১৯৭১সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি সামরিক অভিযান চালায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই রাত এক ভয়াবহ স্মৃতি আকড়ে ধরে রেখেছে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা অপারেশন সার্চলাইট কিভাবে শুরু হয়েছিল তা আলোচনা করবো।
অপারেশন সার্চলাইট বলতে কী বোঝ?, What does Operation Searchlight mean?
অপারেশন সার্চলাইট (ইংরেজি: Operation Searchlight) ১৯৭১সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত গণহত্যা, যার মাধ্যমে তারা ১৯৭১ এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল।
অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয় কিভাবে, How did Operation Searchlight begin?
বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট।
অপারেশন সার্চলাইট কেন সংঘটিত হয়, What was the reason behind the occurrence of Operation Searchlight ?
বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিহিত করা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের নিরীহ কিন্তু বিদ্রোহী আর প্রতিবাদী বাঙালীদের নিশ্চিহ্ন করে ভূমির দখল নিতে পাকিস্তান সরকার, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। ইতিহাসের পাতায় এই গণহত্যা অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। সামরিক অভিযান চালিয়ে ‘পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা করা ছিল এই গণহত্যার মূল উদ্দেশ্য।
‘অপারেশন সার্চলাইটের’ পরিকল্পনা কিভাবে করা হয়েছিল, How was Operation searchlight planned?
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। এর অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি সামরিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ই মার্চ সকাল থেকে ক্যান্টনমেন্টে খাদিম হুসাইন রাজার বাড়িতে ছিলেন রাও ফরমান আলী, দুইজন মিলে অপারেশন সার্চলাইটের খসড়া তৈরি করেন। ঢাকা অঞ্চলে সামরিক অপারেশনের দায়িত্ব নেন রাও ফরমান আলী, আর বাকি পুরো প্রদেশে অভিযানের দায়িত্ব নেন খাদিম হুসাইন রাজা।
রাও ফরমান আলী পরিকল্পনায় তার অংশে কিভাবে ঢাকায় অপারেশন চালানো হবে তা বিস্তারিত লেখেন।
ঢাকার বাইরে বাহিনী কী দায়িত্ব, কিভাবে পালন করবে তার বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন জেনারেল রাজা।
সামরিক অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিবের ডিফ্যাক্টো শাসনকে উৎখাত করা এবং সরকারের (পাকিস্তানের) কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পনা ছিল ১৬টি প্যারা সম্বলিত এবং পাঁচ পৃষ্ঠা দীর্ঘ।
খাদিম হুসাইন রাজা নিজের বইয়ে এই ঘটনা সম্পর্কে লিখেছিলেন যে, ২৪শে মার্চ দুইটি হেলিকপ্টার নিয়ে রাও ফরমান আলী এবং তিনি নিজেই ঢাকার বাইরে অবস্থানরত ব্রিগেড কমান্ডারদের নির্দেশনা দিতে রওয়ানা হন।
সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তাদের জানানো হয়েছিল যে, আঘাত হানার সময় পরে জানানো হবে।
ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন রাও ফরমান আলি এবং অন্যান্য সব স্থানের সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন জেনারেল খাদেম। জেনারেল টিক্কা এবং তার কর্মকর্তারা ৩১তম কমান্ড সেন্টারের সব কিছু তদারকি করা এবং ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত ছিলেন।
অপারেশন শুরু হয় ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে এবং ২৬ শে মে মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ দীর্ঘ ২ মাস চলেছিল।
অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনার মূল দিকগুলো, Key aspects of the Operation Searchlight plan :
খাদিম হুসাইন রাজা তাঁর ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ঔন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১’ বইয়ে অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। সেখানে তিনি পরিকল্পনার মূল দিকগুলো কি ছিল তাও উল্লেখ করেন, তাঁর ব্যাখ্যায়—
- যে কোন ধরণের বিদ্রোহ বা বিরোধিতাকে কঠোরভাবে দমন করা।
- সফল হওয়ার জন্য আকস্মিক চমক এবং চাতুরীর গুরুত্ব রেখে সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকেও তাদের সাহায্য করার জন্য পরামর্শ দেওয়া।
- বাঙ্গালি সেনা সদস্য ও পুলিশকে নিরস্ত্র করা। বিশেষ করে পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অস্ত্রাগার, রাজারবাগের রিজার্ভ পুলিশ এবং চট্টগ্রামে কুড়ি হাজার রাইফেলের অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া।
- অপারেশন শুরু হওয়ার সাথে সাথে সব রকমের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে নতুন করে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হবে।
- অস্ত্রশস্ত্র এবং অপরাধীদের খোঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ঘিরে তল্লাশি চালাতে হবে।
- শেখ মুজিবকে জীবিত অবস্থায় ধরার পরিকল্পনা। এছাড়াও ১৫ জন আওয়ামী লীগ এবং কম্যুনিস্ট পার্টির নেতার বাড়িতে তল্লাশি চালানো, তাদের কাউকে পেলে গ্রেপ্তার করতে হবে।
অপারেশন পরিচালনার জন্য চিহ্নিত স্থান, Place identified for conducting operations :
পরিকল্পনায় পূর্ব নির্ধারিত আক্রমণাত্মক অপারেশন পরিচালনার জন্য চিহ্নিত স্থানগুলো ছিল- ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেট। এসব স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সমাবেশ বেশি ছিল। পূর্বপাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত সৈন্যদল এবং প্যরা মিলিটারি বাহিনীরা তাদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে রয়ে যাবে এবং প্রয়োজন হলে অন্যান্য স্থানে প্রাথমিক অপারেশনের সময় শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যোগ দেবে। যেসব শহরে বিমানঘাঁটি আছে(চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রংপুর, কুমিল্লা) সেসব শহরে সরাসরি ঢাকা থেকে সি-১৩০ (C-130) বিমান অথবা হেলিকপ্টার ট্রুপস এর মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করা হবে।
অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর লক্ষ্য, Objectives of Pakistani forces in the operation :
মেজর জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নিম্নলিখিত লক্ষ্যগুলো ছিল :
- রাত ১১টায় কারফিউ জারি করা এবং টেলিফোন/টেলিগ্রাফ/রেডিও স্টেশন এবং সকল প্রকার পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করা।
- ঢাকা শহরের সড়ক, রেল ও নৌ-পথের দখল নিয়ে সারা শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং নদীতে টহল জারি করা।
- অপারেশন চলাকালীণ সময়ের মধ্যে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের আরও ১৫ জন বড় নেতাদের গ্রেফতার করা।
- ধানমন্ডি এলাকায় এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করা।
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দফতর, এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন ধ্বংস ও পরাভূত করা এবং ২য় ও ১০ম ইবিআর কে নীরস্ত্র করে দেওয়া।
- গাজিপুর অস্ত্র কারখানা এবং রাজেন্দ্রপুরের অস্ত্রগুদাম দখল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ঢাকা আক্রমণের জন্য মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি কর্তৃক প্রণীত পাকিস্তানি পরিকল্পনা কিরূপ ছিল, জেনে নিন :
- ১৩তম সীমান্তবর্তি সৈন্যদল সেনানিবাসে সংরক্ষিত শক্তি হিসাবে থাকবে এবং নিরাপত্তা প্রদান করবে।
- ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী বাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে।
- ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর বাহিনীকে নীরস্ত্র করবে এবং ইপিআর সদর দফতরের ওয়্যারলেস ব্যবস্থা দখলে নেবে।
- ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে নিস্ক্রিয় করবে।
- ১৮তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দায়িত্ব ছিল পুরান ঢাকা এবং নবাবপুরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
- ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট মোহাম্মদপুর এবং মিরপুরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।
- 3 SSG এর একটি প্লাটুন মুজিবকে ধরার দায়িত্বে ছিল।
- ২২তম বালুচ এবং ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্রোহীদের নিস্ক্রিয় করার দায়িত্বে ছিল।
- ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট এরপর পিলখানার শক্তি বৃদ্ধি করবে।
পাকিস্তানি বাহিনীকে চট্টগ্রামে যেসব লক্ষ্যসমূহ ঠিক করে দেয়া হয়, সেগুলি হল :
- ই বি আর সি ইউনিট, ৮ম ই বি আর, ই পি আর এবং পুলিশ বাহিনীকে নীরস্ত্র করা।
- পুলিশের অস্ত্রসস্ত্র, রেডিও স্টেশন এবং টেলিফোন এক্সচেইঞ্জ দখল করে নেয়া।
- পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা।
- লে কর্নেল এম আর চৌধুরী এবং আওয়ামি লীগ নেতৃবৃন্দদের গ্রেফতার করা।
- ২৬ মার্চে কুমিল্লা থেকে আগত ৫৩তম ব্রিগেড ট্রুপসের দ্বারা চট্টগ্রাম গ্যারিসনের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়।
শেষ কথা, Conclusion :
ঢাকায় এক রাতের যে অভিযানে অর্ধ লক্ষ মানুষের প্রাণহানী হয়েছিল, সেই রাতটিকে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্ণনা করা হয় ‘কালরাত্রি’ হিসেবে। ১৯৭১ সালের এই গণহত্যার পরে প্রাপ্ত মানুষের হাড় ও খুলি এবং যুদ্ধ সরঞ্জাম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।