স্পেনের পেশাদার ফুটবল লিগের নাম ‘লা লিগা’। শীর্ষ পর্যায়ের পেশাদারী ঘরোয়া ফুটবল লিগ। স্পনসরশিপ সংক্রান্ত কারণে বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর নামকরণ করা হয়েছে লালিগা ইএ স্পোর্টস। এই লিগে ২০টি দলের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। লিগে সর্বনিম্ন স্থান অধিকারী ৩টি দলকে অবনমন করে সেহুন্দা দিভিসিওন-এ প্রেরণ করা হয়। পরিবর্তে সেহুন্দা দিভিসিওনের শীর্ষ ৩ দলকে প্রিমেরা দিভিসিওনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০২৩–২৪ সালের লা লিগা, 2023–24 La Liga
লা লিগা খেলায় এখনো পর্যন্ত ৬২টি দল অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। তন্মধ্যে নয়টি দল হয়েছে চ্যাম্পিয়ন। ১৯৫০-এর দশক থেকে রিয়াল মাদ্রিদ সর্বোচ্চ ৩৫ বার লা লিগা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, এখন পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব এ প্রতিযোগিতায় একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।
লা লিগার ইতিহাস, History of La Liga
১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে হোসে মারিয়া আচা নামীয় গোটশে দলের পরিচালক প্রথম স্পেনের জাতীয় লিগ পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাবনা করেন। নানাবিধ বিষয় নিয়ে অনেক বিতর্ক, যেমন অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা, কোন কোন দল অংশগ্রহণ করবে ইত্যাদি আলোচনার পর রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন লিগ পদ্ধতি প্রবর্তনে সায় দেয়।
১৯২৯ সালে সংস্থাটি ১০ দল নিয়ে প্রথমবারের মতো প্রিমেরা দিভিসিওনের প্রচলন ঘটায়। কোপা দেল রেই প্রতিযোগিতার পূর্বতন বিজয়ী দলসমূহ, যথা – বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, অ্যাথলেটিক বিলবাও, রিয়াল সোসিয়েদাদ, আরেনাস ক্লাব দে গেটশো- প্রমুখ দলকে নির্বাচিত করা হয়। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, এস্পানিওল এবং ইউরোপা – এ তিনটি দল কোপা দেল রে’র রানার্স-আপ হিসেবে ও নক-আউটভিত্তিক প্রতিযোগিতা থেকে রেসিং ক্লাব দে সান্তান্দেরর লিগে খেলার জন্য যোগ্যতা অর্জন করে।
এর মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং অ্যাথলেটিক বিলবাও – এই দল লা লিগা প্রতিযোগিতা আয়োজনের পর থেকে অদ্যাবধি অবনমনের হাত থেকে বেঁচে রয়েছে। বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুই তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসি এই লিগের সেরা দুই ক্লাবের হয়ে পরস্পর পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। অতীতে ডিয়েগো ম্যারাডোনা, গ্যারি লিনেকার, জিনেদিন জিদান ও ডেভিড বেকহামের মতো অনেক তারকা ফুটবলারেরই গন্তব্য হয়েছিল এই লা লিগা।
লা লিগা প্রতিযোগিতার ধরন, La Liga competition format
লা লিগায় দ্বৈত রাউন্ড-রবিন পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতার রূপরেখা প্রণীত হয়েছে। মৌসুমের মেয়াদ হল সেপ্টেম্বর মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত। প্রত্যেক দল একে-অপরের বিরুদ্ধে খেলবে। প্রত্যেক দলকে ৩৮ খেলায় অংশ নিতে হবে। জয়ের জন্যে ৩ পয়েন্ট, ড্রয়ে ১ পয়েন্ট দল পাবে। দলীয় অবস্থান নির্ধারিত হবে সর্বমোট পয়েন্টের মাধ্যমে। সর্বোচ্চ পয়েন্ট লাভকারী দল পাবে চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা। যদি কোন কারণে সর্বোচ্চ পয়েন্ট দুই বা ততোধিক দলের মাঝে সীমাবদ্ধ হয় তাহলে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হয়, সেই নিয়মগুলো হলো :
- যদি সকল দল একে-অপরের বিরুদ্ধে দুইবার খেলায় অংশ নেয়।
- যদি দুই দলের মধ্যে টাই হয়, তবে একে-অপরের বিরুদ্ধে গোল পার্থক্য প্রযোজ্য হবে (বাইরের মাঠে গোল এ নিয়মের বাইরে)
- যদি দুই দলের বেশি টাই হয়, তখন টাই ভাঙ্গা হবে। এক্ষেত্রে একে-অপরের বিরুদ্ধে খেলার ফলাফল হবে – একে-অপরের বিরুদ্ধে অর্জিত পয়েন্ট, একে-অপরের বিরুদ্ধে গোল পার্থক্য, একে-অপরের বিরুদ্ধে গোল করা।
প্রিমেরা দিভিসিওন এবং সেহুন্দা দিভিসিওনের মধ্যে উত্তরণ ও অবনমন পদ্ধতিও প্রচলিত। লা লিগার সর্বনিম্ন স্থান অধিকারী দলগুলোকে সেহুন্দা দিভিসিওনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে সেহুন্দা দিভিসিওন থেকে শীর্ষ দুই দল সরাসরি এবং ৩য় থেকে ৬ষ্ঠ স্থান অধিকারী দলগুলোর মধ্যে প্লে-অফ ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শীর্ষস্থানের দলটিকে প্রিমেরা দিভিসিওন উত্তরণ ঘটানো হয়।
লা লিগার ক্লাব সমূহ, La Liga clubs
লা লিগার সাথে যুক্ত ক্লাব সমূহ :
- গ্রানাদা
- লাস পালমাস
- মায়োর্কা
- ওসাসুনা
- রায়ো
- ভায়েকানো
- রিয়াল বেতিস
- রিয়াল মাদ্রিদ
- রিয়াল
- সোসিয়েদাদ
- সেভিয়া
- আলাভেস
- আলমেরিয়া
- অ্যাথলেটিক বিলবাও
- আতলেতিকো মাদ্রিদ
- বার্সেলোনা
- কাদিস
- সেলতা ভিগো
- হেতাফে
- জিরোনা
- ভালেনসিয়া
- ভিয়ারিয়াল
ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা, European competition
লা লিগার র্শীর্ষ চার দল প্রতি মৌসুমে সরাসরি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে খেলার যোগ্যতা লাভ করে। উয়েফা ইউরোপা লিগের প্রথম রাউন্ডে ৫ম ও ৬ষ্ঠ দল খেলার সুযোগ পায়। প্রিমেরা দিভিসিওনে সাফল্যের পাশাপাশি ইউরোপীয় প্রতিযোগিতার ইতিহাসে সর্বাধিক সাফল্যমণ্ডিত দল ভালেনসিয়া, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদ বিবেচিত হয়ে আসছে।
স্পেনের দল হিসেবে এ চার দল পাঁচ বা ততোধিক আন্তর্জাতিক ট্রফি লাভ করার ক্ষেত্রে সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। এছাড়াও দলগুলো স্থান পেয়েছে ইউরোপের সর্বমোট ট্রফি লাভের শীর্ষ দশ দলের তালিকায়। বার্সেলোনা ২০০৫-০৬ সালের মৌসুমে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং সেভিয়া উয়েফা কাপ জয় করেছে। ইউরোপে ১৯৯৭ সালের পর প্রাইমেরা ডিভিশন প্রথম লিগ হিসেবে এই লা লিগা দ্বৈত শিরোপা লাভকারী লিগ। লা লিগা প্রাথমিক সময় থেকেই ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শন করে আসছে।
ইউরোপীয় লিগগুলোর উপর উয়েফা র্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় এ লিগ বর্তমানে শীর্ষস্থানে আছে। গত পাঁচ বছর ধরে লা লিগা’র অবস্থান ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ এবং জার্মানির বুন্দেসলিগার উপরে রয়েছে।
লা লিগার সাফল্য, Success of La Liga
গত পাঁচ বছরে লা লিগা উয়েফা’র লিগের মানদণ্ড অনুযায়ী ইউরোপে অত্যন্ত শক্তিশালী লিগ প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অধিক জনপ্রিয় পেশাদারী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হিসেবে লা লিগা বিবেচিত হয়। ২০০৯-১০ এর মৌসুমে এই লিগে দর্শকদের উপস্থিতির হার ছিল খেলা প্রতি ২৮,২৮৬ জন। এই দর্শক সংখ্যা বিশ্বের যে কোন পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে ৬ষ্ঠ সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী এবং ইউরোপে পেশাদার ফুটবল লিগে এ সংখ্যা ৩য় সর্বোচ্চ।
বিজয়ী দলের ইতিহাস, History of the winning team
রিয়াল মাদ্রিদ ৩৫ বার বিজয়ী এবং ২৪ বার রানার্স আপ হয়েছিল। এই দলের জয়ের সালগুলো হল : ১৯৩১-৩২, ১৯৩২-৩৩, ১৯৫৩-৫৪, ১৯৫৪-৫৫, ১৯৫৬-৫৭, ১৯৫৭-৫৮, ১৯৬০-৬১, ১৯৬১-৬২, ১৯৬২-৬৩, ১৯৬৩-৬৪, ১৯৬৪-৬৫, ১৯৬৬-৬৭, ১৯৬৭-৬৮, ১৯৬৮-৬৯, ১৯৭১-৭২, ১৯৭৪-৭৫, ১৯৭৫-৭৬, ১৯৭৭-৭৮, ১৯৭৮-১৯, ১৯৭৯-৮০, ১৯৮৫-৮৬, ১৯৮৬-৮৭, ১৯৮৭-৮৮, ১৯৮৮-৮৯, ১৯৮৯-৯০, ১৯৯৪-৯৫, ১৯৯৬-৯৭, ২০০০-০১, ২০০২-০৩, ২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮, ২০১১-১২, ২০১৬-১৭, ২০১৯-২০, ২০২১–২২
বার্সেলোনা ২৭ বার বিজয়ী হয় এবং ২৭ বার রানার্স আপ হয়েছিল। এই দলের জয়ের সালগুলো হল : ১৯২৯, ১৯৪৪-৪৫, ১৯৪৭-৪৮, ১৯৪৮-৪৯, ১৯৫১-৫২, ১৯৫২-৫৩, ১৯৫৮-৫৯, ১৯৫৯-৬০, ১৯৭৩-৭৪, ১৯৮৪-৮৫, ১৯৯০-৯১, ১৯৯১-৯২, ১৯৯২-৯৩, ১৯৯৩-৯৪, ১৯৯৭-৯৮, ১৯৯৮-৯৯, ২০০৪-০৫, ২০০৫-০৬, ২০০৮-০৯, ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১২-১৩, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০২২–২৩
আতলেতিকো মাদ্রিদ ১১ বার বিজয়ী হয় এবং ১০ বার রানার্স আপ হয়েছিল। এই দলের জয়ের সালগুলো হল : ১৯৩৯-৪০, ১৯৪০-৪১, ১৯৪৯-৫০, ১৯৫০-৫১, ১৯৬৫-৬৬, ১৯৬৯-৭০, ১৯৭২-৭৩, ১৯৭৬-৭৭, ১৯৯৫-৯৬, ২০১৩-১৪, ২০২০-২১।
অ্যাথলেটিক বিলবাও ৮ বার বিজয়ী হয় এবং ৭ বার রানার্স আপ হয়েছিল। এই দলের জয়ের সালগুলো হল : ১৯২৯-৩০, ১৯৩০-৩১, ১৯৩৩-৩৪, ১৯৩৫-৩৬, ১৯৪২-৪৩, ১৯৫৫-৫৬, ১৯৮২-৮৩, ১৯৮৩-৮৪
ভালেনসিয়া ৬ বার বিজয়ী হয় এবং ৬ বার রানার্স আপ হয়েছিল। এই দলের জয়ের সালগুলো হল : ১৯৪১-৪২, ১৯৪৩-৪৪, ১৯৪৬-৪৭, ১৯৭০-৭১, ২০০১-০২, ২০০৩-০৪
রিয়াল সোসিয়েদাদ ২ বার বিজয়ী হয় এবং ৩ বার রানার্স আপ হয়েছিল। এই দলের জয়ের সালগুলো হল : ১৯৮০-৮১, ১৯৮১-৮২
দেপর্তিভো লা করুনা ১ বার বিজয়ী হয় এবং ৫ বার রানার্স আপ হয়েছিল। এই দলের জয়ের সালগুলো হল : ১৯৯৯-২০০০
সেভিয়া ১ বার বিজয়ী হয় এবং ৪ বার রানার্স আপ হয়েছিল। এই দলের জয়ের সালগুলো হল : ১৯৪৫-৪৬
রিয়াল বেতিস ১ বার বিজয়ী হয় এবং ৩ বার রানার্স আপ হয়েছিল। এই দলের জয়ের সালগুলো হল : ১৯৩৪-৩৫
পরিশেষে, Conclusion
ইউরোপের অন্যতম সেরা লিগ হল লা লিগা। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, সেভিয়ার মতো ক্লাব এই লিগকে বিশ্বব্যাপি করেছে সমাদৃত। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই লা লিগার অনুগামীরা রয়েছেন, যারা এই প্রিমিয়ারের জন্য উৎসুক হয়ে থাকেন।