ইসরায়েলের দাবীকৃত মধ্যপ্রাচ্যের পবিত্র শহর হল জেরুসালেম। শহরটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্যে ভূমধ্যসাগর ও মৃত সাগরের মধ্যবর্তী যোধাইয়ান পর্বতের নিচু মালভূমিতে অবস্থিত। এটি একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় শহর। শহরটি কিছু ধর্মের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে, ইব্রাহিমীয় ধর্মের ইহুদী ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম।
ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয় দেশই জেরুসালেমকে নিজের রাজধানী বলে দাবি করে। তাই শহরটি একটি পবিত্র শহর হিসেবেও বিবেচিত। আজ আমাদের এই প্রতিবেদনে আমরা জেরুসালেম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
জেরুসালেমের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় জেনে নিন, Know some important things about Jerusalem: :
১) জেরুসালেমের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য :
- টাওয়ার অফ ডেভিড
- সিয়োন চত্বর
- কর্ডস সেতু
- মামিল্লা মল
- পশ্চিম প্রাচীর
- কিতাবের মাজার
- পবিত্র সমাধি
২) স্থানাঙ্ক: ৩১°৪৭′ উত্তর ৩৫°১৩′ পূর্ব
৩) পরিচালিত : ইসরায়েল দ্বারা
৪) ফিলিস্তিনের গভর্ণরেট : কুদস
৫) গিহন স্প্রিং সভ্যতা : ৩০০০–২৮০০ খ্রিষ্টপূর্ব
৬) পূর্ব-পশ্চিম জেরুসালেম বিভাজন : ১৯৪৮ সালে
৭) পুনর্মিলন : ১৯৬৭ সালে
৮) সরকার
• ধরন : মেয়র–কাউন্সিল
• শাসক : জেরুসালেম পৌরসভা
• ইসরায়েলী মেয়র : মোশে লিওন (লিকুদ)
৯) আয়তন
• শহর : ১২৫.১৫৬ বর্গকিমি (৪৮.৩২৩ বর্গমাইল)
• মহানগর : ৬৫২ বর্গকিমি (২৫২ বর্গমাইল)
১০) উচ্চতা : ৭৫৪ মিটার (২,৪৭৪ ফুট)
১১) জেরুসালেমের জনসংখ্যা বিষয়ক ইতিহাস (২০১৭) :
• ইহুদি : ৬০.৮%
• আরব : ৩৭.৯%
• অন্যান্য : ১.৩%
জেরুসালেমের জনসংখ্যা, Population of Jerusalem :
৫,০০০ বছরের ইতিহাসে জেরুসালেমের জনসংখ্যা বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। মধ্যযুগ থেকেই এর পুরানো শহরটিতে বাসকারী জনসংখ্যা ইহুদি, মুসলিম, খ্রিস্টান ও আর্মেনীয় এই চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে।
১৯০৫ সালের পূর্বের সময়কালের জনসংখ্যার তথ্য অনুমান করে জানা যায় যে, ক্রুসেড যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুসলমানরা জেরুসালেমের বৃহত্তম গোষ্ঠী ছিল।
ক্রমে ১৮৩৮ সাল থেকে ১৮৭৬ সালের মধ্যে ইহুদি বা মুসলমানরা সর্ববৃহৎ গোষ্ঠী ছিল বলে ধারণা, তবে এ নিয়ে বেশ কয়েকটি ধারণা বিদ্যমান। ১৮৮২ সাল থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে এই শহরে ইহুদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় বলে অনুমান করা হয়।
- ১৯৫০ সালে, জেরুসালেমের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১,২০,৮৯৫।
- ২০১৬ সালের হিসাবে জেরুসালেমের মোট জনসংখ্যা ছিল ৮৮২,৭০০ জন। এর মধ্যে ৫৩৬,৬০০ জন ইহুদি এবং ৩৪৫,৯০০ জন অন্যান্য গোষ্ঠীর (৩১৯,৮০০ জন মুসলিম ১৫,৮০০ জন খ্রিস্টান এবং ১০,৩০০ জন শ্রেণীবিহীন) সদস্য ছিল।
- ২০০৩ সালে পুরানো শহরের জনসংখ্যা ছিলো ৩,৯৬৫ জন ইহুদী এবং ৩১,৪০৫ জন “আরব ও অন্যান্য” ধর্মাবলম্বী।
- জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৯ সালে জেরুসালেমের জনসংখ্যা ৯,১৯,৪০৭।
জেরুসালেম শহরের ইতিহাস, History of Jerusalem :
জেরুসালেম শহরের সাথে জড়িয়ে আছে সহস্র বছরেরও প্রাচীন ইতিহাস। শহরটিকে বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোর একটি বলে গণ্য করা হয়। বলাই বাহুল্য যে, জেরুসালেমের নাম ইহুদী, ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। বিভিন্ন বিষয়কে নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই ভয়াবহ সংঘর্ষ চলে আসছে এই শহরে।
বাইবেল অনুসারে, রাজা ডেভিড জেরুসালেম শাসন করেন। তখন তিনি জেরুসালেমকে ইসরায়েল রাজ্যের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমে তাঁর পুত্র রাজা সলোমন টেম্পল মাউন্টে প্রথম ইহুদী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসে এটিই ছিল জেরুসালেমের প্রথম প্রাথনালয় ।
৫৮৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ব্যবিলনীয়রা জেরুসালেম অধিকৃত করার পর তারা সেই সব মন্দির ধ্বংস করে এবং ইহুদীদের নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকে শুরু হয় ইহুদীদের সাথে তাদের বৈরিতা শুরু হয়।
প্রায় ৫০ বছর পর পার্শিয়ান রাজা সাইরাস ইহুদীদের জেরুসালেমে ফেরত আসার অনুমতি দেন। তাদের জন্য আবার মন্দির স্থাপন করা হয়। এছাড়াও ৫৩৯ এবং ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বের মাঝামাঝি সময় সাইরাস সিলিন্ডার তাদের বৈশ্বয়ীক মানবাধিকার ঘোষণা করেন যা বিশ্বের ইতিহাসে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম মানবাধিকারের সনদ।
৩৩২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আলেক্সা্ন্ডার দ্য গ্রেট জেরুসালেমের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন। পরবর্তীতে এই শহরটিকে রোমান, পার্শিয়ান, আরবস, ফাটিমিড, সেলজুক, তুর্কি, ক্রুশাডার, ইজিপশিয়ান, মামেলুকিস ও মুসলিমরা নিয়ন্ত্রণ করে।
জেরুসালেম শহরটি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে অনেকভাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এখানেই শিশু হিসেবে এসেছিলেন খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারক যিশু খ্রিস্ট। এখানেই ধর্ম প্রচার করেছেন তিনি এবং এখানেই ক্রুশে বিদ্ধ হয়েছেন। আবার ইহুদীদের জন্যও এই শহর গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মোজেসেরও পূণ্যভূমি এই জেরুসালেম শহর।
ইহুদীদের প্রথম মন্দির টেম্পল মাউন্টে এই শহরেই অবস্থিত ছিল। পরবর্তী সময়ে, ৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা হেরড সেখানে দ্বিতীয় ইহুদী মন্দির স্থাপন করলেও রোমানরা তা ধ্বংস করে দেয় ৭০ খ্রিষ্টাব্দে। পাশাপাশি ইসলাম ধর্মীয় ইতিহাসে জেরুসালেমকে পবিত্র নগরী হিসেবেই আলোকপাত করা হয়েছে বেশি।
জেরুসালেমে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, Important events in Jerusalem :
১৯৬৭ সালের ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ইসরায়েল এবং মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার মধ্যে ‘জুন যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়। সিনাই উপদ্বীপে ইসরায়েলি সীমান্তে মিশরের সেনা সমাবেশের পর ৫ জুন মিশরীয় বিমানক্ষেত্রে ইসরায়েলের হামলার মাধ্যমে এই যুদ্ধ শুরু হয়।
১৯৬৭ সালের পূর্ব জেরুসালেম ইসরায়েলের কাছে পরাজিত হয়। কয়েক সপ্তাহ পর ইসরায়েল শহরের দখল নেয় এবং দ্বাদশ শতকের আফদালিয়া বা শেখ ঈদ মসজিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে।
ইসরায়েল জেরুসালেমকে একীভূত বলে ঘোষণা দেয় এবং এর সকল ধর্মীয় পুণ্যস্থানে সকল ধর্মের মানুষের অবাধ প্রবেশাধিকারের ঘোষণা দেয়। এছাড়াও আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল এই শহরে।
১৯৮২ সাল থেকে বর্তমান অবধি জেরুসালেমে প্রতিটি ধর্ম ভিত্তিক পবিত্র কিছু স্থান পাওয়া যায়। শহরের দক্ষিণে জর্ডান নদীর পশ্চিম প্রান্তে ‘মৃত সাগর’ নামক একটি লবণাক্ত হ্রদ রয়েছে। এই হ্রদের পাশে মুসলিমদের অন্যতম পবিত্র জায়গা বাইতুল মাকদিস অবস্থিত।
জেরুসালেমের জনগণের ব্যবহৃত ভাষা, Languages used in Jerusalem :
জেরুসালেমের ইতিহাস যেহেতু বিচিত্র তাই শহরটিতে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগতভাবে বিচিত্রতা দেখা যায়। হিব্রু জেরুসালেমসহ পুরো ইসরায়েলে প্রধান ভাষা ব্যবহৃত হয়। ইসরায়েল-আরব নাগরিকদের ব্যবহৃত মূল ভাষা আরবি।
ইসরায়েলের দুটি সরকারি ভাষা হিব্রু এবং আরবি। ইংরেজি তাদের আধা-সরকারি ভাষা। এছাড়াও ইসরায়েলে ৩৩টির মত ছোট-বড় ভাষা ও উপভাষা প্রচলিত।
জেরুজালেম বর্তমানে কোন দেশে অবস্থিত? In which country is Jerusalem currently located?
1980 সালের জুলাই মাসে, নেসেট দেশের মৌলিক আইনের অংশ হিসাবে জেরুজালেম আইন পাস করে, যা জেরুজালেমকে ইসরায়েলের একীভূত রাজধানী ঘোষণা করে।
জেরুজালেম কোন অঞ্চলে অবস্থিত? In which region is Jerusalem located?
জেরুজালেম, হিব্রু ইরুশালাইম আরবি আল-কুদস, শহর, মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন শহর যেটি 1967 সাল থেকে সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অধীনে ছিল। ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, এটি পশ্চিম তীর এবং ইস্রায়েলের মধ্যে অবস্থিত।
জেরুজালেম কতবার ধ্বংস হয়েছিল? How many times was Jerusalem destroyed?
জেরুজালেম দুবার ধ্বংস হয়েছে, 23 বার অবরোধ করা হয়েছে, 52 বার আক্রমণ করা হয়েছে এবং 44 বার দখল ও পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
জেরুজালেম ফিলিস্তিনে নাকি ইসরাইলে? Where is Jerusalem in Palestine or Israel?
ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয়ই জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করলেও, ফিলিস্তিনিরা সাধারণত পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী বলে উল্লেখ করে।
1980 সালে, নেসেট “জেরুজালেম আইন” কে একটি মৌলিক আইন হিসাবে গ্রহণ করে, জেরুজালেমকে “সম্পূর্ণ এবং ঐক্যবদ্ধ”, “ইসরায়েলের রাজধানী” ঘোষণা করে।
জেরুজালেমের আদি অধিবাসী কারা? Who are the original inhabitants of Jerusalem?
আরব, হামাইট, কেনানাইট এবং জেবুসাইটরা জেরুজালেমের এলাকা সহ প্যালেস্টাইনের ভূমির আদি বাসিন্দা ছিল,” এইভাবে অভিযোগ প্রমাণ করে যে “জেরুজালেম সবসময় ছিল। একটি আরব শহর।”
জেরুজালেমের ইসলামিক নাম কি? What is the Islamic name of Jerusalem?
আল-কুদস হল জেরুজালেমের সবচেয়ে সাধারণ আরবি নাম এবং ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত অনেক সংস্কৃতির দ্বারা ব্যবহৃত হয়।
জেরুজালেমে কি মুসলিমরা বাস করে? Do Muslims live in Jerusalem?
20 শতকের প্রথম দশকে মুসলিমরা জেরুজালেমের আরব জনসংখ্যার মাত্র একটি সংখ্যালঘু গঠন করেছিল , কিন্তু 21 শতকের প্রথম দিকে তারা অপ্রতিরোধ্য ব্যবধানে খ্রিস্টানদের ছাড়িয়ে যায়।
শেষ কথা, Conclusion :
জেরুসালেমের ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেরই জানা ছিল না। তাই আমরা আজকের এই প্রতিবেদনের শহরটির ইতিহাস থেকে বর্তমান অবস্থা কতটা পরিবর্তিত, কতবার এই শহর ধ্বংস হয়, এই সবকিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
Frequently Asked Questions :
আল-কুদস
জেরুজালেম ইসরায়েলের রাজধানী
দুবার ধ্বংস হয়েছে