লিবিয়া উত্তর আফ্রিকায় ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। লিবিয়া আফ্রিকার বৃহত্তম রাষ্ট্রগুলির একটি। তবে আকারে দেশটি বিশাল হলেও এখানকার জনবসতি খুবই লঘু। দেশটির বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি। লিবিয়ার প্রায় সমস্ত লোক মূলত উপকূলবর্তী অঞ্চলে বাস করে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা লিবিয়া রাষ্ট্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
লিবিয়া দেশ সম্পর্কে কিছু বিশেষ তথ্য, Some special facts about the Kingdom of Libya :
- লিবিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী বা বসতি : ত্রিপোলি
- সরকারি ভাষা : আরবি
- স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষা : লিবীয় আরবি
- নৃগোষ্ঠী : ৯২% আরব, ৫% বার্বার, ৩% অন্যান্য
- স্বাধীনতা : ইতালি ত্যাগ করেছে ১৯৪৭ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি, জাতিসংঘের অছিভুক্ততা থেকে মুক্ত ১৯৫১ সালে ২৪ ডিসেম্বর।
- আয়তন : ১৭,৫৯,৫৪১ কিমি২ (৬,৭৯,৩৬৩ মা২)
- জনসংখ্যা : ২০০৯ সাল অনুসারে আনুমানিক ৬,৪২০,০০০;
লিবিয়ার আদিবাসী, Indigenous people of Libya :
বার্বার জাতির লোকেরা লিবিয়ার আদিবাসী। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে এই দেশে আরবদের আগমন ঘটেছিল। বর্তমান সময়ে লিবিয়ার অধিবাসীদের মধ্যে উক্ত দুই জাতির লোকের মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। এখনও দেশের দক্ষিণ প্রান্তসীমায় স্বল্পসংখ্যক বার্বার বাস করে। বলাই বাহুল্য, লিবিয়ার সংখ্যাগুরু লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইসলাম এখানকার রাষ্ট্রধর্ম।
লিবিয়ার জনগণের জীবিকা, Livelihoods of Libyan people :
খনিজ তেল আবিষ্কারের আগে, ১৯৫০-এর দশকে লিবিয়া একটি দরিদ্র রাষ্ট্র ছিল। পেট্রোলিয়ামের বিরাট মজুদ আবিষ্কার করার পর থেকে লিবিয়া আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী দেশগুলির মধ্যে একটি বলে গণ্য হয়। তবে এখনও এদেশের অনেক লোক খামার ও পশুচারণের কাজে নিয়োজিত। তবে ভাল খামারভূমির পরিমাণ এখানে অত্যন্ত কম।
লিবিয়ার নামকরণ, Nomenclature of Libya :
লিবিয়া একটি আদিবাসী শব্দ, যার উদ্ভব হয়েছিল আদি মিশরীয় লেখনী ‘লিবু’ থেকে। উক্ত লিবু বলতে নীল নদের পশ্চিমে বসবাসকারী বর্বর জাতির একটি গোত্রের লোকদের বোঝানো হয়। ক্রমে লিবু শব্দটি পরিনত হয় লিবিয়া নামে। প্রাচীন গ্রীসে উত্তর আফ্রিকা ও মিশর, এমনকি কখনো কখনো আফ্রিকা মহাদেশের সম্পূর্ণ এলাকাকেই ‘লিবিয়া’ বলে অভিহিত করা হতো।
লিবিয়ার ইতিহাস, History of Libya :
১৫৫১ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত লিবিয়া উসমানীয় তুর্কিদের অধীনে ছিল। এরপর এই দেশ ইতালির অধীনস্থ হয়। লিবিয়া ২য় বিশ্বযুদ্ধে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল। ১৯৫১ সালের ২৪শে ডিসেম্বর দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। ক্রমে ১৯৫৩ সালে লিবিয়া দেশটি আরব লীগ এবং ১৯৫৫ সালে জাতিসংঘের সদস্য হয়।
আরও বিস্তারিত বলতে গেলে লিবিয়াতে প্রাচীনকালে ফিনিসীয়, রোমান ও আরবেরা বসতি স্থাপন করেছিল। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ইতালীয়রা দেশটিকে একটি উপনিবেশে পরিণত করে দিয়েছিল। ১৯৫১ সালে লিবিয়া দেশটি এক স্বাধীন রাজতন্ত্রে পরিণত হয়। তরুণ সামরিক অফিসার মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি ১৯৬৯ সালে দেশের ক্ষমতা দখল করেন। গাদ্দাফি তাঁর সমাজতন্ত্র ও আরব জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী এক নতুন লিবিয়া গঠন করে তুলেন। ক্রমে তিনি লিবিয়াকে এক সমাজতান্ত্রিক আরব গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে আখ্যা দেন। তবে লিবিয়ার বাইরের জনগণের মধ্যে দেশটি একটি সামরিক একনায়কতন্ত্র হিসেবেই বেশি পরিচিত।
লিবিয়ার রাজনীতি, Politics of Libya :
লিবিয়ায় সরকারের দুইটি স্তর রয়েছে-
- ‘বিপ্লবী অংশ’, যা বিপ্লবী নেতা মুয়াম্মর গাদ্দাফি, বিপ্লবী কমিটিসমূহ এবং ১৯৬৯ সালে গঠিত বিপ্লবী নিয়ন্ত্রণ পরিষদের অবশিষ্ট ১২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত।
- আইনপ্রণয়নকারী অংশ, যা ‘স্থানীয় গণ কংগ্রেস’সমূহ, ‘শাবিয়াত গণ কংগ্রেস’সমূহ এবং জাতীয় সাধারণ গণ কংগ্রেস নিয়ে গঠিত।
জেনে রাখা ভালো যে, দেশের ঐতিহাসিক বিপ্লবী নেতৃত্ব নির্বাচিত নয় এবং বিপ্লবে তাদের অংশগ্রহণের কারণে কখনোই ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে তাদের সরানো সম্ভব নয়।
- দেশটির ১,৫০০টি শহুরে ওয়ার্ডের প্রত্যেকটির জন্য একটি করে স্থানীয় গণ কংগ্রেস রয়েছে।
- ৩২টি অঞ্চল/পৌরসভা/উপবিভাগ বা শাবিয়াতের প্রত্যেকটির জন্য রয়েছে একটি করে ‘শাবিয়াত’ গণ কংগ্রেস।
- দেশে একটি জাতীয় সাধারণ গণ কংগ্রেসও রয়েছে।
উক্ত আইন প্রণয়নকারী অংশগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে নির্বাহী অংশ অর্থাৎ স্থানীয় গণ কমিটিসমূহ, ‘শাবিয়াত’ গণ কমিটিসমূহ এবং জাতীয় সাধারণ গণ কমিটি/কেবিনেট।
লিবিয়ার প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহ, Administrative Regions of Libya :
- লিবিয়ার প্রধান শহর: ত্রিপলি, বেন্ গাজি।
- লিবিয়ার তিনটি প্রধান অঞ্চল হল ত্রিপোলিতানিয়া, ফেজ, ও সিরেনাইকা।
লিবিয়ার জলবায়ু, Climate of Libya :
- লিবিয়া অক্ষাংশের ১৯° এবং ৩৪°N এবং দ্রাঘিমাংশের মধ্যে ৯° ও ২৬°E এর মধ্যে অবস্থিত।
- লিবিয়ার উপকূলরেখা ভূমধ্যসাগরীয় সীমান্তবর্তী যে কোন আফ্রিকান দেশের মধ্যে দীর্ঘতম। শেষটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৭৭০ কিলোমিটার (১,১০০ মাইল) উচ্চতায় অবস্থিত।
- লিবিয়ার উত্তরে ভূমধ্যসাগরের অংশটিকে প্রায়শই লিবিয়ান সাগর বলা হয়।
- লিবিয়ার জলবায়ু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুষ্ক এবং মরুভূমির মতো প্রকৃতির। এদেশের উত্তর দিকের অঞ্চলগুলি একটি মৃদু ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু উপভোগ করে।
লিবিয়ার অর্থনীতি, Economical condition of Libya :
লিবিয়ার অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক মডেল অনুসরণ করে। এখানকার অর্থনীতি মূলত পেট্রোলিয়াম খাতের উপর নির্ভরশীল। এই রাষ্ট্রের প্রায় সমস্ত বৈদেশিক মুদ্রা পেট্রোলিয়াম রপ্তানির মাধ্যমে অর্জন করা হয়। বলতে গেলে, পেট্রোলিয়াম রপ্তানি করে প্রাপ্ত অর্থ দেশের জিডিপির অর্ধেকের যোগান দেয়। লিবিয়ার জনসংখ্যা কম বলে দেশটির মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ দেশগুলির মধ্যে একটি। ২০০০ সাল থেকে লিবিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আশাব্যঞ্জক ছিল। ২০০৬ সালে এই হার ছিল ৮.১%।
লিবিয়ার ভাষা, Languages of Libya :
লিবিয়ায় আরবি প্রাথমিক ভাষা। লিবিয়ানদের অধিকাংশই আরব বা মিশ্র আরব-বারবার বংশোদ্ভূত । ইসলামের সুন্নি শাখা হল সরকারী এবং জাতীয়ভাবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আইনি শক্তি। এছাড়া এখানে কিছু স্থানীয় ভাষাও প্রচলিত। এদের মধ্যে তামাশেক ভাষা ও তেদা ভাষা উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক কাজকর্মে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। ইমাজিগেন, যারা তামাজিট ভাষা এবং রীতিনীতি বজায় রাখে, তারা উত্তর আফ্রিকার আদিবাসী এবং বৃহত্তম অ-আরব সংখ্যালঘু।
লিবিয়া কিসের জন্য বিখ্যাত? What is Libya famous?
দেশটি তার সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের জন্য পরিচিত এবং প্রাচীন সভ্যতা থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত কিছু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। লিবিয়ায় দুটি প্রধান জলবায়ু ব্যবস্থা রয়েছে। দক্ষিণে, জলবায়ু গরম এবং শুষ্ক, সাহারা মরুভূমির বৈশিষ্ট্য। যাইহোক, উত্তরে, ভূমধ্যসাগর একটি মৃদু জলবায়ু তৈরি করে
লিবিয়ার মানুষ কেমন? How are the Libyan people?
লিবিয়ার সংস্কৃতি পরিবার, উপজাতীয় বন্ধন, আনুগত্য, সংহতি এবং বিশ্বস্ততার উপর জোর দেয়। লিবিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আরব, এবং 96.6% সুন্নি মুসলিম। লিবিয়ায় প্রধানত কথ্য ভাষা আরবি।
লিবিয়া কেন যাওয়া উচিত? Why should you go to Libya?
একটি পর্যটন গন্তব্য হিসেবে লিবিয়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল সাংস্কৃতিক পর্যটন । দেশে পাঁচটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রয়েছে, যার মধ্যে তিনটি ধ্রুপদী ধ্বংসাবশেষ। পশ্চিম লিবিয়ার রোমান শহর সাবরাথা এবং লেপ্টিস ম্যাগনা এবং পূর্বে সিরিনের গ্রীক ধ্বংসাবশেষ বড় পর্যটক আকর্ষণ।
লিবিয়ার প্রধান খাদ্য কি? What is the main food of Libya?
লিবিয়ায় কুসকুস প্রধানতম খাবার। লিবিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারগুলির মধ্যে একটি হল বাজিন , বার্লি, জল এবং লবণ দিয়ে প্রস্তুত একটি রুটি।
লিবিয়ার মানুষকে কি বলে? What are the people of Libya called?
লিবিয়ার লোকদের বলা হয় লিবিয়ান । লিবিয়ানরা বেশিরভাগই আরব, যদিও অনেকেই বারবার, একটি দল যার মধ্যে রয়েছে উত্তর আফ্রিকার যাযাবর তুয়ারেগ।
লিবিয়ায় কয়টি জাতি আছে? How many nationalities are there in Libya?
- জাতিগোষ্ঠী :বারবার এবং আরব 97%; গ্রীক, মাল্টিজ, ইতালীয়, মিশরীয়, পাকিস্তানি, তুর্কি, ভারতীয় এবং তিউনিসিয়ান।
- ধর্মঃ সুন্নি মুসলিম ৯৭%।
লিবিয়া রাষ্ট্রটি কেমন? What kind of country is Libya?
লিবিয়া প্রায় পুরোটাই লিবিয়ান মরুভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত, একটি সমতল মালভূমি যা সাহারার অংশ, বিশ্বের বৃহত্তম উষ্ণ মরুভূমি। লিবিয়া এতটাই শুষ্ক যে এর সীমানা দিয়ে কোনো স্থায়ী নদী প্রবাহিত হয় না।
লিবিয়ার অপর নাম কি? What is another name for Libya?
1969 সালে, লিবিয়া কিংডম জাতিসংঘকে জানায় যে এটি তার নাম পরিবর্তন করে লিবিয়ান আরব জামাহিরিয়া করেছে।
লিবিয়ার স্থায়ী মিশনের একটি অনুরোধের ভিত্তিতে 2011 সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটিকে “লিবিয়া” হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
লিবিয়া কোন সাগরে অবস্থিত? Libya is located in which sea?
দেশটির উত্তরে ভূমধ্যসাগর , পশ্চিমে তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া, দক্ষিণে নাইজার ও চাদ এবং পূর্বে সুদান ও মিশর রয়েছে।
লিবিয়ার বর্তমান শাসক কে? Who is the current ruler of Libya?
আবদুল হামিদ দ্বীবেহ হলেন ঐক্য সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং 5 ফেব্রুয়ারী 2021-এ লিবিয়ার রাজনৈতিক সংলাপ ফোরামে নির্বাচিত হন।
লিবিয়া কোন ধরনের অর্থনীতি নির্ভর রাষ্ট্র? What type of economy does the country of Libya depend on?
লিবিয়ার অর্থনীতি মূলত পেট্রোলিয়াম খাত থেকে আয়ের উপর নির্ভর করে , যা রপ্তানি আয়ের 95% এবং জিডিপির 60% প্রতিনিধিত্ব করে। এই তেলের রাজস্ব এবং স্বল্প জনসংখ্যা লিবিয়াকে আফ্রিকার মাথাপিছু জিডিপির সর্বোচ্চ নাম দিয়েছে।
শেষ কথা, Conclusion :
লিবিয়া দেশ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উপরে আলোচনা করা হল, তবে দেশটি বিভিন্ন সময়ে এর সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণেও আলোচনায় এসেছে। দেশের অন্তর্বতী অপহরণ মামলা, অরাজকতা, নৈরাজ্য, বিরোধ ইত্যাদিও বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে।
Frequently Asked Questions :
ইমাজিগেন (বারবার) লিবিয়ার আদি বাসিন্দা ছিল বলে মনে করা হয়। প্রধান আমাজিঘ (বহুবচন ইমাজিঘেন) গ্রুপ ছিল লুয়াটা, নেফুসা এবং আদাসা। তারা উপকূলীয় মরূদ্যানে বাস করত এবং কৃষি অনুশীলন করত।
লিবিয়া আফ্রিকার বৃহত্তম রাষ্ট্রগুলির একটি।
আবদুল হামিদ দ্বীবেহ হলেন ঐক্য সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং 5 ফেব্রুয়ারী 2021-এ লিবিয়ার রাজনৈতিক সংলাপ ফোরামে নির্বাচিত হন।