প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা ২০২৫, Maha Kumbh mela Prayagraj 2025

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা ২০২৫

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা ২০২৫ আগামী ১৩ জানুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে।  এই ৪৪ দিনব্যাপী মেলায় লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও তীর্থযাত্রী অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

সূচিপত্র: hide

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা হিন্দু ধর্মে অন্যতম বৃহৎ আধ্যাত্মিক সমাবেশ, যার সূচনা প্রাচীনকাল থেকে। এটি পৃথিবীর অন্যতম পুরনো ও বৃহত্তম সমাবেশ বলে বিবেচিত। মহাকুম্ভ মেলা প্রতি ১২ বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয় এবং চারটি প্রধান স্থানে পালিত হয়: প্রয়াগরাজ (প্রাচীন নাম এলাহাবাদ), হরিদ্বার, উজ্জয়িনী এবং নাসিক।

মহাকুম্ভ মেলার উৎপত্তি ও পৌরাণিক কাহিনি:

মহাকুম্ভ মেলার উৎপত্তি পুরাণের “সমুদ্র মন্থন” কাহিনির সঙ্গে সম্পর্কিত। দেবতা ও অসুরেরা সমুদ্র মন্থনের মাধ্যমে অমৃত (অমরত্বের রস) প্রাপ্তির চেষ্টা করছিল। মন্থনের সময় অমৃতপূর্ণ কুম্ভ (কলস) থেকে চারটি বিন্দু চারটি স্থানে পড়ে: প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী এবং নাসিক। এই চারটি স্থানকে পবিত্র মনে করে এখানে কুম্ভ মেলা পালিত হয়।

বিশ্বাস করা হয় যে, এই সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের বিশেষ অবস্থান তৈরি হয়, যা স্নানের মাধ্যমে আত্মাকে পবিত্র করার এবং মোক্ষলাভের জন্য বিশেষ উপযোগী।

মহাকুম্ভ মেলা

প্রথম কুম্ভ মেলা:

লিখিত নথি অনুসারে, প্রয়াগরাজে প্রথম কুম্ভ মেলার উল্লেখ পাওয়া যায় হর্ষবর্ধনের শাসনকালে (৭ম শতাব্দী)। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে উল্লেখ করেন যে, হর্ষবর্ধন প্রতি ছয় বছরে একবার গঙ্গার তীরে একটি মহামেলা আয়োজন করতেন, যা পরবর্তীতে কুম্ভ মেলা হিসেবে পরিচিত হয়।

আধুনিক কুম্ভ মেলা:

আধুনিক মহাকুম্ভ মেলার ঐতিহ্য মুঘল শাসন এবং ব্রিটিশ শাসনামলেও অব্যাহত থাকে। মুঘল সম্রাট আকবর প্রয়াগরাজে ত্রিবেণী সঙ্গমের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর নাম “ইলাহাবাদ” রাখেন। ব্রিটিশ আমলে কুম্ভ মেলাকে সাংগঠনিক কাঠামো দেওয়া হয়, এবং এটি একটি বৃহৎ আকার ধারণ করে।

আধুনিক কুম্ভ মেলা

মহাকুম্ভ ও অন্যান্য কুম্ভের পার্থক্য:

কুম্ভ মেলা: প্রতি ১২ বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়।

অর্ধ কুম্ভ মেলা: প্রতি ৬ বছরে একবার হয়।

মহাকুম্ভ মেলা: প্রতি ১৪৪ বছরে একবার পালিত হয়, যা ১২টি কুম্ভ চক্রের পরে আসে।

বিশ্ব ঐতিহ্য:

মহাকুম্ভ মেলা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উৎসব নয়, এটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মানুষের একত্রিত হওয়ার প্রতীক। ইউনেস্কো ২০১৭ সালে কুম্ভ মেলাকে “ইন্ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ” (অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

মহাকুম্ভ মেলা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উৎসব নয়, এটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মানুষের একত্রিত হওয়ার প্রতীক

মহাকুম্ভ মেলার তাৎপর্য:

হিন্দু ধর্মে মহাকুম্ভ মেলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক সমাবেশ, যা প্রতি ১২ বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, এই সময়ে ত্রিবেণী সঙ্গমে (গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী নদীর মিলনস্থল) স্নান করলে পাপমোচন ও মোক্ষ লাভ সম্ভব। এবারের মহাকুম্ভ মেলা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি ১৪৪ বছরে একবার অনুষ্ঠিত মহাকুম্ভ, যা ১২টি পূর্ণকুম্ভের পর আয়োজিত হয়। 

মহাকুম্ভ মেলার তাৎপর্য

প্রধান স্নান ও শাহী স্নানের তারিখসমূহ:

মহাকুম্ভ মেলায় কিছু বিশেষ দিনকে শাহী স্নানের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত। প্রধান স্নান ও শাহী স্নানের তারিখগুলি নিম্নরূপ:

  • প্রথম স্নান: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ (পৌষ শুক্ল একাদশী)
  • দ্বিতীয় স্নান: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ (পৌষ পূর্ণিমা)
  • প্রথম শাহী স্নান: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ (মকর সংক্রান্তি)
  • দ্বিতীয় শাহী স্নান: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ (মাঘ অমাবস্যা)
  • তৃতীয় শাহী স্নান: ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বসন্ত পঞ্চমী)
  • অষ্টম স্নান: ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (মাঘ শুক্ল সপ্তমী)
  • নবম স্নান: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (ভীমাষ্টমী)
  • দশম স্নান: ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (জয়া একাদশী)

পর্যটন ও দর্শনীয় স্থান:

মহাকুম্ভ মেলায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি, প্রয়াগরাজে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্দির ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য দর্শন করা যেতে পারে। এগুলির মধ্যে রয়েছে ত্রিবেণী সঙ্গম, এলাহাবাদ দুর্গ, হনুমান মন্দির এবং অন্যান্য প্রাচীন স্থাপত্য। 

মহাকুম্ভ মেলায় কিছু বিশেষ দিনকে শাহী স্নানের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে

পরিবহন ও যাত্রাপথ:

প্রয়াগরাজ ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত এবং সড়ক, রেল ও বিমানপথে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সহজেই পৌঁছানো যায়। কলকাতা থেকে প্রয়াগরাজে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন ট্রেন ও বাস পরিষেবা উপলব্ধ। এছাড়া, প্রয়াগরাজে একটি বিমানবন্দরও রয়েছে, যেখানে কলকাতা থেকে সরাসরি বা সংযোগকারী ফ্লাইট পাওয়া যেতে পারে।

নিরাপত্তা ও সুবিধাদি:

মহাকুম্ভ মেলার সময় প্রশাসন বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং তীর্থযাত্রীদের জন্য অস্থায়ী শৌচাগার, পানীয় জল, চিকিৎসা কেন্দ্র এবং অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা করে। ভ্রমণের আগে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশিকা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অবগত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

মহাকুম্ভ মেলার সময় প্রশাসন বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা ২০২৫-এ অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তীর্থযাত্রীদের জন্য বিভিন্ন ধরণের থাকার এবং খাওয়ার ব্যবস্থা উপলব্ধ। যেহেতু লক্ষ লক্ষ ভক্ত এখানে সমবেত হন, তাই প্রশাসন ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মেলার সময় বিশেষ ব্যবস্থা করে।

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলায় থাকার জায়গা:

1. টেন্ট সিটি (শিবির):

মহাকুম্ভ মেলার জন্য অস্থায়ী টেন্ট সিটি গড়ে তোলা হয়।

এখানে সাধারণ থেকে বিলাসবহুল তাঁবু পাওয়া যায়।

সুবিধাসমূহ: বেড, বাথরুম, ২৪x৭ নিরাপত্তা ও বিদ্যুৎ সংযোগ।

বুকিং: সরকারি পোর্টাল বা প্রাইভেট অপারেটরদের মাধ্যমে আগাম বুকিং করা যায়।

2. হোটেল ও লজ:

প্রয়াগরাজ শহরে বিভিন্ন দামের হোটেল, লজ ও ধর্মশালা রয়েছে।

নিম্ন, মধ্যম ও উচ্চমানের হোটেল পাওয়া যায়।

বুকিং: অনলাইন বুকিং প্ল্যাটফর্ম (যেমন, MakeMyTrip, Booking.com) ব্যবহার করতে পারেন।

3. ধর্মশালা ও আশ্রম:

বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মেলার সময় বিনামূল্যে বা নামমাত্র খরচে থাকার ব্যবস্থা করে।

প্রধান ধর্মশালা:

  • আনন্দ আশ্রম
  • অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ধর্মশালা
  • গুজরাটি ধর্মশালা

বুকিং: সরাসরি যোগাযোগ করে বুকিং করতে হয়।

4. সরকারি ব্যবস্থা:

সরকার সাশ্রয়ী থাকার জন্য শিবির ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে।

সরকারি পোর্টালে রেজিস্ট্রেশন করে এই সুবিধা পাওয়া যায়।

5. বিলাসবহুল থাকার ব্যবস্থা:

ব্যক্তিগত কোম্পানিগুলি কুম্ভ মেলার কাছে বিলাসবহুল তাঁবু এবং রিসর্ট সরবরাহ করে।

সুবিধাসমূহ: Wi-Fi, এয়ার কন্ডিশনিং, প্যাকেজ ট্যুর।

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলায় খাওয়ার জায়গা:

1. লঙ্গর (মুক্ত ভোজন):

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং গুরুদ্বারগুলোতে বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা থাকে।

সাধারণত ভাত, ডাল, রুটি, সবজি সরবরাহ করা হয়।

2. স্থায়ী ও অস্থায়ী খাবারের দোকান:

মেলার এলাকাজুড়ে প্রচুর অস্থায়ী খাবারের দোকান পাওয়া যায়।

স্থানীয় খাবার, যেমন পুরি-সবজি, কচৌরি, লাড্ডু ইত্যাদি পাওয়া যায়।

3. হোটেলের রেস্তোরাঁ:

প্রয়াগরাজ শহরের হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে বিভিন্ন ধরণের খাবার পাওয়া যায়।

ভেজ ও নন-ভেজ উভয় ধরনের খাবার উপলব্ধ।

4. বিলাসবহুল খাবারের ব্যবস্থা:

বিলাসবহুল টেন্ট সিটির রেস্তোরাঁগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের খাবার সরবরাহ করা হয়।

বুকিং সম্পর্কিত ওয়েবসাইট:

Kumbh Mela Official Website

MakeMyTrip

Booking.com

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা একদিকে আধ্যাত্মিকতার প্রতীক, অন্যদিকে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এটি কোটি কোটি মানুষের জন্য পাপ মোচনের এবং আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।

প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা একদিকে আধ্যাত্মিকতার প্রতীক, অন্যদিকে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন

উপসংহার:

মহাকুম্ভ মেলা ২০২৫ একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও পর্যটককে আকর্ষণ করবে। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে এই মহোৎসবে অংশগ্রহণ করা একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts