নরসিংদী জেলা বাংলাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত। এটি ঢাকা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল। জেলাটি অন্তর্ভুক্ত উপজেলার সংখ্যানুসারে নরসিংদী বাংলাদেশের একটি “বি” শ্রেণীভুক্ত জেলা। বেশ কিছু ঐতিহাসিক তথ্যাবলি থেকে অনুমান করা হয় যে, নরসিংদী জেলার অধিকাংশ অঞ্চল প্রাচীন সুবর্ণবীথি রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। রাজ্যের তৎকালীন রাজা নরসিংহের নামেই এই স্থানের নরসিংদীর নামকরণ করা হয়। নরসিংদীকে ১৯৭৭ সালে মহকুমায় এবং ১৯৮৪ সালে জেলায় উন্নীত করা হয়।
নরসিংদী জেলার অবস্থান ও আয়তন, Location and area of Narsingdi district
নরসিংদী জেলাটি বাংলাদেশের মধ্য-পূর্বাংশে অবস্থিত। মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ তীর বিধৌত জেলা নরসিংদী। ২৩°৪৬’ থেকে ২৪°১৪’ উত্তর অক্ষরেখা এবং ৯০°৩৫’ ও ৯০°৬০’ পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত এই জেলা। উক্ত জেলাটির উত্তরে কিশোরগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রয়েছে, পূর্বে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, পশ্চিমে রয়েছে গাজীপুর জেলা।
নরসিংদীর ইতিহাস, History of Narsingdi
পূর্বে নরসিংহ নামক রাজার শাসনাধীন ছিল নরসিংদী অঞ্চলটি। ইতিহাসবিদদের ধারণা অনুযায়ী, প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রাজা নরসিংহ নরসিংহপুর নামে একটি ছোট নগর স্থাপন করেছিলেন। নরসিংদী নামটি রাজা নরসিংহের নাম অনুসারে উৎপত্তি হয়েছে বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদরা। নরসিংদী অঞ্চলটি এক সময়ে মহেশ্বরদী পরগনার অর্ন্তভূক্ত ছিল।
উক্ত পরগনার জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর একসময় নরসিংদী ছিল প্রশাসনিকভাবে ঢাকা জেলাধীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার একটি থানা। নরসিংদী ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর মাসে পাক হানাদারদের থেকে মুক্ত হয়। উক্ত অঞ্চলকে ১৯৭৭ সালে ঢাকা জেলার একটি মহকুমায় উন্নীত করা হয়। ১৯৮৪ সালে সরকার নরসিংদী সদর, পলাশ, শিবপুর, মনোহরদী, বেলাবো ও রায়পুরা-এই ৬টি উপজেলা এবং নরসিংদী পৌরসভা নিয়ে নরসিংদীকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করে।
জনসংখ্যা, Population
বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার মোট আয়তন ১,১১৪ বর্গ কি:মি:; অর্থাৎ প্রতি বর্গকিলোমিটারে লোকসংখ্যা ২২৪৭ জন। ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুসারে, নরসিংদী জেলার মোট জনসংখ্যা ২৫,৮৪,৪৫২ জন। এই পরিসংখ্যানের মধ্যে পুরুষদের সংখ্যা ১২,৬৫,৫৭৮ জন, নারী ১৩,১৭,৮৭৩ জন ও তৃতীয় লিঙ্গ ১৭৮ জন। পুরুষ ও নারীর লিঙ্গানুপাত অনুসারে হার ৯৬.০৩ শতাংশ। এখানকার পল্লী অঞ্চলে বাস করেন ১৯,৩৯,৮২০ জন ও শহর অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৬,৪৩,৮০৯ জন।
নরসিংদীর শিক্ষার হার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, Education Rate and Educational Institutions in Narsingdi
নরসিংদী জেলার জনগণের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৯%। জেলার সাক্ষর জনগণের মধ্যে ৭৫.৯৮% পুরুষ, ৭৩.৪৭% নারী ও ৫৪.৯৭% তৃতীয় লিঙ্গ।
নরসিংদী জেলার উল্লেখযোগ্য কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম হলো :
- নরসিংদী সরকারি কলেজ,
- সরকারি শহীদ আসাদ কলেজ,
- ব্রাহ্মন্দী কামিনী কিশোর মৌলিক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়,
- নরসিংদী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়,
- সাটিরপাড়া কালী কুমার ইন্সটিটিউশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ,
- স্কলাস্টিকা মডেল কলেজ,
- পাঁচদোনা স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়,
- জামেয়া কাসেমিয়া কামিল মাদ্রাসা,
- আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজ,
- ইউরিয়া সার কারখানা স্কুল এন্ড কলেজ,
- গয়েশপুর পদ্মলোচন উচ্চ বিদ্যালয়,
- মনোহরদী পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়,
- বাংলাদেশ তাঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট,
- ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ,
- নরসিংদী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট,
- পলাশ ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা,
- নারায়ণপুর রাবেয়া মহাবিদ্যালয়,
- হাজীপুর নাসির উদ্দিন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি।
নরসিংদী জেলায় ধর্মীয় দিক, Religious aspect in Narsingdi district
২০২২ সালের গণনা অনুসারে নরসিংদীর মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৯৪.৫০% মুসলমান, ৫.৪০% হিন্দু, ০.০১% বৌদ্ধ, ০.০৩% খ্রিষ্টান ও ০.০৬% অন্যান্য মতাবলম্বী ছিলেন। তাছাড়াও এই জেলায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে। যেমন: পারুলিয়া শাহী মসজিদ, কুমারদি মসজিদ, আশ্রাফপুর মসজিদ, ব্রাহ্মন্দী কালী মন্দির, চিনিশপুর কালী মন্দির, ঘোড়াশাল ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ইত্যাদি।
নরসিংদীর যোগাযোগ ব্যবস্থা, Communication system of Narsingdi
নরসিংদী জেলার সাথে সারা বাংলাদেশেরই সড়ক ও নৌ পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল আছে। নরসিংদী জেলায় মোট ১০টি রেল স্টেশন আছে। যথা: ঘোড়াশাল, ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ, জিনারদী, নরসিংদী, আমিরগঞ্জ, খানাবাড়ি, হাঁটুভাঙ্গা, মেথিকান্দা, শ্রীনিধি ও দৌলতকান্দি। নরসিংদী লঞ্চ টার্মিনাল, পান্থশালা ফেরী ঘাট, রায়পুরা ফেরী ঘাট, সায়েদাবাদ ফেরী ঘাট ইত্যাদির মাধ্যমে নরসিংদী জেলা নৌপথে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে যুক্ত। তাছাড়া পাঁচদোনা, ভেলানগর, ইটাখোলা, বারৈচা, নারায়ণপুর বাসস্ট্যান্ড এর মাধ্যমে দেশের সকল জেলার সাথে সড়ক পথে যাতায়াতের সুবিধা রয়েছে।
নরসিংদী জেলার অর্থনীতি, Economy of Narsingdi district
সমৃদ্ধ শিল্প :
প্রাচীনকাল থেকেই নরসিংদী অর্থনীতিতে সমৃদ্ধশালী। তাঁতশিল্প এই জেলার প্রধান হাতিয়ার। নরসিংদীর কাপড় উৎপাদন করার মূল কেন্দ্র হল মাধবদী। উক্ত এলাকার মানুষদের ব্যবসার মূল উৎস হলো কাপড় উৎপাদন করা। এখানে বিভিন্ন ধরনের কাপড় উৎপাদন করা হয়। প্রচুর পরিমাণে টেক্সটাইল মিল রয়েছে এই এলাকায়। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি কাপড়ের বাজার হল বাবুরহাট। সমগ্র বাংলাদেশের কাপড় ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পাইকারি কাপড় কিনে নিয়ে অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে।
কৃষি ব্যবস্থা :
নরসিংদী জেলা বাংলাদেশের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি জেলার উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষিপণ্য সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। কলা হল নরসিংদী জেলার সবচেয়ে বিখ্যাত কৃষিপণ্য। এখানকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষক। এই অঞ্চলের প্রধান ফসল হল : ধান, গম, আলু, সরিষা, চীনাবাদাম, বেগুন, বিভিন্ন ধরনের সবজি। অন্যদিকে প্রধান ফল হল কলা, কাঁঠাল, আম, জাম, পেঁপে, আনারস, পেয়ারা, কুল, লটকন ও তরমুজ।
জেলার প্রাকৃতিক সম্পদ :
১৯৯০ সালে নরসিংদীর শিবপুরে একটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল যা বর্তমানে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানী লিমিটেডের অধীন।
জেলার বৃহৎ শিল্প :
নরসিংদীর পলাশের ঘোড়াশালস্থিত ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এছাড়া ঘোড়াশাল সার কারখানা দেশের ইউরিয়া সারের চাহিদা পূরণ করতে সহায়ক। উক্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ জুট মিলস লিমিটেড এবং জনতা জুট মিলস লিমিটেডও রয়েছে। অন্যদিকে ১৯৩২ সালে পলাশের চরসিন্দুরে দেশবন্ধু চিনি কল লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম পাটকল হল নরসিংদী সদরের নাগরিয়াকান্দী এলাকায় ইউ.এম.সি. জুট মিলস লিমিটেড। উক্ত জেলায় সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন উন্নতমানের কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। ঘোড়াশালে অবস্থিত প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান কারখানা এবং শিবপুরে রয়েছে স্যামসাং কোম্পানির টেলিভিশন তৈরির কারখানা।
জেলার উল্লেখযোগ্য স্থানসমূহ, Notable places of the district
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন :
- উয়ারী-বটেশ্বর, আমলাব ইউনিয়ন, বেলাব উপজেলা
- অসম রাজার গড় (বটেশ্বর)
- পারুলিয়া শাহী মসজিদ
- বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, রামনগর গ্রাম, রায়পুরা উপজেলা
- ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাস্তুভিটা, বুড়ারহাট গ্রাম, পাঁচদোনা বাজার সংলগ্ন
- বালাপুর জমিদার বাড়ি
- লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ি
- সিধেন সাহার জমিদার বাড়ি
- কুন্ডু সাহার জমিদার বাড়ি
- মনু মিয়ার জমিদার বাড়ি (ঘোড়াশাল জমিদার বাড়ি)
- ঘোড়াশাল দোতলা রেলওয়ে স্টেশন (যা বাংলাদেশের প্রথম দ্বিতলবিশিষ্ট রেলওয়ে স্টেশন)
- চরসিন্দুর ব্রিজ
- সাটিরপাড়া রায় চৌধুরী জমিদার বাড়ি
- মাধবদী গুপ্তরায় জমিদার বাড়ি
- আমিরগঞ্জ জমিদার বাড়ি
- রায়পুরা উপজেলার মাহমুদাবাদ গ্রামে অবস্থিত ব্রিটিশ শাসনামলের নীল চাষের নিদর্শন ‘নীলকুঠি’।
বিনোদন মূলক স্থান :
- নাগরিয়াকান্দি ব্রিজ
- আরশিনগর মিনি পার্ক, নরসিংদী রেল স্টেশনের সাথেই।
- মুসলেহ উদ্দিন ভূইয়া স্টেডিয়াম, নরসিংদীর প্রধান ক্রীড়া কেন্দ্র
- ড্রিম হলিডে পার্ক, পাঁচদোনা
- ওয়ান্ডার পার্ক, মরজাল, রায়পুরা
- হেরিটেজ রিসোর্ট, মাধবদী।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় স্থান :
নরসিংদী জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যপূর্ণ স্থান হল সোনাইমুড়ি টেক, যা শিবপুর উপজেলায় অবস্থিত। এছাড়াও আছে হাওরা বিল।
শেষ কথা, Conclusion
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, অর্থনীতির দিক থেকে নরসিংদী যথেষ্ট উন্নত। এখানকার শিল্প সারা দেশ জুড়ে বিস্তৃত। এছাড়াও এই জেলায় বেশ কিছু ভ্রমণ স্থান রয়েছে। বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে গেলে একবার হলেও এই জেলা পরিদর্শনে যেতে পারেন।