ঐতিহাসিকভাবে পারস্য এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র ইরান হল পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশ। ইরান বিশ্বের ১৭তম সর্বাধিক জনবহুল দেশ। আজ আমাদের প্রতিবেদনে আমরা ইরান দেশের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
ইরানের ভৌগোলিক অবস্থান, Geographical Location of Iran :
১৬,৪৮,১৯৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং পৃথিবীর সপ্তদশ বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইরানের উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান, উত্তর দিকে আছে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে তুর্কমেনিস্তান, পূর্বে আছে আফগানিস্তান, দক্ষিণ-পূর্ব অংশে রয়েছে পাকিস্তান, দক্ষিণে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগর এবং পশ্চিম দিকে তুরস্ক ও ইরাক অবস্থিত। দেশটি ভূকৌশলগতভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি ইউরেশিয়ার কেন্দ্রে এবং হরমুজ প্রণালীর নিকটে অবস্থিত।
ইরানের রাজধানী, Capital of Iran :
- ইরানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর তেহরান।
- তেহরান ইরানের অগ্রগামী অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
- তেহরান পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল শহর, এখানকার জনসংখ্যা ৮.৮ মিলিয়ন এবং মহানগর অঞ্চল মিলিয়ে এই শহরের জনসংখ্যা ১৫ মিলিয়নেরও বেশি।
ইরানের ইতিহাস, History of Iran :
ইরান বিশ্বের পর্বতময় দেশগুলি মধ্যে একটি; এখানে হিমালয়ের পর এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দামভান্দ অবস্থিত। দেশটির জনগণ জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র। তবে এখানে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে প্রায় সবাই মুসলিম।
অন্যদিকে ইরানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার আছে, একথা সকলেরই জানা বিষয়। ইরানে তেল রপ্তানি ২০শ শতকের শুরু থেকে দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
বর্তমান ইরান খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য পারস্যের কেন্দ্র ছিল। প্রায় ২০০০ বছর ধরে এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ নিজের দেশকে “ইরান” নামেই ডাকত। কিন্তু গ্রিকরা এই অঞ্চলকে ইরান বলে সম্বোধন না করে বরং পার্সিস নামে ডাকত। সেখান থেকেই ইউরোপীয় ভাষায় এ অঞ্চলের নাম হয় পার্সিয়া, যা ক্রমে পারস্য হিসেবে পরিচিত হয়।
১৯৩৫ সালে ইরানের শাসক দেশটিকে “ইরান” বলে সম্বোধন করার অনুরোধ জানানোর পর থেকে দেশটি এই নামেই সারা বিশ্বে পরিচিত হয়। ১৫০১ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্রী ইরান হয় শাহ কিংবা রাজারা শাসন করতেন। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং ইরানে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে।
ইরানের রাজনীতি, Politics of Iran :
এ বিষয়ে হয়তো কারোরই অজানা নয় যে, ইরানের রাজনীতি ইসলামি প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় সংঘটিত হয়। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে এদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। ১৯৮৯ সালের সংবিধান সংশোধনী ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। আলি খামেনেই বর্তমানে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। আর সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রাইসি দেশটির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। এছাড়া এদেশে ২৯০ সদস্যবিশিষ্ট এককাক্ষিক আইনসভা রয়েছে।
ইরানের সামরিক বাহিনী, Iranian Military :
ইরানে দুই ধরনের সেনাবাহিনী রয়েছে। সেগুলি হল :
- প্রথাগত সেনাবাহিনী ও
- বৈপ্লবিক সুরক্ষা বাহিনী।
ইরানের সেনাবাহিনী :
ইরানের সেনাবাহিনীতে ৪ টি ভাগ রয়েছে। সেগুলি হল:
- ভূ সেনা ,
- নৌ সেনা ,
- বায়ু সেনা এবং
- আকাশ প্রতিরক্ষা সেনা।
ইরানের প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহ, Administrative Regions of Iran :
ইরান ১৯৫০ সাল অবধি ১২টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল, সেগুলি হল :
- আর্দালান,
- আজারবাইজান,
- বালুচিস্তান,
- ফারস,
- জিলান,
- আরাক-ই-আজম,
- খোরাসান, খুজেস্তান,
- কেরমান, লারেস্তান,
- লোরেস্তান এবং
- মাজান্দারান।
তারপর যখন ইরানকে ১৯৫০ সালে ১০ টি প্রদেশে ভাগ করা হয়। প্রদেশগুলোর অধীনে অনেকগুলো গভর্নরেটে হয়। প্রদেশগুলোর নাম হল : গিলান; মাজান্দারান; পূর্ব আজারবাইজান; পশ্চিম আজারবাইজান; কের্মানশাহ; খুজেস্তান; ফার্স; কের্মান; খোরাসান; ইসফাহান।
১৯৬০ সাল থেকে ১৯৮১ সাল অবধি অনেকগুলো গভর্নরেটকে প্রদেশে উন্নীত করা হয়। ২০০৪ সালে সর্ববৃহৎ খোরাসান প্রদেশকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় যা তিনটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করে।
ইরানের জনমিতি, Population of Iran :
২০০৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ইরানের জনসংখ্যা ৭,০০,৪৯,২৬২। এছাড়াও ইরানের বাইরে প্রবাসে আরও প্রায় ৪০ লক্ষ ইরানি নাগরিক বসবাস করেন। দেশের প্রবাসী নাগরিকগণ মূলত উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, তুরস্ক, পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ এবং অস্ট্রেলিয়াতে বাস করেন। ইরানের জাতিগুলি সিআইএ ফ্যাক্টবুক অনুসারে নিম্নরূপ :
- পারসিক জাতি ৫১%,
- আজেরি জাতি ২৪%,
- গিলাকি জাতি ও মাজান্দারানি জাতি ৮%,
- কুর্দি জাতি ৭%,
- আরব জাতি ৩%,
- লুর জাতি ২%,
- বেলুচি জাতি ২%,
- তুর্কমেন জাতি ২% এবং
- অন্যান্য ১%।
ইরানের ধর্মীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত, Details about Iran’s religious community :
ইরানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং রাষ্ট্রীয় মাজহাব ইসনা আশারিয়া জাফরি। এছাড়া হানাফি, মালিকি, শাফিঈ, হাম্বলি ও জায়েদি মাজহাব দেশটিতে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত।
ইরানের ধর্মসমূহ :
- ইসলাম : ৯৯.৩৯৮৯%
- খ্রিস্টধর্ম : ০.১৫৬৬%
- জরথুস্ত্রবাদ : ০.০৩৩৬%
- ইহুদিধর্ম : ০.০১১৭%
- অন্যান্য : ০.০৬৫৩%
ইরানের মুসলিম সম্প্রদায়ের শিয়া মুসলমান ৯৫% এবং সুন্নি ৫%। অন্যদিকে খ্রিস্টধর্ম, ইহুদিধর্ম ও জরথুস্ত্রবাদ ইরানের স্বীকৃত সংখ্যালঘু ধর্ম।
ঐতিহাসিকভাবে, প্রাচীন ইরানি ধর্মসমূহের মধ্যে রয়েছে :
- আদি-ইরানি ধর্ম
- জরথুস্ত্রবাদ ও ম্যানিকেইজম, (আকামেনীয়, পার্থীয় ও সাসানীয় যুগের প্রভাবশালী ধর্ম)
জেনে রাখা ভালো যে, ষোড়শ শতাব্দীতে সফবীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক শিয়া মতবাদে ধর্মান্তরকরণের পূর্ব সময়ে ইরান একটি সুন্নিপ্রধান দেশ ছিল। তবে বর্তমান সময়ে ইরানের ৪ থেকে ৮ শতাংশ লোক সুন্নি মুসলমান (অধিকাংশই কুর্দি ও বেলুচি); বাকি ২% অমুসলিম সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জনগণ, কিছু ইহুদি, আবার কিছু অংশ বাহাই, মান্দীয়, ইয়াজিদি, ইয়ারসানি, জরথুস্ত্র প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক।
- ইরানের বৃহত্তম (স্বীকৃত নয়) সংখ্যালঘু ধর্ম হল ইয়ারসানবাদ। এটি জরথুস্ত্রবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইয়ারসানিরা মূলত গোরানি কুর্দি ও নির্দিষ্ট লুরস জনগোষ্ঠীর লোক এবং তাদের বসবাস কুর্দিস্তান, কেরমানশাহ ও লোরেস্তান প্রদেশে।
- ইরানে ইহুদিধর্মের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এখনও ইরানে প্রায় ৮,৭৫৬ থেকে ২৫,০০০ সংখ্যক ইহুদি রয়েছে।
- ইরানে প্রায় ২৫০,০০০ থেকে ৩৭০,০০০ খ্রিস্টান বসবাস করে। ইরানি খ্রিস্টানদের বেশিরভাগই আর্মেনীয় এবং একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসিরীয়।
- বাহাই ধর্ম ইরানে সরকারিভাবে স্বীকৃত নয় বলে এরা প্রায়ই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়।
ইরানের সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু তথ্য, Some facts about Iranian culture :
ইরানের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং এর ঐতিহাসিক দীর্ঘস্থায়িত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট হল সারগ্রাহী সাংস্কৃতিক স্থিতিস্থাপকতা। ইরানের সংস্কৃতি পারসিক সংস্কৃতি হিসেবেও পরিচিত। এটি সারা বিশ্বের অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানকে সভ্যতার দোলনা হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিশ্বে ইরানের আধিপত্য বিস্তারকারী ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে আছে, যার কারণে ইরান পশ্চিমে ইতালি, ম্যাসিডোনিয়া, ও গ্রিস, উত্তরে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণে আরব উপদ্বীপ এবং পূর্বে ভারত উপমহাদেশ ও পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ও জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
ইরানের শিল্পকলার ইতিহাস, History of Iranian Art :
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শিল্প-ঐতিহ্য হল ইরানের শিল্প। বলাই বাহুল্য যে, এটি সমৃদ্ধ ও বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী। ইরানের শিল্পকলার আওতায় রয়েছে সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, স্থাপত্যকলা, চিত্রাঙ্কন, বুনন, মৃৎশিল্প, হস্তলিপিবিদ্যা, ধাতব ও পাথুরেকর্ম সহ অসংখ্য শাখা।
ইরানের অদ্বিতীয় নান্দনিকতার প্রমাণ হল ইরানি শিল্পকলার বিবর্তন। উক্ত শিল্প-ঐতিহ্য বিবর্তনের পর্যায়সমূহ এলামাইট চোগা জানবিল থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ও পার্সেপোলিসের হাখমেনীয় কারুশিল্প থেকে বিশাপুরের মোজাইক পর্যন্ত বিস্তৃত।
ইরানে ব্যবহৃত ভাষা, Languages spoken in Iran :
ইরানে মূলত তিনটি ধরনের ভাষা প্রচলিত:
- ইরানীয় ভাষাসমূহ,
- তুর্কীয় ভাষাসমূহ এবং
- সেমিটীয় ভাষাসমূহ।
ইরানীয় ভাষাপরিবারের সদস্য ভাষাগুলি এই দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হল উক্ত ভাষা ব্যবহারকারী জনগণ। এই ভাষার অন্তর্গত ফার্সি ভাষা হল ইরানের প্রধানতম ভাষা। ফার্সি হল ইরানের জাতীয় ভাষা।
পশ্চিম ইরানে অন্যান্য ইরানীয় ভাষাগুলির মধ্যে কুর্দী ভাষা, উত্তর-পশ্চিমে তাতি ওতালিশি ভাষা, এলবুর্জ পর্বতমালার উত্তরে মাজান্দারানি ও গিলাকি ভাষা, ও দক্ষিণ-পূর্ব ইরানে বেলুচি ভাষা অন্যতম।
এই দেশে প্রচলিত তুর্কীয় ভাষাগুলির মধ্যে রয়েছে উত্তর-পশ্চিমের আজারবাইজানি ভাষা এবং উত্তর-পূর্বের তুর্কমেন ভাষা প্রধান।
এছাড়াও সেমিটীয় ভাষাপরিবারের আরবি ভাষা ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে খুজেস্তান প্রদেশে এবং পারস্য উপসাগরের উপকূল ধরে প্রচলিত।
ইরানের খেলাধুলা, Sports of Iran :
ইরানের খেলাধুলা নিয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয় যে, পোলো খেলার প্রচলন ইরানেই প্রথম শুরু হয়। ইরানে অবস্থিত ইসফাহানের নকশ-ই জাহান স্কোয়ারটি মধ্যযুগীয় রাজকীয় পোলো মাঠের স্থান।
শেষ কথা, Conclusion :
উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা ইরান দেশের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনারা উল্লেখিত তথ্যগুলোর মাধ্যমে দেশটি সম্পর্কে বিশদ ধারণা পেয়েছেন।
Frequently Asked Questions :
ইরানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর তেহরান যা দেশটির অগ্রগামী অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও বটে।
ইরান কি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ?
ইরান হচ্ছে পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশ।
ইরানের সামরিক কাঠামো তিনটি শাখায় বিভক্ত, আয়াতুল্লাহ “আলি খামেনি’কে কমান্ডার-ইন-চীফ হিসাবে বিভক্ত করা হয়েছে: ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরান আর্মি (দ্য আর্টেশ), ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC) এবং বাসিজ প্রতিরোধ বাহিনী।