দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির বুকে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করার কথা ভাবলেই যেন মনটা নেচে ওঠে। তবে এটা শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ নয়, এমন একটি অভিজ্ঞতা পেতে চাইলে চলে যান নিকলী হাওর। উল্লেখ্য নিকলী হাওর বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলায় অবস্থিত। নিকলীর অপরূপ হাওর ভ্রমণ আপনার জীবনে মনে রাখার মত একটি ভ্রমণ হিসেবে গেঁথে থাকবে।
নিকলী হাওরের নামের ব্যাখ্যা, Nikli Haor Name Explanation
হাওর কথাটি মূলত সাগর শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। সাগর থেকে উচ্চারণ বিকৃতিতে সায়র এবং সায়র থেকে হাওর শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে বলে এর ব্যাখ্যায় বলা আছে। বর্ষাকালে বিশাল হাওর এলাকায় অথৈ জলরাশি দেখলে যেকোনো ব্যক্তিরই হয়তো সাগরের কথাই মনে পড়বে। এর থেকে বুঝতে পারা যায় যে হাওর আর কিছু নয়, এটা অপেক্ষাকৃত বড় জলাভূমি। এই জলাভূমি নিকলী উপজেলার অংশ বলেই হয়তো এটি নিকলী হাওর নামে পরিচিত।
নিকলী হাওর যাবার উপায়, How to go to Nikli Haor?
ঢাকা বা কিশোরগঞ্জ জেলার আশপাশ থেকে একদিনে ঘুরে আসতে পারবেন নিকলী হাওর থেকে। নিকলী হাওরে ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে, দুইভাবেই যেতে পারবেন। নিকলি উপজেলার দূরত্ব কিশোরগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার। জলভাগে দ্বীপের মত ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, স্বচ্ছ জলের খেলা, মাছ ধরতে জেলেদের ব্যস্ততা, রাতারগুলের মত ছোট জলাবন ও খাওয়ার জন্যে হাওরের তরতাজা নানা ধরনের মাছ। এই সব কিছুর অভিজ্ঞতা পেতে চাইলে নিকলীর অপরূপ হাওর ভ্রমণ অবশ্যই করতে পারেন। ঢাকা থেকে একদিনেই ঘুরে আসা সম্ভব এই হাওর থেকে।
নিকলী হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়, Best time to visit Nikli Haor
হাওরের রূপ সঠিকভাবে উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে বর্ষাকাল বা এই ঋতুর ঠিক পরের সময়কালে যেতে হবে। তাই বলা যায় যে নিকলী হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় জুলাই – সেপ্টেম্বর মাস। নৌকা চলতে শুরু করা মাত্রই হারিয়ে যেতে হয় জলরাশির রাজ্যে। দূর থেকে আরো যত দূরে চোখ যাবে, স্নিগ্ধ গ্রামের মতোই শান্ত অথৈ জল প্রাণ জুড়িয়ে দেবে।
জলের সীমানা শেষ হতেই যেন বিস্তৃত আকাশ। তারই মাঝখানে কিছু ঘরবাড়ি। নৌকার চালকদেরই বসবাস এখানে। মাছ ধরার সঙ্গেও জড়িত এ অঞ্চল। তবে সেপ্টেম্বর মাসে তুলনামূলকভাবে জল অনেক কম হয়ে যায়। এছাড়া কেউ চাইলে বছরের যে কোন সময়ই যেতে পারেন হাওরের ভিন্ন এক রূপ দেখার জন্যে।
নিকলী হাওরে নৌকা ভাড়া, Boat rental in Nikli Haor
নিকলী হাওরে গিয়ে নৌকা করতে চাইলে সাধারণত মাঝিরা এক ঘণ্টার জন্য ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ভাড়া নেয়। আবার কেউ চাইলে কয়েক ঘণ্টার জন্যও ভাড়া নিতে পারেন, সেক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ টাকার মতো করে দিতে হবে। তবে নৌকা ভাড়া করার সময় অবশ্যই ভাড়া দামাদামি করে নিতে হবে। নৌকাগুলো আকারে বেশ বড়সড়ও হয়, একটি নৌকোয় প্রায় ১৫-২০ জন পর্যন্ত অনায়াসে ঘুরে আসতে পারবেন। তবে এখানে নৌকার আকার অনুযায়ী ভাড়ার খুব একটা বেশি বা কম হয় না।
নিকলী হাওর গিয়ে যা যা দেখবেন, What to visualize at Nikli Haor
- নিকলী হাওরে বিশাল আকাশ, বিশাল জলরাশি আর বিশাল খোলা প্রান্তর দেখলে মনটাও যেন বিশাল হয়ে যায়। নিকলী হাওর গিয়ে যা যা দেখবেন :
- নিকলীর জলের বাঁধে গিয়ে দেখা যায় যে ছোট ছোট বাচ্চারা মাছ ধরছে। জলে খেলা করছে।
- নিকলী বেড়ি বাঁধের পাশে আছে গ্রাম, যেখানে গ্রামের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়।
- জলের মধ্যে নানা রকম জাল দিয়ে হাওরে জেলেরা মাছ ধরছেন, এমন দৃশ্য তো চোখে পড়বেই।
- গ্রামের অনেক শিশুরা জলে ফুটবলও খেলে, আবার বহু পর্যটকও অথৈ জলে নেমে বিভিন্ন খেলা খেলেন মূলত সময় কাটানোর জন্য।
- হাওরের কিছু এলাকায় রয়েছে করচের বন, যা নৌকা দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করা যায়।
- নিকলী হাওরে কিছু পাল তোলা নৌকাও দেখা যায়।
- ইঞ্জিনের নৌকা তো এখন সর্বত্র। তাই ডিঙি নৌকা এখন আর বেশি দেখা যায় না।
- দুপুরের রোদে ঝিম মারা হাওরের জল চকচক করে।
- আজকাল কারেন্ট জাল দিয়েও হাওরে মাছ ধরছে অনেকে।
- হাওরের জলের মাঝে আছে এক টুকরো মাঠ, আর সেখানেই চলে বাচ্চাদের খেলা, আবার সেটা গ্রামের মানুষের গরু ছাগলদের চারণভূমিও বটে।
নিকলীর অন্যান্য কিছু দর্শনীয় স্থান, Some other places to visit in Nikli
- গুরই শাহী জামে মসজিদ – রিকশা বা মটরসাইকেলে করে সহজেই ঘুরে আসতে পারেন।
- নিকলী বেড়ি বাঁধ – নিকলী উপজেলা অফিসের সামনে থেকে বেড়িবাঁধ শুরু তাই হেঁটে – হেঁটে দেখা যাবে তার সৌন্দর্য।
- পাহাড় খাঁর মাজার – নিকলী উপজেলা থেকে ট্রলারে করে ও মটর সাইকেলে করে যাওয়া যায়।
- গুরই প্রাচীনতম আখড়া – কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলায় গুরই ইউনিয়নে এই আখড়া অবস্থিত। শুকনো মৌসুমে রিকসা, মটরসাইকেল, সিএনজি দিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু বর্ষা মৌসুমে নৌকা বা ট্রলার যোগে যেতে হয়।
ঢাকা থেকে ট্রেনে যাওয়ার উপায়, Ways to go to Nikli Haor by train from Dhaka
ঢাকা হতে ট্রেনে গিয়ে একদিনে ঘুরে আসতে পারেন। যদি ট্রেনে আসেন তাহলে সবচেয়ে ভাল হবে কিশোরগঞ্জ সদরের আগের ষ্টেশন অর্থাৎ গচিহাটা ষ্টেশনে নেমে গেলে। তবে ঐ দিনই ফিরতে চাইলে যাবার পথে আপনাকে বাসে যেতে হবে।
ঢাকা থেকে বাসে যাওয়ার উপায়, Bus route from Dhaka
ঢাকা থেকে বাসে আসতে চাইলে ঢাকার গোলাপবাগ থেকে যাতায়াত অথবা অনন্যা সুপার বাস সার্ভিসে আসতে হবে। দিনে ঘুরে রাতের মধ্যে ফিরতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই সকাল ৭টার আগেই বাসে রওনা দিতে হবে।
কিশোরগঞ্জ থেকে নিকলী যাওয়ার ব্যবস্থা, Arrangements to go from Kishoreganj to Nikli
কিশোরগঞ্জ জেলা শহর থেকে নিকলী যেতে কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে ষ্টেশনের সংলগ্ন নিকলীগামী সিএনজি ষ্টেশনে এসে সিএনজি ভাড়া করে নিকলী পৌঁছে যেতে পারবেন।
নিকলী হাওরে কোথায় খাবেন, Where to eat at Nikli Haor
নিকলী হাওরে এসে যেখানে নামবেন সেখানেই মোটামুটি মানের কয়েকটি খাবার হোটেল আছে। তাছাড়া আছে ছোটো ছোটো ক্যাফে এবং রেস্তোরাঁ। তবে এই এলাকার উল্লেখযোগ্য খাবার হল হাওরের তাজা মাছ দিয়ে তৈরি নানা পদ, যা দিয়ে ১০০ থেকে ২০০ টাকায় ভরপেট খেয়ে নিতে পারবেন।
নিকলী হাওরে থাকার ব্যবস্থা, Lodging facilities
নিকলী হাওরে গিয়ে আশেপাশে কোনো ভালো আবাসিক হোটেল পাবেন না। তবে এখনকার চেয়ারম্যান গেস্ট হাউজ অথবা উপজেলা ডাক বাংলো তে থাকতে পারবেন। কেউ চাইলে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে ফিরে গিয়েও সেখানে হোটেল ভাড়া করে থাকতে পারবেন। অন্যদিকে কেউ চাইলে নৌকায় বা ক্যাম্পিং করে রাত পার করে দিতে পারবেন। তবে অনেকের নিরাপত্তার বিষয়টা নিয়ে ভয় থাকে, সেদিকে একটু সতর্ক থাকতে হবে। কেউ যদি হাওরে রাতে থেকে যান, তবে হাওরের মাঝখানে সাবধানে চলাচল করা উচিত।
শেষ কথা, Conclusion
কটা বিষয় আমাদের মনে রাখা উচিত যে পর্যটন স্থান একটি দেশের সম্পদ, তাই পর্যটকদেরও উচিত এইসব স্থানের প্রাকৃতিক কিংবা সৌন্দর্য্যের জন্যে ক্ষতিকর এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকা।
তাছাড়া সকলের মাথায় থাকা উচিত যে, দেশ আমাদের, দেশের সকল কিছুর প্রতি যত্নবান হবার দায়িত্বও আমাদের। প্রসঙ্গত আরো একটি কথা উল্লেখ করা উচিত যে, হোটেল, রিসোর্ট, যানবাহন ভাড়া ও অন্যান্য খরচ সময়ের সাথে পরিবর্তন হয় তাই প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য বর্তমানের সাথে মিল না থাকতে পারে। তাই কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার আগে বর্তমান ভাড়া ও খরচের তথ্য ভালোভাবে জেনে নিয়ে তারপর ভ্রমণ পরিকল্পনা করবেন। এছাড়া আপনাদের সুবিধার জন্যে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে হোটেল, রিসোর্ট, যানবাহন ও নানা রকম যোগাযোগ ব্যবস্থার মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টা করুন।