পৃথিবীতে এমন কিছু স্থান আছে যা তাদের সৌন্দর্য, ইতিহাস কিংবা সংস্কৃতি দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে। আবার কিছু জায়গা আছে, যা তাদের গভীর রহস্য আর লোককথার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে, যেখানে পা রাখলে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।
ইয়েমেনের শুষ্ক ও অনুর্বর মরুভূমির গভীরে এমনই এক আশ্চর্য রহস্য লুকিয়ে আছে – বারহুতের কূপ। এটি নিছকই একটি গর্ত নয়, বরং কিংবদন্তি আর অলৌকিক গল্পে মোড়া এক বিশাল প্রাকৃতিক বিস্ময়, যা স্থানীয়দের কাছে ‘নরকের কূপ’ বা ‘নরকের দরজা’ নামেই পরিচিত।
রহস্যে ভরা বারহুতের কূপ:
পূর্ব ইয়েমেনের বারহুত উপত্যকায় অবস্থিত এই কূপটি প্রায় ৩০ মিটার চওড়া এবং এর গভীরতা প্রায় ১১২ মিটার। যদিও পূর্বে এর গভীরতা ১০০ থেকে ২৫০ মিটারের মধ্যে অনুমান করা হতো, কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ওমানী গুহা অনুসন্ধানকারী দল প্রথমবারের মতো এর তলদেশে পৌঁছানোর দাবি করে, যা এই রহস্যের কপাট খুলে দেয়।
এর আগে, ইয়েমেনের বিজ্ঞানীরা এবং অন্যান্য অভিযাত্রীরা বারবার চেষ্টা করেও এর তলদেশে পৌঁছাতে পারেননি। কারণ ছিল কূপ থেকে নির্গত তীব্র, অসহনীয় দুর্গন্ধ এবং অক্সিজেনের অভাব, যা তাদের পিছু হটতে বাধ্য করেছিল।
মাহরার ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও খনিজ সম্পদ কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সালাহ বাহাইর বলেন, “এটি খুবই গভীর – আমরা কখনও এই কূপের তলদেশে পৌঁছাতে পারিনি কারণ এখানে খুব কম অক্সিজেন এবং বায়ুচলাচল নেই। আমরা স্থানটি পরিদর্শন করতে এবং কূপে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছি, ৫০-৬০ মিটারেরও বেশি নীচে পৌঁছেছি। আমরা ভিতরে অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। আমরা কিছু অদ্ভুত গন্ধও পেয়েছি… এটি একটি রহস্যময় পরিস্থিতি।” তার কথাগুলো এই স্থানের প্রতি স্থানীয়দের ভয় ও শ্রদ্ধার মনোভাবকেই তুলে ধরে।
বারহুতের কূপকে ঘিরে লোককথা আর অভিশাপের গল্প :

শত শত বছর ধরে বারহুতের কূপকে ঘিরে অজস্র লোককাহিনী প্রচলিত আছে। কিছু গল্প অনুসারে, এটি নাকি রাক্ষসদের কারাগার, যেখানে তাদের পাপের শাস্তি দেওয়া হয়। আবার কিছু বিশ্বাস অনুযায়ী, এটি একটি অভিশপ্ত দরজা, যা থেকে একদিন রাক্ষসেরা বেরিয়ে এসে পৃথিবীকে ধ্বংস করবে। যারা এই কূপের কাছাকাছি গেছেন বা ভেতরে নামার চেষ্টা করেছেন, তারা এক অসহনীয়, পচা ডিমের মতো গন্ধের কথা জানিয়েছেন, যা এই স্থানের অলৌকিক গল্পগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
ইয়েমেনের আম্মার হাশেম মোহাম্মদ উসমান নামের একজন ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, কূপের কাছে একটি সামরিক শিবিরে কাজ করার সময় তিনি এতটাই ভয়ংকর গন্ধ পেয়েছিলেন যে, তার পোশাক ও শরীর থেকে আসা দুর্গন্ধের কারণে তিনি দীর্ঘদিন ঘুমাতেও পারেননি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তার শিবিরের জলের উৎসটি বারহুতের কূপের সাথে সংযুক্ত ছিল।
বিজ্ঞানের আলোয় কূপের রহস্যের উন্মোচন?
তবে ২০২১ সালে ওমানী অভিযাত্রীদের দলটি, যারা সাহসিকতার সাথে কূপের তলদেশে পৌঁছায়, তারা এই গন্ধের একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়। তাদের মতে, এই দুর্গন্ধ মূলত মৃত পাখির পচনের কারণে সৃষ্টি হয়। তারা কোনো ‘অসহনীয়’ বা ‘অতিপ্রাকৃত’ গন্ধের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন।
ওমানী দলটি কূপের গভীরে পৌঁছে আরও অনেক আশ্চর্যজনক জিনিস আবিষ্কার করে। তারা স্ট্যালাগমাইট ও গুহা মুক্তার মতো উজ্জ্বল ভূতাত্ত্বিক কাঠামো খুঁজে পান, যা ফোঁটা ফোঁটা জল জমে তৈরি হয়। এছাড়াও তারা কূপের ভেতরে জলপ্রপাত এবং সাপ দেখতে পান, কিন্তু কোনো দানব বা জিনের অস্তিত্ব ছিল না।
এই আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কূপের রহস্য বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি প্রমাণ করে যে, লোককথার আড়ালে প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি লুকিয়ে আছে। তবে এই রহস্যময় গর্ত সম্পর্কে আরও গভীর গবেষণা প্রয়োজন।
কিন্তু ইয়েমেনে চলমান গৃহযুদ্ধ এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রচলিত গভীর ভয়ের কারণে, বারহুতের কূপটি হয়তো আরও কিছু সময়ের জন্য তার রহস্যময় এবং ভীতিকর আভা বজায় রাখবে। কে জানে, হয়তো আরও কত রহস্য লুকিয়ে আছে এর অতল গভীরে।