আলু চাষ পদ্ধতি, Methods of potato cultivation in Bengali 

আলু চাষ পদ্ধতি

আলু আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথা অন্যতম জনপ্রিয় ফসল। ধান ও গমের পরই আলুর স্থান। ফলনের হিসেবে ধানের পরই আলুর স্থান। তাছাড়া দিনের পর দিন আলু চাষে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে আলু চাষে আধুনিক পদ্ধতিও ব্যবহার করা হচ্ছে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা আলু উৎপাদনের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করবো।

উৎপাদনের জন্য মাটি নির্বাচন, Selection of soil for production

আলু চাষ যে কোনো মাটিতে করা যায়। তবে বেলে দোআঁশ থেকে দোআঁশ মাটি আলু চাষের জন্য উত্তম। চাষের জন্য যেখানে সেচ ও নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে সে সকল জমি নির্বাচন করতে হবে। তবে জমিটি অবশ্যই রৌদ্র উজ্জ্বল হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাটি ঝুরঝুরে করে প্রস্তুত করতে হবে। আড়াআড়িভাবে সেই জমিতে কমপক্ষে ৪টি চাষ দিতে হবে।

লক্ষ্য রাখতে হবে চাষের জমিতে যেন বড় মাটির ঢেলা না থাকে, কারণ বড় মাটির ঢেলা আলুর সঠিক বৃদ্ধিতে বাঁধা দেয়। বাধাগ্রস্ত হলে আলু অনেক সময় অসম ও বিকৃত আকারে বৃদ্ধি পায়। জমি তৈরির সময় জমিতে সুষম সেচ প্রয়োগ করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাই জমির উপরিভাগ সমতল করতে হবে।

আলু চাষ যে কোনো মাটিতে করা যায়।

আলুর জাত পরিচিতি, Know about potato varieties

আলুর বিভিন্ন জাত রয়েছে, যার মধ্যে আছে খাবার আলু, প্রক্রিয়াজাতকরণের উপযোগী আলু, রপ্তানিযোগ্য আলু, আগাম আলু ও সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় এমন আলুরও জাত আছে। 

আলুর জাত পরিচিতি

চাষের জন্য বীজআলু শোধন, Treatment of seed potatoes for cultivation

বীজআলু কোল্ড স্টোরেজ থেকে বের করার পর ৪৮ ঘণ্টা প্রি হিটিং কক্ষে রাখা হয়, বীজআলু এনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বস্তা খুলে ছড়িয়ে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য স্বাভাবিক বাতাস চলাচল করে এমন ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। এমনটা করার কারণ বীজ কোল্ড স্টোরেজ থেকে বের করে বস্তা বন্ধ অবস্থায় রাখলে ঘেমে পচে যেতে পারে।

বীজ কোল্ড স্টোরেজে রাখার পূর্বে যদি শোধন না করা হয়ে থাকে তবে অঙ্কুর গজানোর আগে বীজআলুর রোগ প্রতিরোধের জন্য ৩% বরিক এসিড দিয়ে শোধন করে নিতে হয়। এ জন্য ১ লিটার জলের সাথে ৩০ গ্রাম হারে বরিক এসিড মিশিয়ে বীজআলু ১০-১৫ মিনিট ভিজিয়ে রেখে পরে সেগুলো তুলে ছড়িয়ে নিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হবে। এই কাজটি পলিথিন সিটের উপর আলু ছড়িয়ে রেখে তাতে মিশ্রণটি স্প্রে করেও শোধন করা যায়। তবে আলুর সব অংশ যেন ভিজে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সাধারণত বিঘা প্রতি ২১০ কেজি বীজআলু প্রয়োজন হয়।

চাষের জন্য বীজআলু শোধন

বীজ আলু রোপণ পদ্ধতি, Method of Planting Seed Potatoes

বীজ আলু থেকে অঙ্কুর গজানোর পর ১ম কুঁড়িটি ভেঙে দিতে হয়, ১ম কুঁড়ি ভেঙে দিলে অন্যান্য কুঁড়ি সমানভাবে বৃদ্ধির সুযোগ পায়। ৩০-৪০ গ্রাম ওজনের আস্ত আলু বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, এছাড়া কেটেও বীজ লাগানো যেতে পারে।

লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রতিটি কাটা অংশে কমপক্ষে ২টি কুঁড়ি থাকে। বীজ লাগানোর ২-৩ দিন আগে যদি আলু কেটে ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দেওয়া হয় তবে আলুর সেই কাটা অংশের ওপর একটা প্রলেপ পড়ে। এতে মাটি বাহিত রোগ জীবাণু সহজে বীজে প্রবেশ করতে পারে না। ছাই মেখেও এই কাজটি সম্পন্ন করা যেতে পারে। এতে আলুর পচন অনেকাংশে রোধ হয়। বীজআলু আড়াআড়িভাবে না কেটে লম্বালম্বিভাবে কাটা উত্তম। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে অগ্রহায়ণ মাস অর্থাৎ নভেম্বর মাস আলু রোপণের উপযুক্ত সময়।

বীজ আলু রোপণ পদ্ধতি

আলু চাষে সার ব্যবস্থাপনা, Fertilizer management in potato cultivation

দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটির উর্বরতা ভিন্ন হয় বলে সকল জমির জন্য সারের চাহিদা সমান নয়। স্থান ভেদে বিঘা প্রতি

  •  ইউরিয়া ৪৪-৪৮ কেজি, 
  • টিএসপি ২৭-৩০ কেজি, 
  • এমওপি ৩৩-৪০ কেজি, 
  • জিপসাম ১৩-১৬ কেজি, 
  • জিংক সালফেট ১ কেজি-১ কেজি ৩০০ গ্রাম, 
  • ম্যাগনেসিয়াম সালফেট (যে মাটিতে ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি আছে) ১৮-২০ কেজি, 
  • বোরন ৮০০ গ্রাম-১ কেজি, 
  • গোবর ১২০০-১৩০০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।

বীজের আন্তঃপরিচর্যা, Seed intercropping

বীজ রোপণের পর যদি জমিতে ভালো রস না থাকে বলে মনে হয় তখন সেচ দেয়া উত্তম, তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ক্ষেতে কোনোভাবেই জল না আটকে থাকে। ২-৩টি সেচ প্রয়োগ করা প্রয়োজন হতে পারে। ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে গুটি বের হওয়ার পর আলু বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

চাষের জমি থেকে আলুর ফসল উঠানোর ৭-১০ দিন আগে থেকে মাটিতে সেচ প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। ফসলের রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আলু রোপণের পর ৩০-৫০ দিনের সময়ে জমিতে রসের ঘাটতি এবং ৬০-৬৫ দিনের পর রসের আধিক্য হতে দেবেন না।

বীজের আন্তঃপরিচর্যা

আলুর জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে, আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিনের মধ্যে আগাছা পরিষ্কার করে নিয়ে দুই সারির মধ্যবর্তী স্থানের মাটি কুপিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। সেই সার মিশ্রিত মাটি গাছের গোড়ায় দিয়ে দিতে হবে। খেয়াল রাখবেন, কোপানোর সময় যেন আলুর শিকড় না কাটে এবং গাছের পাতা যেন মাটি চাপা না পড়ে। 

বীজের আন্তঃপরিচর্যা,

জমিতে আলু জন্মাতে কতদিন সময় লাগে? How long does it take to grow potatoes in the ground?

প্রারম্ভিক-ঋতু আলুর জাতগুলি বসন্তে প্রথমে রোপণ করা হয় এবং 60-80 দিনের মধ্যে ফসল কাটার জন্য প্রস্তুত হয়। মধ্য-ঋতুর জাত 80-100 দিনে পরিপক্ক হয়। দেরী ঋতু আলুর জাতগুলি 100-130 দিনের মধ্যে ফসল কাটার জন্য প্রস্তুত।

বীজআলুর জমিতে বিজাত বাছাই, Seed selection in seed potato field

মানসম্পন্ন বীজআলু উৎপাদন করতে হলে রগিং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বীজআলুর গুণাগুণ ঠিক রাখতে সঠিকভাবে রগিং করতে হয়, না হলে বীজআলুর গুণাগুণ কমে যায়।

সকাল এবং বিকাল রগিংয়ের জন্য উপযুক্ত সময়। সূর্যের বিপরীত দিকে মুখ করে রগিং করতে হবে যেন পাতায় সব লক্ষণ স্পষ্ট বোঝা যায়। এ জন্য গাছের বয়স ৩০-৩৫ দিন হলে তখন থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ করার আগে পর্যন্ত নিয়মিত আলুর জমিতে বিভিন্ন জাতের মিশ্রিত গাছ তথা অস্বাভাবিক এবং রোগাক্রান্ত গাছগুলোকে তুলে ফেলতে হবে। এতে রোগ সংক্রমণ রোধ করা যায়। লক্ষ্য রাখবেন যেন রোগাক্রান্ত গাছ কোনোভাবেই সুস্থ গাছের সঙ্গে না লাগে 

বীজআলুর জমিতে বিজাত বাছাই,

হামপুলিং, Hampuling

 হামপুলিং, অর্থাৎ গাছ টেনে উপড়ে ফেলা। হামপুলিং করার ৭-১০ দিন আগে সেচ বন্ধ করে দিতে হবে। তবে যদি বালি মাটি হয় তবে ৫ থেকে ৭ দিন আগে সেচ বন্ধ করতে পারেন। এক্ষেত্রে সেচ বেশি দিন আগে বন্ধ করলে বালি মাটির আলুতে হিট ইনজুরি হতে পারে হামপুলিং করার সময় যদি মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকে তবে গাছ ক্ষেত থেকে সরিয়ে ফেলা ভালো।

হামপুলিংয়ের তারিখ ফসল তোলার পরে আলুর আকার ও ফলন দেখে নির্ধারণ করতে হবে। হামপুলিংয়ের পর আলুর ত্বক শক্ত হয়েছে কি না তা দেখার জন্য আলু তুলে বৃদ্ধাঙুলি দ্বারা আলুর ত্বকে চাপ দিয়ে দেখবেন, যদি চামড়া না উঠে তবে বুঝতে হবে যে কিউরিং হয়েছে। 

ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, Post harvest management

আলুর ফসল উত্তোলন শুষ্ক, উজ্জ্বল ও ভালো আবহাওয়াতে করতে হবে। এক এক সারি করে কোদাল বা লাঙ্গল দিয়ে আলু উঠাতে হবে। আলু যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখবেন। আলু উঠানোর পর কাটা, ফাটা, ক্ষতিগ্রস্ত, আংশিক পঁচা আলু পৃথক করতে হবে। ভালো আলু বস্তায় অথবা চট দ্বারা আবৃত ঝুড়িতে করে সতর্কতার সঙ্গে আলু অস্থায়ী শেডে আনতে হবে।

ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা

আলু উৎপাদন ক্ষেতের কাছাকাছি ছায়াযুক্ত ঠান্ডা ও সহজে বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে করতে হবে। প্রাথমিক বাছাইকৃত আলু শেডের মেঝেতে বিছিয়ে রাখুন, লক্ষ্য রাখবেন যেন আলুর স্তূপ ৪৫ সেন্টিমিটারের বেশি উঁচু না হয়। সংরক্ষণ করতে হলে আলু ভালোভাবে বাছাই করা জরুরি। বাছাই ভালো হলে সংরক্ষণ এবং রপ্তানিযোগ্য আলুর মানও ভালো হবে। 

শেষ কথা, Conclusion 

আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা আলু চাষের পদ্ধতি আলোচনা করলাম। আশা করি উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো আমাদের চাষের কাজে সহায়তা করবে।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts