শবে বরাত পালনের তাৎপর্য ও করণীয়, Details about Shab-e-Barat in Bengali

শবে বরাত পালনের তাৎপর্য ও করণীয়

কেন পালন করা হয় শবে বরাত? কবে থেকে পালন করা শুরু হয় পবিত্র এই দিনটি? শবে বরাতের গুরুত্ব ও ইতিহাস অনেকেই জানেন না। হিজরি বর্ষের শাবান মাসের ১৪ তারিখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সৌভাগ্যের রাত হিসাবে শবে বরাত পালন করেন। তাদের বিশ্বাস এই রাতে মহান আল্লাহ ধর্মপ্রাণদের জন্য কৃপার দরজা খুলে দেন। তাই এই রাতটি পবিত্র শবে বরাত হিসাবে পরিচিত। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা শবে বরাত সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আলোচনা করবো।

শবে বরাত শব্দের আক্ষরিক অর্থ,  Meaning of Shab-e-Barat 

ফারসি ভাষায় ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, আর ‘বরাত’ শব্দের অর্থ সৌভাগ্য। আরবিতে একে বলে ‘লাইলাতুল বরাত’, অর্থাৎ সৌভাগ্যের রাত। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, আল্লাহ এই রাতে তাঁর বান্দাদের গুনহা বা অপরাধ মাফ করে দেন, মুক্তি দেন জাহান্নাম থেকে। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এই পবিত্র রাতে পরম করুণাময় আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় নফল নামাজ পড়েন, কোরান তিলাওয়াত করেন এবং সকলেই জিকিরে মগ্ন হয়ে থাকেন। মুসলমানদের বিশ্বাস অতীতের সব পাপ তথা অন্যায় কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার সময়ও এই রাত। পাশাপাশি এই রাতে ভবিষ্যৎ জীবনের কল্যাণ কামনা করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।

শবে বরাত শব্দের আক্ষরিক অর্থ

শবে বরাত পালনের ইতিহাস, History of Shab-e-Barat 

হিজরি ৪৪৮ সনে শবে বরাত পালনের প্রচলন হয়। শবে বরাত উৎসবের ইতিহাস জানতে গেলে শিয়া মুসলমানদের দ্বাদশ ইমাম মোহাম্মদ আল-মাহদীর জন্মের সময়ে ফিরে তাকাতে হবে। শবে বরাতের রাতটি মোহাম্মদ আল-মাহদীর জন্মদিন হিসাবে পালিত হয়। অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করে যে, এই রাতে আল্লাহ তার প্রিয়জনদের সাথে হিসাব মেটাতে আসেন। বিশুদ্ধ ছয়টি হাদিসগ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদীসে বলা হয়েছে, “রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন। ” 

কোথায় কোথায় শবে বরাত পালন করা হয়, Where is Shab-e-Barat celebrated?

মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে শবে বরাত পালন করে, গোটা দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া জুড়ে এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়। ভারত, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, উজবেবিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান, তাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান জুড়ে জমজমাটভাবে চলে শবে বরাতের উৎসব।

কোথায় কোথায় শবে বরাত পালন করা হয়

সুফি ঐতিহ্যের আরব ও শিয়া মুসলিমরা এই উৎসব পালন করে থাকেন। তাছাড়া স্থানভেদে এই উৎসবটি ভিন্ন নামে পরিচিত। ইরান ও আফগানিস্তানে এটি নিম শাবান হিসেবে পরিচিত, তুরস্কে এই দিনটি বিরাত কান্দিলি হিসেবে পরিচিত, আর ভারতীয় উপমহাদেশে শবে বরাত বা নিফসু শাবান বলে খ্যাত।

শবে বরাত এর দিনের বিশেষ কার্যকলাপ, Special activities of the day of Shab- e- Barat

অনেকেই শবে বরাত এর দিন রোজা রাখেন এবং গোপনে দান-খয়রাতের কাজ করে থাকেন। অন্যদিকে, এই রাতে মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য সবাই মিলে প্রার্থনা করার আয়োজন করা হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলীমরা এই পবিত্র রাতে নিজের আত্মীয়-প্রতিবেশী এবং দুঃস্থদের মধ্যে হালুয়া, ফিরনি ইত্যাদি সহ নানারকমের খাবার বিতরণ করে থাকে। এই রাতে মসজিদ, কবরস্থান এবং মাজারে গিয়ে মুসলীমরা প্রার্থনা করেন।

শবে বরাত এর দিনের বিশেষ কার্যকলাপ

শবে বরাতের বিশেষ খাওয়াদাওয়া, Shab-e-Barat special menu

পবিত্র শবে বরাতকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা নিজের বাড়িতে নানা রকমের হালুয়া, ফিরনি, রুটি-সহ বেশ কিছু সুস্বাদু খাবার তৈরি করে থাকেন। এইদিন এইভাবে খাওয়াদাওয়া করার প্রচলন বহু বছর ধরে চলে আসছে। খাবারগুলো আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধব মিলে একসাথে উপভোগ করেন। সন্ধ্যার পর আপনজনদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে অনেকে কবরস্থানে যান দোয়া করার জন্য। 

পবিত্র শবে বরাত এর পর রমজানের শুরু, Shab-e-Barat marks the beginning of Holi Ramzan.

মুসলিমদের কাছে পবিত্র শবে বরাত রমজানের আগমনী বার্তা বয়ে আনে, কারণ আরবি ক্যালেন্ডার অনুসারে রমজান মাস আসে শাবান মাসের পরেই। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে শবে বরাতের রাত থেকে আসন্ন রমজানের প্রস্তুতিও শুরু করে দেন পুরোদমে।

পবিত্র শবে বরাত এর পর রমজানের শুরু

কোরআনে পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণনা, Description of Shab-e-Barat in Quran

কোরআনে কারিমে পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে সরাসরি কোনো নির্দেশনা না থাকলেও হাদিস শরিফে সুস্পষ্টভাবে এই বিশেষ পরবের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এসব বর্ণনার মধ্যে কিছু বিশেষ বর্ণনা সম্পর্কে পৃথিবীর সব মুহাদ্দিস সহিহ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। একথা সত্য যে কোনো বিষয়কে প্রমাণ করার জন্য একটি সহিহ হাদিসই যথেষ্ট।

মুহাদ্দিস, ইসলামি স্কলার ও আলেমদের অধিকাংশ এ বিষয়ে একমত যে, ফজিলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিসের ওপর আমল করা জায়েজ এবং ‘জয়িফ’ (দুর্বল) সনদের হাদিস দ্বারাও কোনো আমল মোস্তাহাব হওয়া প্রমাণিত হয়। তাছাড়া হাদিসে শবে বরাত পালন বা ফজিলতের বিপক্ষে কোনো বর্ণনার প্রমাণ নেই। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে: ‘‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রিটি একটি বরকতময় রাত এবং এ রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন। এছাড়াও কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’’ এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘মধ্য শাবানের রাতকে’ বোঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ বলেন, এ রাতে গোটা বছরের সকল বিষয়ে ফয়সালা করা হয়।

কোরআনে পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণনা

শবে বরাতের নামাজ সম্পর্কিত সতর্কতা, Warnings regarding Shab-e- Barat prayers

মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী ফরজ নফলের চেয়ে অনেক বড় শবে বরাতের নামাজ। নফল পড়তে পড়তে ফরজ পড়া ভুলে গেলে বা কেউ ঘুমিয়ে পড়ার কারণে পড়তে না পারলে কিন্তু সবই শেষ, অর্থাৎ নফল নামাজ পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন আর এই দিকে ফজরের নামাজ পড়তে পারলেন না, সময় পেরিয়ে গেল, সেক্ষেত্রে সাবধান এমনটা যেন না হয়। সবচেয়ে ভাল হয় শবে বরাতের নফল শেষ করে বেতের নামাজ পড়ার পর ফজর পড়া। নামাজ পড়েন আর ঘুমিয়ে যান যাই করেন সমস্যা নেই, ঠিক সময় মত ঘুম থেকে উঠে ফজর নামাজ যেন পড়তে পারেন সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

শেষ কথা, Conclusion 

সারা বিশ্বের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ঘরে ঘরে পালন করেন এই পরব। ইসলামী ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাস অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ ও ১৫ তম রাতে এই উৎসব পালন করার রীতি বহু বছর ধরে চলে এসেছে। শবে বরাতকে ইসলামী বর্ষপঞ্জির পবিত্রতম রাত বলে মনে করা হয়, যা লাইলাতুল-বরাত বা লাইলাতুল-বারা বা মধ্য শাবান নামেও পরিচিত। এই রাত সকল মুসলমানদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা এই রাতেকে আল্লাহর নিকট প্রার্থনার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ রাত বলে মনে করেন। তাই তো নামাজ পড়ার সাথে আল্লাহের কাছে অতীতের সব ভুল মাফ করে দেওয়ার প্রার্থনা করা হয়।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts