বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বাংলা ক্যালেন্ডার নামটির সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি ও আবেগ। প্রাচীনকাল থেকে বাঙালির দিনলিপির গণনাসমূহ বহু ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা অঞ্চলের নানা রীতি। কিন্তু কীভাবে এলো বাংলা বর্ষপঞ্জি, এর শুরুটাই বা কোথা থেকে! এসবকিছু জেনে নেব আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে।
বর্ষপঞ্জি বলতে কি বুঝ? What do you mean by calendar?
বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ হলো দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গ অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি সৌর বর্ষপঞ্জি। বর্ষপঞ্জিটির একটি সংশোধিত সংস্করণ বাংলাদেশের জাতীয় ও সরকারি বর্ষপঞ্জি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যে বর্ষপঞ্জিটির পূর্ববর্তী সংস্করণ অনুসরণ করা হয়।
বঙ্গাব্দ, বাংলা সন বা বাংলা বর্ষপঞ্জি হল বঙ্গদেশের একটি ঐতিহ্য মণ্ডিত সৌর পঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌরদিন গণনা শুরু হয়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাই এক সৌর বছর।
বাংলা বর্ষপঞ্জি কে চালু করেন? Who introduced Bengali calendar?
কারোর মতে ৭ম শতাব্দীর হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনকারী, আবার কারোর মতে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কিংবা মুঘল সম্রাট আকবর বাংলায় প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জির সাথে চান্দ্র ইসলামি বর্ষপঞ্জি (হিজরি) একত্রিত করে তৈরি করেছিলেন।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উল্লেখ রয়েছে যে, বাংলা বর্ষপঞ্জি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন। কিছু ইতিহাসবিদ বাংলা ক্যালেন্ডারের আবিস্কারক হিসেবে 7 ম শতাব্দীর বাঙালি রাজা শশাঙ্ককে দায়ী করেন।
আকবর সম্রাটের আদেশ মতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে।
অন্যদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলা বছর গণনা ১ থেকে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে ৯৬৩ থেকে। সে হিসেবে বাংলা বর্ষপঞ্জির বয়স মাত্র ৪৬২ বছর। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরবর্তীতে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
বাংলা বর্ষপঞ্জি কি কাজে ব্যবহার হয়? What is the use of the Bengali calendar?
বাংলা বর্ষপঞ্জি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন। এই নতুন বর্ষপঞ্জিটি প্রথমে তারিখ-ই-এলাহী নামে পরিচিত ছিল; ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। বাংলা সনকে বঙ্গাব্দ বলা হয়।
ইংরেজী ক্যালেন্ডার দেখে যেমন ইংরেজী সালের মাস, দিন, তারিখ, বিভিন্ন উৎসব এসব জানা যায়, ঠিক সেইরকমই বাংলা বর্ষপঞ্জীর (বাংলা সনের ক্যালেন্ডার) মাধ্যমে বাংলা সনের মাস, দিন, তারিখ, তিথি, নক্ষত্র, বিভিন্ন উৎসব, পূজাপার্বন, নানা ধরণের শুভ কাজ যেমন নবজাতকের অন্নপ্রাশনের দিন, গৃহ প্রবেশের জন্য ভালো দিন, নতুন বাহন ক্রয়ের জন্য শুভ দিন, বাড়ী থেকে অন্য কোনো স্থানে যাত্রা করার শুভ দিন, মুহূর্ত, বিয়ের শুভ দিন, লগ্নের সময়, ইত্যাদি জানা যায়।
বাংলা বর্ষপঞ্জি কীভাবে এলো? How did the Bengali calendar originate?
পৃথিবীর জলবায়ু নির্ভর করে সূর্যের ওপর। সূর্যের আলো ও তাপ পেয়েই পৃথিবীর বুকে ফসল ফলে। সূর্যের অবস্থানের কারণেই ঋতুর পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফসল পাওয়া যায়। তাই পঞ্জিকা সূর্যনির্ভর হলে বাস্তব কাজকর্মে, বিশেষ করে কৃষিকাজে অনেক সুবিধা হয়। এই বিষয়টিই সম্রাট আকবরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মুঘল শাসনামলে ইসলামি হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বাঙালিদের কাছ থেকে ভূমি কর আদায় করা হতো। এই বর্ষপঞ্জি একটি চান্দ্র বর্ষপঞ্জি ছিল এবং এর নতুন বছরটি সৌর কৃষি চক্রের সাথে মিলতো না।
কিছু সূত্র অনুসারে আকবর রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লাহ শিরাজিকে চান্দ্র ইসলামি বর্ষপঞ্জি ও সৌর হিন্দু বর্ষপঞ্জিকে একত্রিত করে একটি নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে বলেন এবং এটি ফসলি সন (ফসলি বর্ষপঞ্জি) নামে পরিচিত ছিল।
বহুকাল ধরে বাংলা ক্যালেন্ডার বাঙালিদের সাংস্কৃতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি নতুন বছরের সূচনা এবং নববর্ষের প্রতিষ্ঠা উপলক্ষের মাধ্যমে মানুষকে একত্রিত করে। এছাড়াও, এতে রাষ্ট্রীয় এবং ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
বাংলা ক্যালেন্ডারে বছরের প্রতিটি মাসের জন্য বিশেষ উৎসব এবং ছুটি থাকে। পহেলা বৈশাখ, শুভ নববর্ষ উৎসব, রমজান, দুর্গাপূজা, ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আজহা, ক্রিসমাস, নবান্ন, পহেলা ফাল্গুন ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ধরনের উৎসব উদযাপিত হয়।
এই ক্যালেন্ডারে আয়োজিত উৎসব ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও ঐতিহাসিক পরিচয় সংরক্ষিত। এটি দেশের মানুষের জীবনে আনন্দ ও উদ্দীপনা যোগ করে, তাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করে এবং একই সাথে নতুন প্রজন্মকে বাঙালিদের তথা বাংলা বর্ষপঞ্জির ঐতিহাসিক পরিচয় সম্পর্কে শিক্ষা দেয়।
বাংলা বর্ষপঞ্জি কিভাবে কাজ করে? How does the Bengali calendar work?
বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমণ্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ “সূর্যসিদ্ধান্ত” থেকে। বঙ্গাব্দ বা বাংলা পঞ্জিকায় প্রথম মাস বৈশাখ থেকে শুরু হলেও হিন্দু পঞ্জিকায় তা শুরু হয় চৈত্র থেকে।
বাংলা বছরের ১২টি মাসের দিনসংখ্যা নিম্নরূপ, Day numbers of 12 months of Bengali year:
- বৈশাখ : ৩১ দিন
- জ্যৈষ্ঠ : ৩১ দিন
- আষাঢ় : ৩১ দিন
- শ্রাবণ : ৩১ দিন
- ভাদ্র : ৩১ দিন
- আশ্বিন : ৩০ দিন
- কার্তিক : ৩০ দিন
- অগ্রহায়ণ : ৩০ দিন
- পৌষ : ৩০ দিন
- মাঘ : ৩০ দিন
- ফাল্গুন : ২৯ দিন (লিপ ইয়ারে ৩০ দিন)
- চৈত্র : ৩০ দিন
বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের কাজ, Reform of Bengali Calendar :
বাংলা ক্যালেন্ডার সংশোধনের কাজ 1952 সালে প্রথম ভারতে শুরু হয়। ভারত সরকার একজন বাংলাদেশী সন্তান তথা বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে একটি ক্যালেন্ডার সংশোধন কমিটি গঠন করে। ক্রমে 1963 সালে এই সংস্কারটি ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সঞ্চালনা করেন। মেঘনাদ সাহার মতে, বৈশাখ থেকে ভাদ্র 31 দিনে, আশ্বিন থেকে চৈত্র 30 দিনে এবং অধিবর্ষে চৈত্র মাসে একটি দিন যুক্ত হয়। এর আগে, বাংলা ক্যালেন্ডার শুধুমাত্র চান্দ্র ক্যালেন্ডারের উপর ভিত্তি করে ছিল এবং এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে নতুন বর্ষপঞ্জি।
বাংলা সন চালু হয় কবে থেকে? Since when Bangla year started?
আকবর ৯৬৩ হিজরি, ১০ রবিউল আউয়াল, শুক্রবার অনুসারে ১৪৭৯ শকাব্দ ও ইংরেজি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। যেহেতু ওই বছর হিজরি ৯৬৩ সাল ছিল, তাই ওই সালটিকে ৯৬৩ বঙ্গাব্দ ধরে সন গণনা শুরু করা হয়, অর্থাৎ বাংলা সন শুরু হয়েছে ৯৬৩ বঙ্গাব্দ থেকে।
বাংলা কোন মাস কত দিনে? How many days are there in a Bengali month?
বৈশাখ থেকে ভাদ্র — এই পাঁচ মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে। আশ্বিন থেকে চৈত্র — এই সাত মাস ৩০ দিন গণনা করা হবে। অধিবর্ষে চৈত্র মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে।
বাংলা সনের মূল নাম কি ছিল? What was the original name of the Bengali year?
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
কোন বাংলা মাসে ৩২ দিন থাকে? Which Bengali month has 32 days?
বাংলা ক্যালেন্ডারে, মাসগুলি সাধারণত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মতো 30 বা 31 দিন থাকে। বাংলা ক্যালেন্ডারে 32 দিন সহ কোন মাস নেই।
বাংলা বছর কত দিনে হয়? How many days are there in the Bengali year?
বর্ষপঞ্জির মাসগুলো নির্ধারিত হয় সূর্যের প্রকৃত আবর্তনকে ভিত্তি করে। এই বর্ষপঞ্জিতে বর্ষ সংখ্যা হতে সাত বিয়োজন করে তা ৩৯ দিয়ে ভাগ করতে হয়। যদি ভাগশেষ শূন্য হয় বা ৪ দিয়ে বিভাজ্য হয় তাহলে সে বর্ষটিকে অধিবর্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং ৩৬৬ দিনের এই বর্ষের চৈত্র মাস ৩১ দিনের হয়। প্রতি ৩৯ বছরে ১০ টি অধিবর্ষ হয়।
বলা যায় যে, বাংলা সালের দৈর্ঘ্য হয় ৩৬৫ দিন। কিন্তু পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড লাগে। এই ঘাটতি দূর করার জন্য গ্রেগরিয়ান সালে প্রতি চার বছর পর পর ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে একদিন যোগ করা হয় (শুধু যে শত বছর ৪০০ দিয়ে ভাগ হয় সে বছর যোগ করা হয় না)।
শেষ কথা, Conclusion :
আশা করি আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা বাংলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। বলাই বাহুল্য যে এই বাংলা সনগুলো বাঙালিদের বিভিন্ন পার্বণ তথা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সাক্ষী হয়ে আছে, তাই আজও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
Frequently Asked Questions
বাংলা সালের দৈর্ঘ্য ৩৬৫ দিন, বর্ষটিকে অধিবর্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং ৩৬৬ দিনে।
বাংলা ক্যালেন্ডারে 32 দিন সহ কোন মাস নেই।
বাংলা সন শুরু হয়েছে ৯৬৩ বঙ্গাব্দ থেকে।