বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা। তিনি ১৭৫৬ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর শাসনকালে সেনাপতি মীরজাফর ও রায়দুর্লভ- এর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে তিনি পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন। পরবর্তীতে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে।
জন্ম ও বংশপরিচয়, Birth and Genealogy :
সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়েছিল ১৭৩৩ সালে। তিনি ছিলেন বাংলার নবাব আলীবর্দী খান-এর নাতি। নবাব সিরাজ ছিলেন আলীবর্দী খান-এর তৃতীয়া কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র। সিরাজ তার নানার কাছে ছিল খুবই আদরের।
সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে কিছু তথ্য, Some information about Siraj-ud-Daulah :
- নবাব সিরাজউদ্দৌলার দাম্পত্য সঙ্গীদের নাম : লুৎফুন্নেসা বেগম, জেবুন্নেসা বেগম, উমদাদুন্নেসা বেগম।
- নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর : উম্মে জোহরা (কুদসিয়া বেগম)
- নবাব সিরাজউদ্দৌলার পূর্ণ নাম : নবাব মনসুর উল-মুল্ক সিরাজ উদ্দৌলা শাহ কুলী খান মির্জা মুহম্মদ হয়বৎ জঙ্গ বাহাদুর
- নবাব সিরাজউদ্দৌলার পিতা ও মাতার নাম : পিতা জৈনুদ্দীন আহমদ খান এবং মাতা আমিনা বেগম।
- নবাব সিরাজউদ্দৌলার ধর্ম : সুন্নি ইসলাম।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যাভিষেক, Coronation of Nawab Siraj-ud-Daulah :
আলিবর্দি সিরাজ-উদ-দৌলাকে বালক বয়সেই পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর রাজপ্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন জানকীরাম। সিরাজদ্দৌলা একদিন গোপনে ভ্রমণের নাম করে স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে বের হয়ে সোজা পাটনায় উপস্থিত হন। সেখানে জানকীরামকে শাসনভার ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেন।
নবাবের অনুমতি ছাড়া জানকীরাম শাসনভার ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে সিরাজদ্দৌলা দুর্গ আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষে লড়াই- এ হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এই ঘটনা জানতে পেয়ে আলিবর্দি খাঁ ঘটনাস্থলে পৌঁছান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আলিবর্দি খাঁ দুর্গের অভ্যন্তরস্থ দরবারে দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা করেন,
“ আমার পরে সিরাজ-উদ-দৌলাই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করবে।”
আলিবর্দী খানের জীবদ্দশায় সিরাজ-উদ-দৌলা ঢাকার নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল শাহ কুলি খান মির্জা মোহাম্মদ হায়বৎ জং বাহাদুর (সিরাজ-উদ-দৌলা) আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
নবাব হিসেবে সিরাজউদ্দৌলার প্রাথমিক কার্যাবলি, Siraj-ud-Daulah’s primary duties as Nawab :
মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার ও কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ :
সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের প্রতাপ দমন করার জন্য কাশিমবাজারের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে কলকাতার দুর্গপ্রাচীর ভেঙে ফেলতে বলেন। পাশাপাশি বলেন ভবিষ্যতে নবাবের পূর্বানুমতি ছাড়া যেন এ ধরনের কাজ না করা হয়। এরূপ নির্দেশ পেয়েও ইংরেজরা তাঁর আদেশ অমান্য করে তারা কাজ বহাল রাখলেন।
গৃহবিবাদের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা উদ্ধত স্বভাবের পরিচয় দিচ্ছে, একথা সিরাজ-উদ-দৌলা বুঝতে পারলেন। তাই তিনি প্রথমেই ঘসেটি বেগমের চক্রান্ত চূর্ণ করার জন্য সচেষ্ট হন। মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার করে নবাব ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসেন। এরপর নবাব কাশিমবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কাশিমবাজার দুর্গের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার জন্য অঙ্গীকারপত্র লিখতে বাধ্য করেন।
কলকাতা আক্রমণ করেন :
১৭৫৬ সালের ১৮ জুন সিরাজ-উদ-দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন। দুদিন তুমুল যুদ্ধ হওয়ার পর ২০ জুন কলকাতা দুর্গ সিরাজের দখলে আসে। সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা রাজধানীতে ফিরে আসেন।
উক্ত দুই কাজ ছাড়াও নবাব হিসেবে তিনি নবাবগঞ্জের যুদ্ধ, কুচক্রী সেনাপতিদের বিচার করা এবং তাদের বন্দি করার ব্যবস্থা করেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা কখন বাংলার নবাব হন? When did Nawab Siraj-ud-Daulah become the Nawab of Bengal ?
সিরাজউদ্দৌলা তার নানা নবাব আলীবর্দী খানের কাছ থেকে ২৩ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাবের ক্ষমতা অর্জন করেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে কিভাবে হত্যা করা হয়? How was Nawab Siraj-ud-Daulah killed ?
প্রায় ৩০০ বছর পুরনো ভগ্নপ্রায় এই প্রাসাদটি নিমক হারাম দেউরি নামে পরিচিত। মুর্শিদাবাদের অন্যতম ঐতিহাসিক জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। তবে এই প্রাসাদটি জাফরগঞ্জ প্রাসাদ নামেও বেশ পরিচিত। এখানেই সপরিবারে থাকতেন মিরজাফর ঐতিহাসিক সুত্র মতে এই প্রাসাদেই হত্যা করা হয়েছিল বাংলার শেষ স্বাধিন নবাব সিরাজউদ্দলাকে। ১৯৫৭ সালে
২ জুলাই নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদের খোশবাগে তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল।
সিরাজউদ্দৌলার কত হাজার সৈন্য ছিল? How many soldiers did Siraj-ud-Daulah have ?
পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়- ২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে । পলাশীর যুদ্ধে নবাব বাহিনীর পক্ষে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫ হাজার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ছিল মাত্র ৩ হাজার। যুদ্ধের ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও তার অনুসারী প্রায় ৪৫ হাজার সৈন্য নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধ ১১ ঘন্টার মধ্যে শেষ হয় এবং সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজয়ের পরে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পালিয়ে যান। ব্রিটিশ সৈন্যদের মধ্যে ২২ জন মারা যায় এবং ৫০ জন আহত হয়েছিল। নবাব বাহিনী প্রায় ৫০০ জন সৈন্যকে হারিয়েছিল, যার মধ্যে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলেন।
পলাশীর যুদ্ধ কেন সংঘটিত হয়েছিল? Why was the Battle of Plassey fought ?
পলাশীর যুদ্ধ হল রবার্ট ক্লাইভ এবং সিরাজ-উদ-দৌলার (বাংলার নবাব) নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাহিনীর মধ্যে একটি যুদ্ধ। বাণিজ্য সুবিধার EIC কর্মকর্তাদের ব্যাপক অপব্যবহার সিরাজকে বিরক্ত করেছিল। সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে EIC-এর অব্যাহত অসদাচরণ 1757 সালে পলাশীর যুদ্ধের দিকে পরিচালিত করে।
পলাশীর যুদ্ধের কারণ কি ছিল? What was the reason for the Battle of Plassey ?
পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার প্রধান কারণ ছিল:
- বাংলার নবাব কর্তৃক ব্রিটিশদের দেওয়া বাণিজ্য সুবিধার ব্যাপক অপব্যবহার
- ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শ্রমিকদের কর ও শুল্ক পরিশোধ না করা।
পলাশীর যুদ্ধের প্রভাব কি ছিল? What were the effects of the Battle of Palashi?
পলাশীর যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে জেনে নিন :
যুদ্ধের রাজনৈতিক প্রভাব
- মীরজাফর বাংলার নবাব এর সিংহাসন লাভ করেন।
- মীরজাফর নিজের অবস্থানে অসন্তুষ্ট ছিলেন, তাই তিনি নিজের ভিত্তি মজবুত করতে ডাচদের ব্রিটিশদের আক্রমণ করতে প্ররোচিত করেছিলেন।
- 1759 সালের 25 নভেম্বর ডাচ ও ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। এরপর ইংরেজরা মীরকাসিমকে বাংলার নবাব হিসেবে নিযুক্ত করে।
- বাংলাকে ইংরেজরা ইউরোপীয় শক্তিতে পরিণত হয়।
- যুদ্ধের পর রবার্ট ক্লাইভকে “লর্ড ক্লাইভ” উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব
- যুদ্ধের ফলে ভারতের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- যুদ্ধে বিজয় লাভ করার পর ব্রিটিশরা কর আদায়ের নামে বাংলার অধিবাসীদের ওপর কঠোর নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দিতে শুরু করেছিল।
রাতারাতি কিভাবে ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির একজন হয়ে উঠেন ক্লাইভ, How Clive became one of the richest people in Europe overnight !
পলাশীর যুদ্ধের পর সিরাজউদ্দৌলার রাজকোষ থেকে পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছিলেন ক্লাইভ। প্রসিদ্ধ ইতিহাসকার উইলিয়াম ডালরিম্পল ‘দা অ্যানার্কি’তে বইতে লিখেছেন: “এই যুদ্ধ জয়ের জন্য ক্লাইভের পাওনা হয়েছিল দু’লাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড। এছাড়া জমিদারীর মালিক হিসাবে প্রতিবছর ২৭ হাজার পাউন্ড পাওয়ার কথা ছিল। যদি এই বিপুল অর্থ তিনি সত্যিই পেতেন, তাহলে মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই রবার্ট ক্লাইভ হঠাৎই ইউরোপের সবথেকে ধনী ব্যক্তিদের একজন হতে পারতেন।”
সিরাজউদ্দৌলার পলায়ন, Escape of Siraj-ud-Daulah :
ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে পরাজয় হলে সিরাজউদ্দৌলা বিশ্বস্ত আত্মীয়দের নিয়ে পালিয়ে যান। ফারসি ভাষায় লেখা ‘সিয়ারুল মুতাখিরী’ বইতে ইতিহাসবিদ সৈয়দ গুলাম হুসেইন খান লিখেছেন, “সিরাজউদ্দৌলা সাধারণ মানুষের বেশে রাজধানী থেকে বেরিয়ে গেছেন। সঙ্গে আছেন কিছু বিশ্বাসভাজন আত্মীয়স্বজন, আর কয়েকজন হিজড়া। রাত তিনটের সময়ে স্ত্রী লুৎফ-উন-নিসা আর কয়েকজন ঘনিষ্ঠকে ঢাকা দেওয়া গাড়িতে বসানো হল। সোনা জহরত যতটা সম্ভব নিয়ে প্রাসাদ ছাড়লেন সিরাজ,”।
শেষ কথা, Conclusion :
সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বের সমাপ্তি বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের অবসান ঘটায় এবং ভারতে ব্রিটিশ ক্ষমতার সূচনা করে। আশা করি আজকের এই প্রতিবেদনে নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকাল সম্পর্কে উল্লেখ করা তথ্যগুলো থেকে আপনারা বাংলায় নবাবদের শাসনের শেষ সময়ের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।
Frequently Asked Questions
পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল সিরাজ-উদ-দৌলার ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর মধ্যে।
1757 সালে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
পলাশীর যুদ্ধকে ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত বলা হয় কারণ এই যুদ্ধকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রধান উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়।