জুতা বা জুতোর উদ্ভাবন মূলত মানুষের পা এর নিরাপত্তা বিধানের জন্যে হয়েছিল, তবে বর্তমানে এটি মানুষের নিরাপত্তার পাশাপাশি সাজ-সজ্জারও একটি অংশ হয়ে উঠেছে। মানুষের শরীরের অন্য যে কোনো জায়গা অপেক্ষা পায়ের মধ্যে অধিক হাড় আছে; তাছাড়াও বহু শত সহস্র বছরের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে আসা বিভিন্ন ভূমি ও আবহাওয়াগত পরিবেশের বিবর্তনের ইতিহাসও আছে। মানুষের ইন্দ্রিয় এবং পা- এই দ্বৈত সমন্বয়ের মাধ্যমেই আমরা নিজের চলার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছি। তাই পা সুরক্ষিত রাখতে জুতা পরিধান জরুরী।
হাল ফ্যাশনের জুতো, Latest Fashion Shoes :
ঐতিহ্যগতভাবে দেখতে গেলে, আগেকার সময়ে জুতা চামড়া, কাঠ বা ক্যানভাস থেকে তৈরি করা হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিভিন্ন উপাদান দিয়ে জুতো তৈরি হচ্ছে; যেমন : রাবার, প্লাস্টিক এবং অন্যান্য পেট্রোরাসায়নিক থেকে প্রাপ্ত উপকরণ ইত্যাদি।
জেনে রাখা ভালো যে বিশ্বব্যাপী, জুতা শিল্প বছরে $২০০ বিলিয়নের ব্যবসা করছে। তবে শেষমেশ ৯০% জুতাগুলোর শেষ অবস্থান হয় ভাগাড়ে; কারণ জুতার উপাদানগুলো আলাদা করা, পুনর্ব্যবহার করা বা পুনরায় ব্যবহার করা কঠিন।
জুতোর উদ্ভাবনের ইতিহাস, History of Shoe Invention :
বর্তমান সময়ে মানুষের দৈনিক ব্যবহার্য জিনিসগুলোর মধ্যে জুতা অন্যতম। শহরাঞ্চলে তো জুতা ছাড়া যেন এক মুহূর্তও কল্পনা করা কঠিন। অন্যদিকে দেশ দেশান্তরে বয়স-লিঙ্গ-দেশ-কাল ভেদে জুতার বাহারি ডিজাইন রয়েছে। মূলত পা’কে ক্ষতবিক্ষত ও নোংরা থেকে দূরে রাখার জন্যই জুতার ব্যবহার করা হয়।
এশিয়া এবং আফ্রিকাতেই স্যান্ডেলের ব্যবহার বেশি, অন্যান্য মহাদেশগুলোতে স্যান্ডেলের ব্যবহার তুলনামূলক কম, বরং বেশিরভাগ অঞ্চলেই চামড়ায় মোড়া জুতা ব্যবহৃত হয় বেশি। ঠিক কবে থেকে এই জুতার ব্যবহার শুরু হয়েছে, তা জানতে গেলে ইতিহাসের অনেকটা পাতা পেছনে পাল্টে দেখতে হবে।
প্রাচীন জুতা :
স্পেনের একটি গুহায় ১৫০০০ বছর আগের কিছু গুহাচিত্র পাওয়া যায়, সেই গুহাচিত্রে আদিম মানুষদের পায়ে পশুর চামড়া জড়ানো ছিল।
বরফ যুগের সময়ে অর্থাৎ ৫০০০ বছর আগে মানুষেরা খড়যুক্ত চামড়ায় মোড়া জুতা পরিধান করতো বলে জানা যায়। এছাড়া, এশিয়াতে প্রাচীন যত চিত্রকর্ম পাওয়া গেছে, তা থেকে কাঠের জুতার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। জাপানের প্রাচীন মিথ সাহিত্যেও কাঠের জুতার ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
বর্তমান সময়ে ব্যবহৃত জুতা এই অবস্থায় আসতে দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, একথা অনস্বীকার্য। ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায় যে, ইউরোপের কিছু অঞ্চলে জুতা শুধু রাজাদের পরিধানযোগ্য ছিল। কোনো প্রজা জুতা পরিধান করলে তাকে রাজার আদেশে হত্যা পর্যন্ত করা হতো। এশিয়াতে রাজন্যবর্গের রাস্তায় জনসাধারণের জুতা পায়ে হাটাও নিষিদ্ধ ছিল।
বর্তমানের হাইহিল জুতা :
বর্তমানে মেয়ে তথা কিছু ছেলেদের ক্ষেত্রেও আমরা হাইহিল জুতা দেখতে পাই। হাইহিল জুতার প্রচলন প্রথম শুরু হয় ফ্রান্সে। ষোড়শ লুই হাইহিল জুতার প্রচলন করেন। ফরাসি রাজপরিবার জনসাধারণের হাইহিল জুতা পরিধানের উপর নিশেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
ফ্রান্সের ইতিহাস থেকে জানা যায়, হইহিল জুতা নিয়ে ফ্রান্সে যুদ্ধও হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে লন্ডনের কিছু ব্যবসায়ি ফ্রান্সের হাইহিল জুতার অনুকরণে জুতা প্রস্তুত শুরু করে যা লন্ডনের রাজপরিবারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
স্যান্ডেলের ব্যবহার :
ইতিহাস অনুসারে, স্যান্ডেলের ব্যবহার মিসর সর্বপ্রথম শুরু করেছিল। মিসরের ফারাও রাজারা রাজকার্য পরিচালনা করতেন স্যান্ডেল পরিধান করে। রাষ্ট্রে ফারাও ব্যতীত অন্য কেউ স্যান্ডেল পরিধান করতো না। মিসরের সমাজে স্যান্ডেলকে সম্মানীয়ের পরিধানযোগ্য বলে গণ্য করা হতো।
অন্যদিকে উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ান জাতিগোষ্ঠি ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের প্রয়োজনেই জুতা তৈরি করে নেয়। তবে ভারতীয়রা শুধু ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্যই নয়, বরং নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা বোঝানোর জন্যও জুতা পরিধান করতেন।
এদিকে ইউরোপে রানী এলিজাবেথের সময়ে আইন করা হয় যে কেউ জুতা বানাতে চাইলে তাকে ৫১/২ ইঞ্চি জুতা তৈরি করতে হবে। একমাত্র রাজপরিবারেরই এই দৈর্ঘ্য প্রস্থের বাইরে জুতা তৈরির অধিকার ছিল।
খড়ম :
খড়ম শব্দটি আমাদের সকলেরই পরিচিত। এটি কাঠের তৈরী এক প্রকার পাদুকা। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৭০০ শতকের দিকে কাঠের তৈরি খড়ম অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
আধুনিক জুতার প্রচলন, Modern Shoe Trends :
ইউরোপে নারী-পুরুষের জন্য ১৮০০ সাল পর্যন্ত আলাদা কোনো জুতা ছিল না। সবাইকে একই ডিজাইন এবং দৈর্ঘ্যের জুতা পরিধান করতে হতো। ক্রমে ১৮০০ সালের পরে চামড়ার বদলে সিল্কের কাপড় জুতার উপরিতলের অংশে ব্যবহার করে নারীদের জন্য পৃথক জুতা তৈরি করা হয়।
এরপর জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডও সিল্কের জুতা তৈরি করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে বেলজিয়াম অগ্রগামী হয়ে নারীদের জন্য তৈরিকৃত জুতায় সিল্কের উপর বিভিন্ন নকশা করতে শুরু করে।
জুতোর প্রকারভেদ, Types of Shoes :
সময়ের সাথে জুতোর ধরন ও ডিজাইন সাথে অনেকটা বদলে গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একই ডিজাইনের জুতোয় উঁচু হিল থাকতে পারে, আবার নাও পারে। সমসাময়িক জুতা স্টাইল এবং দামের দিক থেকে ভিন্ন হয়। জুতার আধুনিকায়ন শুরু হয় আজ থেকে ৪০০ বছর আগে।
পাদুকার প্রথম আধুনিকায়নে হাত দেয় ইউরোপীয়রা। ক্রমে এতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও অংশগ্রহণ করে।
১৮০০ শতকে জাপানিরা কাঠ দিয়ে ‘ওকোবো’ নামে জুতা তৈরি করে, যার পরিমাপ ছিল ১৪ সেন্টিমিটার। জাপানের নারীরা বৃষ্টির দিনে কাদা থেকে রক্ষা পেতে এ জুতা পায়ে দিত।
১৭০০ শতকের দিকে ইউরোপীয়রা নারী-পুরুষ উভয়ের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করে উঁচু জুতা, যা ‘হাই হিল’ নামে পরিচিত।
বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বৃষ্টি, কাদা এবং বরফ আচ্ছাদিত পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য ফিনল্যান্ড গাছের ছাল দিয়ে তৈরি করে এক ধরনের পাদুকা। পরবর্তীতে নরওয়ে, সুইডেন এবং রাশিয়া এর আধুনিকায়ন করে। ইতালিও কাঠ দিয়ে পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে তৈরি করে ‘চোপিনস’ নামে এক ধরনের ক্ষুদ্রাকৃতির জুতা। এটি মূলত নারীদের ব্যবহারের জন্য। এ জুতার পরিমাপ ছিল ৫ ইঞ্চি।
কাঠের খড়ম ১৭০০ শতকের দিকে ভারতবর্ষে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। জুতা রপ্তানির দিক থেকে ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। সাধারণত চামড়ার তৈরি জুতা এই দেশগুলো থেকে রপ্তানি করা হয়।
জুতার ব্যবসার শুরু, Start of shoe business :
১৮৫০ সালের পূর্ব সময় অবধি জুতা আমদানি বা রপ্তানি করা হতো না। বিশ্বের অনেক দেশেই ১৬৬৫-৭০ সালের মধ্যে নির্মিত ‘অক্সফোর্ড স্যু’ জুতো রপ্তানি করতে শুরু করে লন্ডন। ১৪৯০ সালে জার্মানিদের তৈরিকৃত ‘ভাল্লুকের থাবা’ নামে পরিচিত জুতা রপ্তানি শুরু হয়।
১৮৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জুতা তৈরির কারখানা স্থাপন করে। প্রথম যন্ত্র দ্বারা জুতা তৈরি তখনই শুরু করা হয়। যন্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন এলিস হাও। পরবর্তীতে, ১৮৫৮ সালে লেম্যান আর. ব্লেক নামের জুতা বানানোর আধুনিক যন্ত্র তৈরি করেন। গর্ডন ম্যাককে লেম্যানের যন্ত্রের পেটেন্ট কিনে নেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের সময় এই গর্ডনের প্রতিষ্ঠিত জুতা কোম্পানিই সেনাবাহিনীর জুতা তৈরি করে। যুদ্ধ পরবর্তীকালে কোম্পানিটি জনসাধারণের জন্যও জুতা তৈরি শুরু করে।
জুতা কোথায় আবিষ্কার হয়, Where was the shoe invented ?
বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে, জুতো প্রথম আবিস্কার হয়েছিল মিশরে। পেপাইরাস নামক এক গাছের পাতা দিয়ে সেন্ডেল বানানো হত। ইতিহাসের অনেক সমালোচক ধারণা করেন মিশরীয়রাই প্রথম প্রফেশনাল জুতা তৈরি শুরু করেন।
পৃথিবীর প্রথম জুতা কে আবিষ্কার করেন, Who invented the world’s first shoes?
জুতা আবিষ্কারের কৃতিত্ব কাউকে দেওয়া হয় না কারণ সেগুলো হাজার হাজার বছর আগের। জুতার প্রথম প্রমাণিত উদাহরণ 7,000 থেকে 8,00 খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাওয়া যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনের ফোর্ট রক গুহায় সেজব্রাশের বার্ক স্যান্ডেল পাওয়া গেছে। রোমানরাই প্রথম বাম ও ডান পায়ের জুতা ডিজাইন করে। চামড়া থেকে তৈরি প্রাচীনতম জুতাগুলি 3500 খ্রিস্টপূর্বাব্দের বলে মনে করা হয়।
1817 সালে, উইলিয়াম ইয়াং নামে একজন ফিলাডেলফিয়া মুচি তার গ্রাহকদের জন্য মিরর করা বাম/ডান জুতা তৈরি করতে শুরু করেন এবং আবিষ্কারটি বেশ জনপ্রিয় প্রমাণিত হয়।
প্রাচীন মানুষ কি জুতা পরিধান করতো, Did ancient people wear shoes?
জুতা পরিধানের প্রাথমিক বিকাশ সত্ত্বেও, গ্রীক সহ অনেক প্রাচীন সভ্যতা নিয়মিতভাবে জুতা ব্যবহার করত না। প্রকৃতপক্ষে, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খালি পায়ে সেনাবাহিনী নিয়ে বিশ্ব জয় করেছিলেন। রোমানরাই সর্বপ্রথম ডান ও বাম পায়ের জন্য আলাদা জুতা ডিজাইন করে, তাদের সৈন্যদের এই জুতা প্রদান করে।
ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন গ্রীকরা পাদুকাকে অনেকাংশে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে দেখেছিল , রোমান পোশাক ছিল শক্তির চিহ্ন, এবং পাদুকাকে সভ্য জীবনযাপনের প্রয়োজনীয়তা হিসেবে দেখা হত।
প্রাচীন রোমে জুতার প্রাথমিক উদ্দেশ্য কি ছিল, What was the primary purpose of shoes in ancient Rome?
রোমানরা পোশাক এবং পাদুকাকে সমাজে ক্ষমতা এবং মর্যাদার অস্পষ্ট লক্ষণ হিসাবে দেখেছিল। বেশিরভাগ শহুরে রোমানরা জুতা, চপ্পল, বুট বা বিভিন্ন ধরনের স্যান্ডেল পরত; গ্রামাঞ্চলে, কিছু খড়ম পরতেন। শহরে তারা সাধারণত তাদের টোগাস বা বর্ম সহ ট্যানড চামড়ার রঙ্গিন এবং অলঙ্কৃত জুতা পরতেন। দাসদের সাধারণত খালি পায়ে থাকতে হতো।
জুতা’র সমার্থক শব্দ কি, What is the synonym of shoe ?
জুতার অন্যান্য নাম হল : জুতো, স্যান্ডেল, চটি, খড়ম, পাদুকা ইত্যাদি।
১৮০০ সালে জুতা কিভাবে তৈরি করা হত, How were shoes made in 1800 ?
প্রারম্ভিক জুতা প্রস্তুতকারীরা বাড়িতে একটি জুতা তৈরি করতে পারতেন পাউন্ডিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং চামড়া প্রস্তুত করে তারপরে পায়ের আকৃতির জন্য উপরের অংশের জন্য উপাদান কাটতেন । তারা খোঁটা বা সেলাই করার জন্য উপরের এবং সোল উভয়েই ছিদ্র করত এবং তারপরে একটি ইনসোল এবং বাইরের সোল লাগিয়ে দিত।
মধ্যযুগের জুতা কি দিয়ে তৈরি হতো?, What were medieval shoes made of ?
মধ্যযুগীয় লন্ডনের পাশাপাশি মধ্যযুগীয় ইউরোপের বাকি অংশে জুতা একত্রে সেলাই করা চামড়ার একাধিক স্তর দিয়ে তৈরি করা হতো। এই জুতাগুলি সাধারণত উদ্ভিজ্জ ট্যানড পশুর চামড়া, ভেড়া এবং ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি করা হত প্রথম দিকের মধ্যযুগীয় সময়ে এবং বেশিরভাগ গবাদি পশুর চামড়া থেকে পরবর্তী মধ্যযুগীয় সময়ে।
শেষ কথা, Conclusion :
উপরিউক্ত আলোচনার পর সংক্ষেপে বলা যায় যে, জুতা হল পা’ কে সুরক্ষিত রাখার জন্য ব্যবহৃত আচ্ছাদন। বর্তমানে বিভিন্ন ডিজাইনের জুতো পাওয়া যায়। আজকাল মানুষ ভিন্ন পোশাকের সাথে মানানসই জুতো ব্যবহার করেন। কিন্তু অনেকেই জুতো আবিষ্কারের ইতিহাস হয়তো জানতেন না।
আশা করি আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা জুতো তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।
Frequently Asked Questions :
জুতা আবিষ্কারের কৃতিত্ব কাউকে দেওয়া হয় না কারণ সেগুলো হাজার হাজার বছর আগের।
স্যান্ডেল, হাই হিল, স্নিকার্স, স্লিপারস্, চটি ইত্যাদি।
১৮০০ সালের পরে চামড়ার বদলে সিল্কের কাপড় জুতার উপরিতলের অংশে ব্যবহার করে নারীদের জন্য পৃথক জুতা তৈরি করা হয়।