সরিষার বীজ থেকে তৈরি হয়। এটি গাঢ় হলুদ বর্ণের এবং সামান্য কটু স্বাদ ও শক্তিশালী সুবাস যুক্ত তেল। ঐতিহ্যগতভাবে এই তেল আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। রান্না ঘরে সর্বদাই এই তেল ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রভাবে খাবারে সরিষার তেলের ব্যবহার কম করে থাকেন। তাহলে সরিষার তেল কি আমাদের স্বাস্থের জন্য ভালো নয়? এই প্রশ্নের জবাব নিয়ে আলোচনা করবো আজকের এই প্রতিবেদনে।
সরিষার তেলের গুণাগুণ, Qualities of Mustard Oil: :
সরিষার তেলকে স্বাস্থ্যকর তেল বলা হয়। এর কারণ হল এতে আছে ওমেগা আলফা ৩ ও ওমেগা আলফা ৬ ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন E ও অ্যান্টি অক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ উৎস। ঔষধি গুণাগুণের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় সরিষার তেল ব্যবহার হয়ে আসছে।
ত্বক, চুল ও স্বাস্থ্যের জন্য সরিষার তেলের অসাধারণ উপকারিতা রয়েছে। সরিষার তেলে থাকা রিবোফ্ল্যাভিন (Riboflavin) ও নায়াসিন (Niacin) সমৃদ্ধ সরিষার তেল শরীরে মেটাবলিজম বাড়িয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাছাড়া আরো বিভিন্নভাবে সরিষার তেল আমাদের স্বাস্থের জন্য উপকারী।
সরিষার তেলের বিভিন্ন উপকারিতা, Various Benefits of Mustard Oil :
১। হজম প্রক্রিয়া ভালো রাখে :
সরিষার তেল আমাদের হজম প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছল রাখতে সহায়তা করে এবং মেটাবলিক রেট বৃদ্ধি করে। পাকস্থলীর পাচক রস উদ্দীপিত করার মাধ্যমে ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে সরিষার তেল।
২। প্রদাহ বিরোধী :
সরিষার তেলে প্রদাহ বিরোধী উপাদান আছে, যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। কারও হাঁটুর ব্যথা, অন্যান্য জয়েন্টের ব্যথা, আর্থ্রাইটিস (বাত) এবং রিউম্যাটিক এর ব্যথা থাকলে সেটাও দূর করে।
৩। ক্যান্সার রোধক গুণ :
সরিষার তেলে আছে গ্লুকোসিনোলেট নামক উপাদান যা মলাশয়ের ক্যান্সার এবং অন্ত্রের ক্যান্সার রোধ করতে সহায়তা করে। ক্যান্সারজনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে সাহায্য করে সরিষার তেল। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ক্যান্সার থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
৪। ফুসফুস পরিষ্কার রাখতে সহযোগী :
সরিষার তেল হল এক ধরণের ডিকঞ্জেস্টেন্ট বা শ্বাসতন্ত্র পরিষ্কারক। কফের সমস্যা থাকলে অথবা সর্দি কাশির সমস্যায় এই তেলের সাথে রসুন মিশিয়ে বুকে ও পিঠে লাগালে বা মালিশ করলে কফজনিত সমস্যার সমাধান হয়।
৫। হৃদিপিন্ড সুস্থ রাখতে সহায়তা করে :
সরিষার তেলে থাকে মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা ভাল কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি ৭০% কমিয়ে আনতে পারে।
৬। অ্যাজমা রোগে সরিষার তেলের ব্যবহার :
অ্যাজমা আক্রমণ হলে সরিষার তেল বুকে ঘষলে শ্বাস নেয়ার ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে যায়। তাছাড়া সবসময় এই তেলের ব্যবহার আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
৭। ত্বক ও চুলের যত্নে সরিষার তেলের ব্যবহার :
শীতের সময় সরিষার তেল ত্বকে ব্যবহার করলে ত্বকের শুষ্কতা দূর হয় এবং আমাদের শরীরও গরম থাকে। এই তেলের মধ্যে রয়েছে ব্যাক্টেরিয়া এবং ফাঙ্গাস বিরোধী গুণাগুণ, যা ত্বক ও চুলকে উজ্জ্বল করে তুলতে সক্ষম। এই তেল ব্যবহার করলে ত্বকের উজ্জ্বলতা উন্নতি হয়।
অন্যদিকে সরিষার তেল চুলের বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে, অকালে চুল সাদা হওয়া রোধ করে, পাশাপাশি চুল পড়া কমায়। সরিষার তেলে রয়েছে ভিটামিন ও খনিজ, বিশেষ করে উচ্চমাত্রার বিটা ক্যারোটিন থাকায় এটি চুলের জন্য উপকারী।
বিটা ক্যারোটিন ভিটামিন A তে রূপান্তরিত হয় এবং চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়াও এই তেলে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফ্যাটি এসিড ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে যা চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আপনি চাইলে প্রতিরাতে চুলে সরিষার তেল মালিশ করে লাগানোর অভ্যাস করে আপনার চুল কালো হবে।
৮। নাভিতে সরিষার তেল :
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কেউ যদি নাভিতে কয়েক ফোঁটা সরিষার তেল দিয়ে রেখে দেয় তবে বেশ সুফল পাওয়া যায়।
৯। স্মরণশক্তি বৃদ্ধি ও চেতনার উন্নয়নে সরিষার তেল :
সরিষার তেল স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে এবং এটি চেতনার উন্নয়নেও সহায়তা করে।
১০। মাসিকের ব্যথায় :
মেয়েদের মাসিকের ব্যথা এবং গ্যাস ও বদহজম জনিত সমস্যায় পেটের ব্যথা হলে তখন সরিষার তেল পেটে মালিশ করলে সুফল পাওয়া যায়।
১১. ঠোঁটের যত্নে সরিষার তেল :
সরিষার তেল শুষ্ক ঠোঁটের যত্নে চমৎকার প্রতিকার হিসেবে কাজ করে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনার ঠোঁট অল্পখানি সরিষার তেল দিন, তাছাড়া রোজ নাভিতে এই তেল প্রয়োগ করলেও আর কখনোই আপনার ঠোঁট শুকাবে না বা ফাটবে না।
১২. উদ্দীপক হিসেবে সরিষার তেল :
আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন পরিপাক, রক্ত সংবহন ও রেচন তন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে সরিষার তেল। খাবারের সাথে এটি গ্রহণ করার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে শরীরে মালিশ করলেও শরীরের রক্ত সঞ্চালন এবং ঘর্ম গ্রন্থি উদ্দীপিত হয়। ফলে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়।
১৩. পোকামাকড় এবং মশা তাড়ানোর কাজে
পোকামাকড় এবং মশা তাড়ানোর ঔষধ হিসাবে ৬সরিষার তেল। এর গন্ধে বেশিরভাগ পোকামাকড় আপনার কাছে ঘেঁষবে না।
১৪. দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় সরিষার তেল
সুস্থ দাঁত বজায় রাখতে এবং জিঞ্জিভাইটিস ও পেরিওডন্টাইটিস রোগ প্রতিরোধে সরিষার তেল বিশেষ ভাবে সহায়ক।
দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় সরিষার তেল ব্যবহার করতে হলে ১/২ চা চামচ সরিষার তেল + ১ চা চামচ হলুদের গুঁড়া + ১/২ চা চামচ লবণ নিয়ে একসাথে মিশিয়ে দাঁত ও মাড়িতে হালকা করে দু’বেলা ঘষুন।
সরিষার তেলে ব্যবহারের সতর্কতা, Cautions before using Mustard Oil :
সরিষার তেলের কিছু অসুবিধা রয়েছে যেমন ইউরিক অ্যাসিডের উপস্থিতি, যার ফলে ড্রপসি হয়, জ্বালা হয় ইত্যাদি। সরিষার তেলে ইউরিক এসিড থাকে, এই কারণে রান্নার কাজে এই তেল ব্যবহার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপ প্রমুখ দেশে নিষিদ্ধ।
অতিরিক্ত মাত্রায় সরিষার তেল খেলে শরীরে ইউরিকিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়, যা হার্টের ক্ষতি করতে পারে। সরিষার অ্যালার্জি থাকে তবে ত্বকে সরিষার তেল ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন।
শিশুদের শরীরে সরিষার তেল দিলে কি হয়? What happens when you apply mustard oil in children’s body?
শিশুর ঠান্ডা লাগার আশঙ্কা থাকে না। সরিষার তেলের মধ্যে কয়েকটি রসুনের কোয়া দিয়ে গরম করে তা ঠান্ডা করে শিশুর বুকে মালিশ করলে সাধারণ সর্দি-কাশি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সরিষার তেলে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান রয়েছে। তাই ত্বকে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
প্রতিদিন কতটুকু সরিষার তেল খাওয়া ভালো? How much mustard oil is good to consume every day?
“প্রতি মাসে প্রায় 600-700 মিলি সরিষার তেল খাওয়া আদর্শ। প্রতিদিন গ্রহণ করলে, এটি এক চা চামচ পরিমাপ গ্রহণ করতে পারেন।
হলুদ সরিষার তেল খাওয়া কি ভালো? Is it good to consume yellow mustard oil?
হলুদ সরিষা বীজের তেল রান্না করার জন্য একটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর তেল । এটির ব্যতিক্রমী তাপ স্থিতিশীলতা এবং পুষ্টি-সংরক্ষণ ক্ষমতা রয়েছে এবং খাবারে মনোরম স্বাদ যোগ করে।
অন্যান্য উদ্ভিজ্জ তেলের পরিবর্তে এই তেল ব্যবহার করা আপনার খাবারের পুষ্টিরকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে হলুদ সরিষাতে সোডিয়ামও বেশি থাকে, যা অতিরিক্ত খাওয়া হলে আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
পরিশেষে, Conclusion :
বাজারে যে তেলগুলো পাওয়া যায় সেই সব তেলের মধ্যে সরিষার তেল সব থেকে বেশী স্বাস্থ্যকর। তবে এই তেল হওয়া উচিত খাঁটি ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল বা কোল্ড প্রেসড । কিছু দেশে দেশগুলিতে নিষিদ্ধ হলেও সরিষার তেল এশিয়ার সর্বত্র রান্নার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আশা করি আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা সরিষার তেলের নানা ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
Frequently asked questions
বিজ্ঞান বলছে, না। তেল ব্যবহারে ত্বক কালো হয়, এরকম ধারণা একদম ভ্রান্ত।
অপরিশোধিত তেল কাচ্চি ঘানি বা কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল নামে পরিচিত। এটি একটি রাসায়নিক-মুক্ত উত্পাদন প্রক্রিয়া।
মাথার ত্বকে প্রয়োগ করা হলে, সরিষার তেল চুলের বিকাশকে উৎসাহ, এর কারণ কারণ এটি রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে।