সিন্ধু সভ্যতা ব্রোঞ্জ যুগের একটি সভ্যতা যা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিকাশ লাভ করেছিল। এটি ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম নগর সভ্যতার মধ্যে একটি। এই সভ্যতার শহরগুলি, যেমন হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো, সেই সময়ের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে উন্নত শহর ছিল। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন তথ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু সম্পর্কে আলোচনা করবো।
সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ, Development of Indus Civilization :
সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা (IVC), সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত। এটি দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটেমিয়ার সাথে সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা (IVC) ছিল নিকট পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি আদি সভ্যতার একটি এবং উক্ত তিনটির মধ্যে এই সভ্যতাই সবচেয়ে বড়।
পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সিন্ধু নদীর পলল সমভূমিতে এই সিন্ধু সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল যা একসময় উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটি মৌসুমী নদী ঘাগর-হাকরার আশেপাশে প্রবাহিত হয়েছিল।
প্রাচীন সিন্ধু প্রদেশের শহরগুলি তাদের নগর পরিকল্পনা, পোড়া ইটের ঘর, বিস্তৃত নিষ্কাশন ব্যবস্থা, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, বড় অনাবাসিক বাড়ীগুলির ক্লাস্টার এবং হস্তশিল্প ও ধাতুবিদ্যার কৌশলগুলির জন্য বিখ্যাত ছিল।
সিন্ধু সভ্যতার জীবনধারা, Lifestyle of Indus Civilization :
ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকে জানা যায় যে, নদী তীরবর্তী সভ্যতা হওয়ার সুবাদে সিন্ধু সভ্যতা অত্যন্ত শক্তিশালী কৃষিভিত্তিক আর্থিক বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
সিন্ধু সভ্যতায় নাগরিকদের সমাজ জীবন ছিল সুসংগঠিত। সিন্ধু সভ্যতার সুনিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থা একটি সংগঠিত প্রশাসনিক ও শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে রচিত হয়।
সিন্ধু সভ্যতার অবিস্কারের পর এর সুবৃহৎ প্রাসাদ সমূহ, অট্টালিকা, দূর্গ, শস্য মজুদ রাখার জন্য শস্যাগার ইত্যাদি নিদর্শন থেকে এই সভ্যতার জীবনধারা কেমন ছিল সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
সিন্ধু সভ্যতার অবদান তথা সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব, Contribution of Indus Civilization and Sociological Importance :
সিন্ধু সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক কাঠামো রূপায়নে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখেছে। সিন্ধু সভ্যতার অবদান তথা সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো-
১. সামাজিক অবস্থা :
সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে প্রাপ্ত বিভিন্ন অলংকার, স্বর্ণ, রৌপ্য, ইলেকট্রাম প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু এবং অপেক্ষাকৃত কম মূল্যবান ধাতু, যেমন- ব্রোঞ্জ, তামা ইত্যাদি দ্রব্য। এগুলো প্রমাণ করে যে, সিন্ধু সভ্যতার জনসাধারণ বিভিন্ন অর্থনৈতিক পেশায় ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল।
এই সভ্যতায় প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো থেকে তাদের কৃষি, বয়নশিল্প, মৃৎপাত্র, ইট তৈরি, স্বর্ণকার, কর্মকার, কুমার প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
২. সামাজিক শ্রেণি :
সিন্ধু সভ্যতার খননকার্যের ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে সেকালের সামাজিক শ্রেণিভেদ সম্পর্কে জানা যায়। মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে ৪টি শ্রেণীর তথ্য পাওয়া যায়। যথা:
- শিক্ষিত শ্রেণি: শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে ছিল পুরোহিত, চিকিৎসক, জ্যোতিষী এবং জাদুকর গোষ্ঠী।
- যোদ্ধা শ্রেণি: যোদ্ধা শ্রেণির মধ্যে ছিল দুর্গের দ্বাররক্ষী, যুদ্ধের সৈনিকগণ। জনসাধারণকে রক্ষা করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ।
- ব্যবসায়ী ও কারিগর: ব্যবসায়ী ও কারিগর শ্রেণিতে বিভিন্ন পেশার লোক ছিল। যেমন- রাজমিস্ত্রী, লিপিকার, শাঁখারি, স্বর্ণকার, তাঁতি, ছুতার ইত্যাদি।
- শ্রমজীবী শ্রেণি: শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে ছিল গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিক, চর্মকার, জেলে, কুটির শিল্পের শ্রমিক, কৃষক, মুটে ইত্যাদি।
৩. সভ্যতার অর্থনৈতিক অবস্থা :
প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনসমূহের যথেষ্ট সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতার মূল বুনিয়াদ কৃষি ও ব্যবসায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। তারা কৃষি জমিতে গম, যব, বার্লি ইত্যাদি উৎপাদন করত। এছাড়াও সবজি, দুধ, মাছ, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদির মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত।
৪. সভ্যতার রাজনৈতিক অবস্থা :
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক লিপিসমূহের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নি বলে তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থার সঠিক চিত্র পাওয়া যায়নি।
তবে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও অট্টালিকা নির্মাণের কৌশল দেখে ইতিহাসবত্তোরা মনে করেন যে এই সভ্যতা এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অধীনে ছিল।
৫. বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা :
সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্গত হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় তারা পাটিগণিত সম্বন্ধে জানত। নগরীর নগর পরিকল্পনায় যে দক্ষতা দেখিয়েছে তাতে তাদের জ্যামিতির জ্ঞান ছিল বলে ধারণা করা হয়।
তাম্র ও টিন মিশ্রিত করে ব্রোঞ্জ এবং স্বর্ণ ও রৌপ্য মিশ্রিত করে ইলেকট্রাম তৈরির মধ্য দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার বিজ্ঞানীগণ ধাতু সম্পর্কিত দক্ষতার পরিচয় দেয়।
৬. সিন্ধুবাসীদের খাদ্যাভ্যাস :
সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন ধারণা দেয় যে সিন্ধুবাসীদের প্রধান খাদ্য ছিল গম। তারা বিভিন্ন পশুর মাংস খেত, যেমন- গরু, ছাগল, শূকর, হাঁস, মুরগি, কচ্ছপ ইত্যাদি। যব ও খেজুর তাদের প্রিয় খাদ্য ছিল। সিন্ধুবাসীরা বিভিন্ন ধরনের মাছ, সবজি ও ফল খেত বলেও অনুমান করা হয়।
৭. সিন্ধুবাসীদের পোশাক-পরিচ্ছদ :
সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর লোকদের পরিহিত পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরিতে প্রধানত সুতা ও পশম ব্যবহার করত। তখনকার দিনে দুই পার্টবিশিষ্ট পোশাকের প্রচলনই ছিল বেশি।
৮. সিন্ধুবাসীদের ধর্মীয় অবস্থা :
সিন্ধু সভ্যতার ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে অনুমান করা হয়, সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচলিত ছিল।
খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত অসংখ্য টেরাকোটার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মূর্তি থেকে ধারণা করা হয় যে, সিন্ধুবাসীরা মাতৃপূজা করত।
সিন্ধু সভ্যতার শিল্প, Art of the Indus Civilization :
সিন্ধু সভ্যতার খননস্থলে বিভিন্ন ভাস্কর্য, সীলমোহর, ব্রোঞ্জের পাত্র, মৃৎপাত্র, সোনার গহনা এবং পোড়ামাটির, ব্রোঞ্জ এবং স্টেটাইটে শারীরবৃত্তীয়ভাবে বিশদ মূর্তি পাওয়া গেছে।
হরপ্পানরা বিভিন্ন খেলনা তৈরি করত, যার মধ্যে কিউবিকাল ডাইস (এক থেকে ছয়টি ছিদ্রযুক্ত) পাওয়া গেছে। এই সভ্যতার পোড়ামাটির মূর্তিগুলির মধ্যে ছিল গরু, ভালুক, বানর এবং কুকুর ইত্যাদি। তাছাড়া সোনা, রূপার বিভিন্ন অলংকার তৈরিতেও তারা পারদর্শী ছিল।
সিন্ধু সভ্যতায় বিভিন্ন ধরনের ও বর্ণের মৃৎপাত্র তৈরি হতো। সিন্ধু সভ্যতায় পাথর ও ব্রোঞ্জের তৈরি প্রচুর ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। তাদের পাথরের ভাস্কর্যগুলো হলো- চুনাপাথরের মূর্তি, শ্মশ্রুমণ্ডিত আবক্ষ মূর্তি, নৃত্যরত নারী মূর্তি ইত্যাদি।
প্রাচীন সিন্ধু উপত্যকার মানুষের আকর্ষণীয় বিষয় কি, What is interesting about ancient Indus Valley people?
সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা, যা হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত, প্রথম সঠিক মান ও পরিমাপের পদ্ধতি তৈরি করেছিল।
তাছাড়াও হরপ্পানরা টেরাকোটা, ধাতু এবং পাথরের মতো উপকরণ থেকে ভাস্কর্য, সীলমোহর, মৃৎপাত্র এবং গয়না তৈরি করেছিল।
সিন্ধু সভ্যতা কে আবিষ্কার করেন, Who discovered the Indus civilization?
জন মার্শাল নামে একজন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ 1900 এর দশকের গোড়ার দিকে সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কার করেছিলেন। তারপর থেকে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই প্রাচীন সংস্কৃতির আরও বেশি সংখ্যক প্রমাণ উন্মোচন করেছেন, যা এখন 3300 খ্রিস্টপূর্বাব্দের বলে মনে করা হয়।
সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার বয়স কত, How old is the Indus Valley Civilization?
সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা (IVC), সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত, দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা, যা 3300 BCE থেকে 1300 BCE পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এবং এর পরিপক্ক আকারে 2600 BCE থেকে 1900 BCE পর্যন্ত।
সিন্ধু সভ্যতা কিসের জন্য পরিচিত ছিল, What was the Indus Civilization known for?
সিন্ধু সভ্যতার শহরগুলি তাদের নগর পরিকল্পনার জন্য বিখ্যাত যা জমির ব্যবহার এবং নগর পরিবেশের নকশা সম্পর্কিত একটি প্রযুক্তিগত এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
তারা তাদের পোড়া ইটের ঘর, ব্যাপক নিষ্কাশন ব্যবস্থা, জল সরবরাহ ব্যবস্থাগুলির জন্যও সুপরিচিত।
সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ কী ছিল, What was the cause of the destruction of the Indus civilization?
সিন্ধু সভ্যতা 1900 খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে হ্রাস পেতে শুরু করে বলে ধারণা করা হয়।
ঐতিহাসিক কিছু তত্ত্ব পরামর্শ দেয় যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বন্যার মতো পরিবেশগত কারণগুলি সভ্যতার পতনে অবদান রাখতে পারে, অন্যরা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামাজিক অস্থিরতার মতো অভ্যন্তরীণ কারণগুলির দিকে ইঙ্গিত করে।
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন যে এলাকার ভূগোল ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটে। পৃথিবীর ভূত্বক স্থানান্তরের ফলে সিন্ধু বন্যা হতে পারে এবং দিক পরিবর্তন করতে পারে।
সিন্ধু উপত্যকায় কারা বাস করতেন, Who lived in the Indus Valley?
ইতিহাসবিদদের মতে, সিন্ধি জনগণ পাকিস্তানের দীর্ঘতম নদী সিন্ধু নদীর তীরে বসবাস করতেন।
সিন্ধু নদী হিমালয় পর্বতশ্রেণী থেকে উৎপন্ন হয় এবং প্রায় 3,000 কিলোমিটার আরব সাগরে প্রবাহিত হয়। নদীটি নিচের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে একটি উপত্যকা তৈরি করে।
শেষ কথা, Conclusion :
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় যে, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতা স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। পতন সত্ত্বেও, সিন্ধু সভ্যতা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। এর উত্তরাধিকার আধুনিক পাকিস্তান ও ভারতের ভাষা, ধর্ম এবং শিল্পে দেখা যায় এবং এর নগর পরিকল্পনা এবং জল ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
Frequently Asked Questions :
1900 এর দশকের গোড়ার দিকে।
জন মার্শাল নামে একজন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ।
এটি দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা, যা 3300 BCE থেকে 1300 BCE পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এবং এর পরিপক্ক আকারে 2600 BCE থেকে 1900 BCE পর্যন্ত।