ভারত-তিব্বত সীমান্তের কাছে উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলার মানা গ্রামটি আগে “ভারতের শেষ গ্রাম” হিসাবে পরিচিত ছিল কিন্তু বর্তমানে এর নাম পরিবর্তন করে “ভারতের প্রথম গ্রাম” করা হয়েছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা এই গ্রামে গিয়ে দিন কখন কেটে যায় বুঝতেই পারবেন না। উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত এই গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় স্রোতস্বিনী সরস্বতী নদী। যারা এই স্থানে ভ্রমণ করে এসেছেন তাদের একবারে মন ভরার কথা নয়, বরং এমন স্থানে বার বার যেতে মন চায়। আজকের এই প্রতিবেদনে মানা গ্রামের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করবো।
‘ভারতের প্রথম গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি, Getting recognition as ‘India’s first village’ :
মানা গ্রাম বহুকাল ধরে ভারত-তিব্বত সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে, এটি পূর্বে “ভারতের শেষ গ্রাম” হিসাবে পরিচিত ছিল এবং এখন সর্বত্রই একে “ভারতের প্রথম গ্রাম” হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
বলা যায় যে, ভারতের অসাধারণ সুন্দর মানা গ্রামের পুনঃব্র্যান্ডিং হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই গ্রামকে ‘ভারতের প্রথম গ্রাম’ নাম দেন। তবে অনেকে একে ভারতের প্রাচীনতম গ্রামও বলে থাকেন।
মানা গ্রামের ইতিহাস, History of Mana Village :
অনেকে বলেন পঞ্চ পাণ্ডবের জন্ম হয় এই গ্রামে। কেউ বলেন এই গ্রাম দিয়েই পাণ্ডবরা স্বর্গারোহণ করেন। গ্রামটিকে ঘিরে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত রয়েছে।
জেনে রাখা ভালো যে ইতিহাসে, মানা গ্রাম ছিল ভারত ও তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্য পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভারত তিব্বতের ইয়াক এবং ছাগলের জন্য মানা পাস দিয়ে তিব্বতের সাথে গম, বার্লি এবং রক লবণের ব্যবসা করত। তবে 1962 সালের যুদ্ধের পর, সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মানা গ্রাম, ভারত-চীন সীমান্ত থেকে চব্বিশ কিলোমিটার দূরে ভারতের প্রথম গ্রাম, এটি তার ইতিহাস এবং পৌরাণিক রহস্যের জন্য জনপ্রিয়।
মানা গ্রামটি নিজেই একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জনবসতি, যার চারপাশে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং এর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তাছাড়া এটি বিভিন্ন ট্র্যাকিং রুটের প্রবেশদ্বার হিসাবেও পরিচিত।
পাশাপাশি চার ধামের এক ধাম বদ্রীনাথ মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় এটি তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
বলতে গেলে মানা গ্রাম একটি ভৌগলিক ল্যান্ডমার্কের চেয়ে বেশি। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 3,200 মিটার (10,500 ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত।
মানা গ্রামের জনগণ, Inhabitants of Mana village :
মানা গ্রামে প্রবেশের পূর্বেই রাস্তায় একটা বড় বোর্ডে লেখা আছে “ India’s first Village Mana ”, যা দেখে মনে যেন একটা আলাদাই আনন্দের সঞ্চয় হয় যে দেশের এমন এক স্থান ভ্রমণে যাচ্ছি যা নাকি দেশের শুরু হিসেবে ধরা যায়। এখানকার প্রকৃতির পাশাপাশি জনগণও খুব শান্ত প্রকৃতির।
সারা গ্রাম ঘিরে বেশ কিছু ছোটো দোকান আছে যেখানে, মহিলা তথা পুরুষ উভয়েই উলের তৈরি গরম কাপড় বিক্রি করছেন, কোথাও চাদর বিক্রি হচ্ছে, আবার কিছু কিছু দোকানে তারা বসে দ্রুত হাত চালিয়ে একের পর এক জিনিস তৈরি করছেন, এমনও দেখা যায়।
বহু পর্যটক এখানে এসে বিভিন্ন জিনিস ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন যা থেকে তাদের আয় হয়। কেউ কেউ আছেন যারা এই গ্রামের সুন্দর পরিবেশকে ক্যামেরায় ধারণ করে রাখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু অবাক করা বিষয় এই যে গ্রামের কোনো মহিলা ক্যামেরায় নিজের চেহারা আসতে দিচ্ছেন না, কারণ হয়তো দর্শনার্থীদের অজানা।
প্রাচীন এই গ্রামটি ভুটিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়ি, উপজাতিদের ঐতিহ্যবাহী পাথরের ঘর, প্রাণবন্ত উৎসব এবং গ্রামবাসীদের উষ্ণ আতিথেয়তা তাদের অনন্য জীবনধারার আভাস দেয়। এখানকার সংস্কৃতি ও খাবারে ভারতীয় ও তিব্বতি সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের প্রভাব আছে।
গ্রামের কিছু দর্শনীয় স্থান, Some tourist spots of the village :
হিমালয় পর্বত দ্বারা বেষ্টিত, মানা প্রকৃতি প্রেমী এবং অভিযাত্রীদের জন্য একটি স্বর্গস্বরূপ। শান্ত পরিবেশ এবং তাজা পাহাড়ি বাতাস শহরের জীবনের তাড়াহুড়ো থেকে এক নিখুঁত বিরতি দেয়।
চারধামের তীর্থস্থানগুলির মধ্যে একটি, শ্রদ্ধেয় বদ্রীনাথ মন্দিরের সান্নিধ্য মানা গ্রামের আধ্যাত্মিক আবেদনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তীর্থযাত্রীরা প্রায়ই ঐশ্বরিক পরিবেশ অনুভব করতে বদ্রীনাথে তাদের যাত্রার সময় মানা গ্রামে যান।
- গ্রামের ঠিক পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে সরস্বতী নদী, যাকে সরস্বতীর উৎস বলে বিশ্বাস করা হয়, এই উৎসের মুখটির পাশেই একটি সরস্বতী মন্দির রয়েছে, যা দর্শন করতে প্রতিবছর বহু শ্রদ্ধালু দূর দূর থেকে এখানে আসেন। মন্দিরটি যেন গ্রামের রহস্যময় আকর্ষণকে বাড়িয়ে তোলে।
- এছাড়াও রয়েছে ভীম পুল, যা নদীর দুপাশের পাহাড়ের মাঝখানে থাকা জলের ধরার উপর দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা তৈরি করে। বিশ্বাস করা হয় যে এই পথ স্বয়ং ভীম পাথর ফেলে তৈরি করেছিলেন। ভীম পুলের চারপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলি মানা গ্রামের একটি মনোরম আকর্ষণ, সরস্বতী নদী সুন্দরভাবে ভীম পুলের নীচে প্রবাহিত হয়, দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
- অন্যদিকে গ্রামটিতে বেশ কয়েকটি প্রাচীন গুহা রয়েছে, যার মধ্যে ব্যাস গুহা এবং গণেশ গুহা রয়েছে, যার নামকরণ করা হয়েছে ঋষি ব্যাসের নামে, বিশ্বাস করা হয় যে তিনি এখানে মহাভারতের রচনা করেছিলেন এবং প্রভু গণেশ, যিনি তাঁর লেখক হিসাবে কাজ করেছিলেন।
- মানা থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি অত্যাশ্চর্য জলপ্রপাত, ভাসুধারা জলপ্রপাত। এই জলপ্রপাতে পৌঁছতে ৫ কিমি ট্রেক করে যেতে হয় এবং এর পথ গ্রামটির মধ্য দিয়েই। বিশ্বাস করা হয় যে এই জলপ্রপাতের ধারা তাদের উপরই পড়ে যারা পাপমুক্ত। দক্ষিন ভারতীয় সিনেমায় এর উল্লেখ অনেকেই হয়তো আগে দেখেছেন। এই জনপ্রিয় ট্রেক সহ বেশ কয়েকটি ট্রেকিং রুটের জন্য গ্রামটি সূচনা পয়েন্ট।
এইসব বিবরণ থেকে বা ছবি দেখে জায়গাটিই সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব নয়। নিজে স্বশরীরে সেখানেই গেলেই বুঝতে পারা যায় কেন এই স্থানটিকে স্বর্গের সাথে তুলনা করা হয়।
কিভাবে মানা পৌঁছাবেন? How to reach Mana?
পাহাড় এবং সবুজ উপত্যকার শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য এবং জলপ্রপাতের সৌন্দর্য প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে উপহার স্বরূপ। এখন আপনাদের মনে নিশ্চই প্রশ্ন আসছে যে, কিভাবে মানা পৌঁছাবেন?
আপনি চাইলে দেশের বা বিদেশের যেকোনো জায়গা থেকে মানা গ্রামে যেতে পারেন। ভারতের প্রথম গ্রামে পৌঁছতে উত্তরাখণ্ডের জোশিমঠ শহর থেকে সহজেই যাওয়া যায়। বলাই বাহুল্য যে, জোশিমঠ উত্তরাখণ্ডের প্রধান শহরগুলির সাথে সড়কপথে ভালভাবে সংযুক্ত।
জোশিমঠ এর নিকটতম বিমানবন্দর হল দেরাদুন, যা প্রায় 300 কিমি দূরে, এবং এর নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন হল ঋষিকেশ, যা প্রায় 270 কিমি দূরে।
এছাড়াও চাইলে আপনি হরিদ্বার রেলস্টেশন অবধি পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি দিয়েও বদ্রিনাথ মন্দিরের পথে অগ্রসর হতে পারেন, তবে যাদের জোশিমঠ থেকে যেতে সুবিধা হবে, তারা গাড়ি করে মানা গ্রামে পৌঁছে যেতে পারবেন এবং সেখানে গিয়ে মনোরম পরিবেশের আনন্দে হারিয়ে যাবেন।
তবে যারা ভ্রমণ করতে যাওয়ার চিন্তা করছেন তারা জেনে রাখা ভালো যে, বদ্রীনাথ মন্দির যে কয়েকমাস বন্ধ থাকে, এই গ্রামটিতেও সেই সময় পর্যটকদের আনাগোনা বন্ধ রাখা হয়।
শেষ কথা, Conclusion :
মানা গ্রামে প্রবেশ করা থেকে শুরু করে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখা অবধি আমার অভিজ্ঞতা ছিল অবর্ণনীয়। দর্শনার্থীদের ভিড় থাকলেও প্রকৃতির মাঝে যেন এক অজানা শান্তি বিরাজ করছিল এই গ্রামে।
এখানকার আবহাওয়াও ছিল মনোরম। আমার বিশ্বাস যে এই অপূর্ব স্থানটিতে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমি যতটা আনন্দ পেয়েছি, আপনারাও ঠিক ততটাই আনন্দ পাবেন। এক কথায় বলতে গেলে প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য উপযুক্ত জায়গা উত্তরাখণ্ডের এই মানা গ্রাম।