সাতক্ষীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি জেলা। জেলাটি তার নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। এই জেলার ব্যাপারে উল্লেখ করার মত বিভিন্ন বিষয় আছে, যা আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা তুলে ধরবো।
সাতক্ষীরা জেলার নামকরণের ইতিহাস, History of Satkhira District :
বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার নামকরণ নিয়ে বেশ কয়েকটি মতবাদ আছে, এর মধ্যে একটি মতবাদ অনুসারে, এই অঞ্চলে একসময় সাতটি দীঘি ছিল বলে এই অঞ্চলের নাম হয়েছে সাতক্ষীরা।
অন্য এক মতবাদ অনুসারে, এই অঞ্চলে সাতটি ছোটো গ্রামের সমন্বয়ে একটি বড় গ্রাম গড়ে উঠেছিল বলে এর নাম সাতক্ষীরা।
সাতক্ষীরা জেলার আদি নাম সাতঘরিয়া। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মচারী হিসেবে ১৭৭২ সালে নিলামে পরগনা কিনে গ্রাম স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র প্রাণনাথ চক্রবর্তী সাতঘর কুলীন ব্রাহ্মণ এনে এই পরগণায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং নাম হয় সাতঘরিয়া।
জেলার আয়তন ও অবস্থান, Area and location :
সাতক্ষীরা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। জেলাটি ২২°৩৩′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°১০′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত, যার উত্তরে রয়েছে খুলনা জেলা, দক্ষিণে আছে সাগর, পূর্বে রয়েছে বাগেরহাট জেলা এবং পশ্চিমে আছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য।
সাতক্ষীরা জেলার আয়তন হল ৩,৮৫৮.৩৩ বর্গকিলোমিটার।
জেলার জনসংখ্যা, Population of District :
সাতক্ষীরা জেলার জনসংখ্যা প্রায় ২.৮ মিলিয়ন। এই জেলার প্রধান শহর এবং সদর দপ্তর সাতক্ষীরা শহরে অবস্থিত।
জেলার প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, Economic field:
সাতক্ষীরা জেলার প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হল কৃষি। জেলার প্রধান ফসল হল ধান, পাট, গম, আখ, আলু, সরিষা, রসুন, পেঁয়াজ, বিভিন্ন ধরনের ডাল, শাকসবজি ইত্যাদি। এছাড়াও এখানে মৎস্য চাষ এবং চামড়া শিল্পও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
সাতক্ষীরার দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ মৎস্যচাষের উপর নির্ভরশীল। কুটির শিল্পের মধ্যে এখানে রয়েছে হস্তচালিত তাঁত, নৌকা তৈরি, খেলনা, কাঠের আসবাবপত্র, বেত ও বাঁশজাত দ্রব্যাদি ও আসবাবপত্র তৈরির ব্যবস্থা।
সাতক্ষীরা জেলায় কয়টি গ্রাম আছে, How many villages are there in Satkhira district?
জেলাটি দুটি পৌরসভা, সাতটি উপজেলা, 79টি ইউনিয়ন পরিষদ, 8টি থানা (পুলিশ স্টেশন) এবং 1,436টি গ্রাম নিয়ে গঠিত।
জেলার শিক্ষাব্যবস্থা, Education system :
সাতক্ষীরার শিক্ষা কার্যক্রম যশোর শিক্ষাবোর্ডের নিয়ন্ত্রণে চলছে। সাতক্ষীরায় রয়েছে ১টি মেডিকেল কলেজ, ২টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৪৪ টি কলেজ, ১৩৫টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৩টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৯০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৮৫টি মাদ্রাসা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়
- উচ্ছেপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালিগঞ্জ উপজেলা
- ৭২ নং তালতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তালতলা, বিনেরপোতা, সাতক্ষীরা
- ৬৪ নং পুঁইজালা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বিদ্যালয়
- সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
- সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
- কলারোয়া সরকারি জি.কে. এম. কে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়
- কাকবাসিয়া বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়
- সখিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
- রতনপুর তারকার মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়-১৯৪০ (রতনপুর টি.এন বিদ্যাপীঠ-১৯৪০)
- তালতলা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তালতলা, বিনেরপোতা, সাতক্ষীরা।
- সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস উচ্চ বিদ্যালয
- পুঁইজালা বি.এম.আর.বি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
- বলাবাড়িয়া আমজাদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়
কলেজ
- কলারোয়া সরকারি কলেজ
- সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ
- সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজ
- কালিগঞ্জ সরকারী কলেজ
- ডিআরএ ইউনাইটেড আইডিয়াল কলেজ, কালিগঞ্জ উপজেলা
- শ্যামনগর সরকারি মহসিন কলেজ
- আশাশুনি সরকারি কলেজ
- খান বাহাদুর আহসানউল্লা সরকারি কলেজ
- তালা সরকারি কলেজ
- শেখ আমানুল্লাহ ডিগ্রী কলেজ
- এপিএস ডিগ্রী কলেজ
- জাতপুর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, তালা, সাতক্ষীরা
সাতক্ষীরা জেলার শিক্ষার হার কত, Literacy rate?
সাতক্ষীরা শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৪৯৯ জন মানুষ বসবাস করে। নারী পুরুষের লিঙ্গ অনুপাত ১০০ঃ১০৩ এবং শহরে শিক্ষার হার ৬৯.৩%(৭ বছরের উর্দ্ধে)। সম্পূর্ণ জেলার সাক্ষরতার হার মোট ৫৩.৩২%।
সাতক্ষীরা কিসের জন্য বিখ্যাত, Reasons Satkhira District is famous for ?
সাতক্ষীরা কিসের জন্য বিখ্যাত তার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে জেলাটি বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সেক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য যে, সাতক্ষীরা জেলা বিখ্যাত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে সুন্দরবন। সুন্দরবনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী, যা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
সুন্দরবন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য কেন্দ্র। সুন্দরবনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী, যেমন বাঘ, হরিণ, বানর, কুমির, ইত্যাদি। সুন্দরবনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, যেমন সুন্দরী, গেওয়া, গরান, ইত্যাদি। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সাতক্ষীরা জেলার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। পাশাপাশি এখানে বেশ কিছু বিখ্যাত স্থান রয়েছে যা ভ্রমণের যোগ্য এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবছর বহু পর্যটক আসেন স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য। অন্যদিকে উক্ত জেলাটি মাছের জন্যও বিখ্যাত।
সাতক্ষীরা জেলার বিখ্যাত স্থান, places to visit in Satkhira District :
সাতক্ষীরা জেলা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। সাতক্ষীরা জেলার বিখ্যাত স্থানগুলির মধ্যে আছে সাতক্ষীরা শহর, বাঘের গাড়ি, কুমড়ি নদী, আমুদিয়া মসজিদ, বাঁশখালী মসজিদ।
সাতক্ষীরা জেলার মানুষেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং আতিথেয়তার জন্যও বিখ্যাত।
সাতক্ষীরা জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান সমূহ :
সাতক্ষীরা জেলায় বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- সাতক্ষীরা শহর : সাতক্ষীরা শহর সুন্দর স্থাপত্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য সারা দেশে বিখ্যাত। এই শহরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। এছাড়াও এখানে আছে বহু প্রাচীন মসজিদ, মন্দির এবং মঠ।
- বাঘের গাড়ি : বাঘের গাড়ি এই জেলার প্রাচীন স্থাপত্য। এটি সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
- কুমড়ি নদী : জেলার কুমড়ি নদী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত নদী। এটি সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কুমড়ি নদীর তীরে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপত্য।
- আমুদিয়া মসজিদ : এটি একটি প্রাচীন মসজিদ, যা সাতক্ষীরা শহরের আমুদিয়া গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটি ১৫শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল।
- বাঁশখালী মসজিদ : এটি একটি প্রাচীন মসজিদ, যা বাঁশখালী গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটি ১৬শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছি।
- নলতা শরীফ : এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য, যা কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা গ্রামে অবস্থিত। নলতা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ শাহ। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ইসলামী তীর্থস্থান।
- মহারাজপুর মন্দির : এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য, যা কালীগঞ্জ উপজেলার মহারাজপুর গ্রামে অবস্থিত। মহারাজপুর মন্দিরটি ১৮শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল, যেখানে দেবী কালীর একটি বিশাল মূর্তি রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলার বিখ্যাত কিছু খাবার, Famous Foods of Satkhira District :
সাতক্ষীরা জেলায় সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়, যা দেশব্যাপী সুপরিচিত। বাংলাদেশের মধ্যে সাতক্ষীরা চিংড়ি আর সন্দেশের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও রয়েছে বিশেষ কিছু খাবার, যা দেশব্যাপী প্রসিদ্ধ। সেগুলি হল :
- কাঁকড়া ভুনা : জেলার অন্যতম বিখ্যাত খাবার হল কাঁকড়া ভুনা। সুন্দরবনের কাঁকড়া দিয়ে তৈরি করা হয় এই বিশেষ খাবার। এই উক্ত জেলার একটি জনপ্রিয় খাবার।
- বাঁশখালীর ইলিশ : সাতক্ষীরার বাঁশখালী উপজেলার ইলিশ সারা দেশব্যাপী খ্যাত। বাঁশখালীর ইলিশের স্বাদও অতুলনীয়।
- কুমড়ি নদীর মাছ : জেলার কুমড়ি নদীর মাছও সারাদেশে বিখ্যাত।
- সাতক্ষীরা পায়েস : সাতক্ষীরা জেলার একটি বিখ্যাত মিষ্টি জাতীয় খাবার হল এই পায়েস। সাতক্ষীরা পায়েস সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যবাহী স্বাদের জন্য দেশব্যাপী খ্যাত।
- সাতক্ষীরা লাড্ডু : সাতক্ষীরা লাড্ডু এই জেলার একটি বিখ্যাত মিষ্টি।
সাতক্ষীরা কোন নদীর তীরে অবস্থিত, Satkhira is located on the banks of which river ?
সাতক্ষীরার আশে পাশে অনেক নদনদী রয়েছে। তবে এই জেলার অন্যতম নদীর কথা বলতে গেলে এক কথায় বলা যায় যে, সাতক্ষীরা পাঙ্গাশিয়া নদীর তীরে অবস্থিত।
উপসংহার, conclusion :
বাংলাদেশের জনপ্রিয় জেলা সাতক্ষীরা। এই জেলার বিখ্যাত খাবার, দর্শনীয় স্থান, বিখ্যাত ব্যক্তি জেলাটিকে অন্যান্য জেলার তুলনায় করে তুলেছে অনন্য। আশা করি এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা উক্ত জেলা সম্পর্কে প্রায় সকল তথ্যই জেনে নিতে পেরেছেন।