজে ব্যবহার করা হয়। এই সব জীবাশ্ম জ্বালানির দহনের ফলস্বরূপ প্রচুর পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, যা বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে দিনের পর দিন বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করে তুলছে। এটি গ্রিন হাউস এফেক্ট এর একটি অন্যতম কারণ।
২. ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (CFC) ব্যবহার –
অনেকেই হয়তো জানেন না, তবে বর্তমানে বেশকিছু শিল্পে CFC এর ব্যবহার করা হয়। যেমন হিমায়ন প্রক্রিয়া, রং শিল্প ও ইলেক্ট্রনিক শিল্পে প্রচুর CFC ব্যবহার হয়ে থাকে, এর ফলে বাতাসে CFC পরিমান বৃদ্ধি পায়। বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর ধ্বংসের নেপথ্যে ক্লোরোফ্লুওরোকার্বন জাতীয় যৌগগুলি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহৃত রেফ্রিজারেটর, শীততাপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র, ফোম ও প্লাস্টিক তৈরি, রঙ শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে CFC নির্গত হলে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের ক্ষতি করছে, ফলে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার কারণে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং গ্রিন হাউস এফেক্ট বাড়িয়ে তুলছে।
৩. কৃষি ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন সারের অত্যধিক ব্যবহার –
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলেছে, যায় জন্য ফসল উৎপাদনও বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। আমরা সবাই জানি যে ফসল বৃদ্ধিতে নাইট্রোজেন কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তাই কৃষিতে ফসলের উৎপাদন হার বৃদ্ধির জন্য জমিতে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই নাইট্রোজেন বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে নাইট্রাস অক্সাইড উৎপন্ন করে, যা জিবকুলের জন্য ক্ষতিকর। এই কারণেও গ্রিন হাউস এফেক্ট বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. জৈব- অজৈব আবর্জনার পচন –
নানা ধরণের জৈব আবর্জনা থেকে থেকে আপনা আপনি পচে যায়, মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহের পচন তথা গবাদি পশুর মলমূত্র থেকে প্রচুর পরিমানে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়ে বাতাসে মিশে যায়, আর আমরা সকলেই জানি যে মিথেন গ্যাস কতটা ক্ষতিকর হয়। বাতাসে মিথেনের বৃদ্ধিও গ্রিন হাউস এফেক্ট বাড়িয়ে দেয়।
দেখতে গেলে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের প্রভাবে ওজোন স্তর ধ্বংসের ফলে বায়ুওমন্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ওঠার পেছনে দায়ী জলবায়ুগত পরিবর্তন, যার কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাথে বাতাসে জলীয় বাষ্প ধারণ করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমান বাড়ছে। যদিও গ্রিনহাউস এফেক্টটি প্রাকৃতিকভাবে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, তবে একটা কথা জেনে রাখা উচিত যে মানুষের ক্রিয়াকলাপের ফলেই বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন দ্বারা এই প্রভাব আরও তীব্র হচ্ছে।
ভবিষ্যতে গ্রীন হাউজ ইফেক্টের ক্ষতিকর প্রভাব, Harmful effects of greenhouse effect in future
বহু বিজ্ঞানী এই গ্রিন হাউস এফেক্ট নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির বৃদ্ধি পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি আরোও বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এতে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং খরা ও বৃষ্টিপাতের নতুন নিদর্শন তৈরি হতে পারে। এছাড়াও গ্রিন হাউস এফেক্ট এর চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে প্রায়ই বন্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং সম্ভবত কিছু অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদনও ব্যাহত করতে পারে। এর থেকে স্পষ্ট যে ভবিষ্যতে এই গ্রিন হাউস এফেক্ট এর ফলস্বরূপ মনুষ্য তথা জীবকুল বহু সমস্যার সম্মুখীন হবে এবং জীবনধারণ অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। গ্রীন হাউজ ইফেক্টের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো হল :
- গ্রীন হাউস এফেক্ট এর কারণে প্রতিবার তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে পৃথিবীর সমুদ্র উপকূলবর্তী নিচু স্থলভূমি জলমগ্ন হবে।
- উষ্ণায়নের ফলে শুধু মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বরং অসংখ্য উদ্ভিদ ও পানির অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে অসংখ্য জীবের প্রজাতি পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হবে।
- সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সামুদ্রিক ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও টাইফুনের হার বেড়ে যাবে।
গ্রিন হাউস এফেক্ট এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাসমূহ নেওয়া যেতে পারে, Following measures can be taken to control the effects of Green House Effect
- ১। জ্বালানি শক্তির সংরক্ষণের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে ক্ষতিকর গ্যাসের বৃদ্ধির পরিমাণ হ্রাস করা।
- ২। কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদনকারী বিভিন্ন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যথাসম্ভব কম করে দেওয়া।
- ৩| বনাঞ্চল সংরক্ষণ করা ও বনায়নের মাধ্যমে নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি করা।
- ৪। কৃষি কাজে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কম করে জৈব সারের ব্যবহার করা।
- ৫। কলকারখানার ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া বায়ুমন্ডলে সরাসরি নির্গত না করে বরং উপযুক্ত ফিল্টারের মাধ্যমে পরিশোধনের পর নির্গমণের করানোর ব্যবস্থা নেওয়া।
শেষ কথা, Conclusion
পৃথিবীতে গ্রিন হাউস এফেক্ট বৃদ্ধির পেছনে মূলত মানুষই দায়ী। তাই মানুষেরই কর্তব্য নিজের জীবনের স্বার্থে এই উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী বিভিন্ন কার্যকলাপ কম করা, যাতে পৃথিবী আমাদের বাসযোগ্য থাকে, নয়তো আমাদের প্রাণ সংকটে পড়বে।