মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার হল মুজিবনগর সরকার, যা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নামেও পরিচিত। ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল এই সরকার গঠিত হয়। বলাই বাহুল্য এটি হল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা মুজিবনগর সরকার এবং এর মন্ত্রণালয় নিয়ে আলোচনা করবো।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার, The Provisional Government of the People’s Republic of Bangladesh :
মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭২ সাল অবধি স্থায়ী হয়েছিল। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান (অস্থায়ী)। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশের জনগণের রায়ে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে এই সরকার গঠন করা হয়।
এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগর) ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল তারিখে শপথ গ্রহণ করেন। এই সরকার গঠন হওয়ার পর দেশের রাজধানী ছিল বৈদ্যনাথতলা।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা হয়, তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়।
এই সময় দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষা করা, ইত্যাদি কাজগুলোর ক্ষেত্রে এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
মুজিবনগর সরকার গঠনের সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ প্রবল যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিজয় অর্জন করার দিকে ত্বরান্বিত হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী সরকার গঠন, Formation of Provisional Government officially :
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠক সংগঠিত হওয়ার পর তিনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ (M.N.A) এবং এমপিএদের (M.P.A) কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। উক্ত অধিবেশনে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়।
এই মন্ত্রিপরিষদ এবং এমএনএ ও এমপিএগণ রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হিসেবে ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। উক্ত সরকার সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপ্রধান এবং বঙ্গন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান তাজউদ্দীন আহমদকে, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয় এর দায়িত্বে, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছিলেন পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর দায়িত্ব নিয়ে, এ এইচ এম কামরুজ্জামান পেয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর দায়িত্ব, প্রমুখ সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়।
এম এ জি ওসমানীকে ১১ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে ভাষণ প্রদানের মধ্য দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা করেন।
স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট, Context of Declaration of Independence :
অস্থায়ী সরকার গঠনের পর শপথ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই বক্তব্য পেশ করেন। অনুষ্ঠানে ভাষণ আখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন।
ভাষণের শেষাংশে তিনি বলেন,
“বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চাইতে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি। অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা।”
এই অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০ জনের মত সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। বলাই বাহুল্য এই ভাষণ এর মধ্যদিয়েই প্রধানমন্ত্রী দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানানোর চেষ্টা করেছিলেন।
এভাবেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সূচনা হয়।
মুজিবনগর সরকারের অধীনে কতটি মন্ত্রণালয় ছিল, How many ministries were under Mujibnagar government?
মুজিব নগর সরকারের মোট ১৫ টি মন্ত্রনালয় ও বিভাগ ছিল।
মন্ত্রণালয়সমূহের নাম হল :
- প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
- অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
- মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়।
- সাধারণ প্রশাসন বিভাগ।
- স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
- তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়।
- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
- ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়।
- সংসদ বিষয়ক বিভাগ।
- কৃষি বিভাগ।
- প্রকৌশল বিভাগ।
উক্ত মন্ত্রণালয় ছাড়াও কয়েকটি সংস্থা ছিল যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত। সেগুলি হল :
- পরিকল্পনা কমিশন
- শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড
- নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির
- ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি
- শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড ।
এছাড়াও আছে উপরাষ্ট্রপতির দপ্তর, মুজিবনগর সরকারের অধীনে :
- উপদেষ্টাবৃন্দ- মোহাম্মদ উল্লাহ (এম এন এ), সৈয়দ আবদুস সুলতান (এম এন এ), কোরবান আলি (এম এন এ)
- একান্ত সচিব- কাজী লুৎফুল হক
- সহকারী সচিব– আজিজুর রহমান
- প্রধান নিরাপত্তা অফিসার- সৈয়দ এম করিম
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ছিলেন :
- এডিসি- মেজর নূরুল ইসলাম
- একান্ত সচিব- ডাঃ ফারুক আজিজ
- তথ্য অফিসার- আলী তারেক
মন্ত্রণালয়সমূহের ভূমিকা ও কার্য বিবরনী, Description of the role and function of the Ministries :
যুদ্ধকালীন সময়ে সরকারের মন্ত্রণালয় সমূহের বিভিন্নমুখী তৎপরতা যুদ্ধকে গতিময় রাখতে সহায়তা করেছিল। মন্ত্রণালয়সমূহের ভূমিকা ও কার্যবিবরনী সংক্ষেপে বর্ণনা :
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান রূপে মুক্তিযুদ্ধকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে লে কর্নেল আবদুর রবকে চিফ অফ স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ রূপে নিযুক্ত করেন।
পাশাপাশি সমগ্র বাংলাদেশকে একাধিক (গঠনতান্ত্রিক ভাবে ১১টি) সেক্টরে বিভক্ত করে দেওয়া হয়। উক্ত সেক্টরগুলোকে সেক্টর কমান্ডাররা নিজ নিজ সুবিধা মত সাব সেক্টরে ভাগ করে নিয়েছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান কাজ ছিল বহির্বিশ্বে জনমত গড়ে তোলা। এছাড়াও তারা বন্ধু রাষ্ট্রদের থেকে যথাসম্ভব প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা চালান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নামে ভিন্নভাবে একটি মন্ত্রণালয় থাকা সত্বেও পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রায় সব কাজ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত।
অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যয়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, বন্ধুপ্রতিম দেশসমূহ থেকে প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের সুষ্ঠু ব্যবহার ইত্যাদি কাজ শৃঙ্খলার সাথে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। মন্ত্রণালয়ের কাজ শুরু হবার পর এই ব্যবস্থা সরকারী চালিকা শক্তি হিসাবে পরিগণিত হয়।
তখন যেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেগুলি হল :
- বাজেট প্রণয়ন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব;
- বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত সম্পদের হিসাব প্রস্তুত;
- বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের দায়িত্ব পালন ও বিধিমালা প্রণয়ন;
- আর্থিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন;
- রাজস্ব ও শুল্ক আদায়;
- আর্থিক অনিয়ম তদন্তের জন্য কমিটি গঠন।
ক্রমে বাংলাদেশ সরকারের অর্থসংস্থানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ফান্ড নামে তহবিল খোলা হয়, যেখানে ভারত, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়ক হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ জমা রাখা হয়।
তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়
মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম ও সাফল্য ছিল বহুমুখী।
বেতার কেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের অবিরাম উৎসাহ জোগানো হত, পাশাপাশি পত্র-পত্রিকা, ছোট ছোট পুস্তিকা, লিফলেট ইত্যাদি নিয়মিত প্রকাশ করার মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন খবর পৌছানো ইত্যাদি ছিল তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ।
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়
যুদ্ধকালীণ সময়ে এই মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি প্রাথমিক সময়ে এতবেশি ব্যাপক ছিল না। পরে পাকিস্তান বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাটের কারণে সাধারণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে সীমান্তের পাড়ে আশ্রয় নিতে শুরু করলে ত্রাণ সমস্যা প্রকট হয়।
ক্রমে দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে এ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা বৃদ্ধি পায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ করা হত এবং শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকদেরই ত্রাণ সুবিধা দেয়া হত।
স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়
যুদ্ধকালীণ সময়ে এ মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয়তা ও ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকেই সীমান্তের কাছাকাছি অনেক জায়গায় সামরিক হাসপাতাল গড়ে উঠে। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে, ত্রিপুরা-কুমিল্লা সীমান্ত বরাবর ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা হয়।
শত্রুর আক্রমণে যারা আহত হতেন তাদের সেবা প্রদানই ছিল এ বিভাগের মুখ্য কাজ।
১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদপত্রের নাম কি ছিল, What was the name of the newspaper published by Mujibnagar government in 1971 ?
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জয় বাংলা সংবাদপত্রটি শুরু হয়েছিল। প্রথম সংস্করণ ১৯৭১ সালের ১১ মে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতিদান ছিল।
মুজিবনগর সরকারের কাজ কি ছিল, What was the function of the Mujibnagar government ?
মুজিবনগর সরকার মুক্তিবাহিনী এবং নবজাতক বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর যুদ্ধ প্রচেষ্টার সমন্বয় করেছিল। এর নিজস্ব পোস্টাল সার্ভিস ছিল। এর জনসংযোগ কৌশলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে পরিচিত একটি ব্যাপক জনপ্রিয় রেডিও স্টেশন রয়েছে।
শেষ কথা, Conclusion :
আশা করি উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আপনারা হয়তো মুজিবনগর সরকার এবং এর মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের নেপথ্যে এই সরকারের ভূমিকা অনন্য।