শহীদ মিনার এর ইতিবৃত্ত, Historical details of Shahid Minar in Bengali 

শহীদ মিনার এর ইতিবৃত্ত

“করব শপথ গড়ব আবার মহান ভারত দেশ,
বিরোধের আজ হোক অবসান নব উন্মেষ।
আগামী দিনে গাইবে সবে স্বাধীনতার গান
মাতৃভূমির যোগ্য সন্তান শহীদ মায়ের প্রাণ।
রক্ত মেখে দেশ গড়তে সহে গেছে অপমান,
জয়ের গান গাইব মোরা শহীদদের অবদান। “

 কবির এই কথাগুলো বার বার যেন আমাদের দেশের সাহসী শহীদদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, আর তাদের আত্মবলিদানের ইতিহাস তাদের প্রতি আমাদের সম্মান আরো বাড়িয়ে দেয়। বাংলা ভাগের পূর্বে পূর্ববাংলার সাহসী জনগন নিজেদের অধিকার অর্জন করা জন্য বহু সংগ্রাম করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মুক্তি যুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলন।

এই সংগ্রামে বহু মানুষ নিজের প্রাণ বলিদান করেছিলেন। শহীদ হয়েছিলেন নিজের দেশের জন্য। তাদের এই বলিদান স্মরণীয় করে রাখতে বেশ কিছু স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়, বিপ্লবীদের নামে রাস্তা নির্মাণ, তাদের মূর্তি নির্মাণ প্রভূত কাজ করা হয়েছিল। এই নির্মাণ কার্যের মধ্যে অন্যতম একটি নির্মাণ হল কলকাতার শহীদ মিনার।

বিপ্লবীদের অমর স্মৃতি গাথা এই শহীদ মিনারের সাথে জড়িত। তাদের আত্মবলিদানের ফলস্বরূপ আজ বহু মানুষ নিজের অধিকার উপভোগ করতে পারছেন। তাই সংগ্রামী সকল সাহসী বীরদের মনে রাখতে হবে, আর এর জন্য জানতে হবে শহীদ মিনার সৃষ্টির ইতিহাস। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা শহীদ মিনার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

শহীদ মিনারের প্রাচীন নাম, The ancient name of Shaheed Minar

কলকাতায় বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু সেই সবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম তথা দীর্ঘতম নিদর্শনগুলির মধ্যে একটি হল শহীদ মিনার। কলকাতায় স্থিত এই স্মৃতিসৌধের প্রাচীন নাম ছিল অক্টারলোনি মনুমেন্টOpens in a new tab.। এটি ১৮৪৮ সালে নির্মিত হয়। এই শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কমান্ডার মেজর জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টারলোনির কর্ম এবং কৃতিত্বের কথা স্মরণীয় করে রাখার জন্য।

শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কমান্ডার মেজর জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টারলোনির কর্ম এবং কৃতিত্বের কথা স্মরণীয় করে রাখার জন্য।

পরবর্তীতে স্বাধীনতা লাভের কিছু সময় পরে, ১৯৬৯ সালে এর নতুন নামকরণ করা হয়। স্মৃতিসৌধটির নতুন নাম হয় ‘শহীদ মিনার’, যা স্বাধীনতা লাভের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গকারী আমাদের দেশের সাহসী যোদ্ধাদের প্রশংসা তথা মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছিল। আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধে তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে সকল ধর্মের মানুষ দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তাদের সবাইকে শহীদ আখ্যা দেওয়া হয়। আর তাদের স্মরণ করে এই মিনার তৈরি হয় বলেই একে শহীদ মিনার বলা হয়।

শহীদ মিনারের অবস্থান, Location of Shaheed Minar

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে শহীদ মিনার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা শহরে অবস্থিত। এই স্মৃতিস্তম্ভটি মধ্য কলকাতার এসপ্ল্যানেডের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। বলতে গেলে কলকাতার উপর দিয়ে কোথাও গেলেও এই নির্দশনটি বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যায়।

কলকাতার শহীদ মিনার এক নতুন সৃষ্টির প্রতীক, এই শহীদ মিনার পুরোনো রাষ্ট্র সমাজ ভেঙে দিয়ে নতুন রাষ্ট্র ও নতুন সমাজ গড়ার প্রতীক, এই শহীদ মিনার অন্যায়মূলক শাসন ও ব্রিটিশদের শোষণ অবসানের জন্য হওয়া সংগ্রামের প্রতীক, এই শহীদ মিনার আর্থ-সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক। তাই এই স্মৃতিসৌধকে সকলেই সম্মান করেন।

এই মিনার প্রতিবার আমাদেরকে বীর শহীদদের বলিদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করা এবং এর রক্ষায় এই শহীদ মিনার তরুণদের সর্বদাই উদ্বুদ্ধ করে। 

শহীদ মিনারের অবস্থান

কলকাতার শহীদ মিনার সম্পর্কে কিছু বিশেষ তথ্য, Special information about Shaheed Minar in Kolkata

শহীদ মিনারটি ৪৮ মিটার অর্থাৎ ১৫৭ ফুট উঁচু। এর জনপ্রিয়তা শুধু কলকাতা শহরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশ থেকে মানুষ আসেন এই নিদর্শনটি দেখার জন্য, তাছাড়াও দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষ কলকাতা ভ্রমণকালে অবশ্যই এই বিশেষ স্থানটি পরিদর্শন করেন। বলতে গেলে এটি কলকাতার একটি ল্যান্ডমার্ক।

এর উপরের দিকে দুটি বারান্দা রয়েছে। মিনারের উপরের তলায় একটি সর্প সিঁড়ি দ্বারা গম্বুজের দিকে উত্তরণ করা যায়। এই শহীদ মিনারের শীর্ষে পৌঁছাতে সর্প সিড়ির ২২৩ টি ধাপ বেয়ে উঠতে হয়, উপরে উঠার পর সেখান থেকে কলকাতার দৃশ্য উপভোগ করা যায়। শহীদ মিনারের স্থাপত্যে মিশরীয় ডিজাইন, সিরিয়ান এবং তুর্কি শৈলীর এক উজ্জ্বল মিশ্রণ প্রদর্শন করা হয়েছে।

শহীদ মিনারের ইতিহাস, History of Shaheed Minar

শহীদ মিনার অতি প্রাচীন নিদর্শন, তাই এটি তৈরির ইতিহাস বহু প্রাচীন ঘটনাবলীর সাথে যুক্ত, যা স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ের সাথে জড়িত। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে মারাঠাদের বিরুদ্ধে তার সফল আত্মরক্ষা এবং ১৯৪৮ সালে সংগঠিত ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কম্যান্ডার মেজর-জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টারলোনির গোর্খাদের বিরুদ্ধে জয়কে সম্মান জানাতে স্মৃতিসৌধটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

ডেভিড অক্টারলোনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ সেনা আধিকারিক। তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং কর্মক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব পালনের জন্য ভারতে আসেন। কর্মজীবনে বিভিন্ন যুদ্ধে অসামান্য পারদর্শিতার প্রদর্শনের কারণে তিনি অচিরেই মেজর জেনারেল পদে উত্তীর্ণ হন।

১৮১৪-১৬ সালে সংগঠিত নেপালযুদ্ধে জয়লাভ করার ফলে তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করার সুযোগ পান। স্থপতি জে পি পার্কার মিশরীয় এবং সিরিয়ান শৈলীর মিশ্রণের উপর ভিত্তি করে এই ৪৮ মিটার উঁচু স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করেন, এতে একটি গম্বুজও সংযুক্ত করা আছে যা তুর্কি নকশার সাথে আকর্ষণীয় সাদৃশ্যযুক্ত নকশা করা আছে। 

শহীদ মিনারের ইতিহাস

২০১১ সালের সৌধটির সংস্কারের কাজ, Renovation of the monument in 2011

স্মৃতিস্তম্ভটিতে শেষ ব্যক্তি যিনি আরোহণ করেছিলেন তিনি হলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী সহ তাঁর পরিবার। ১৯৮৯ পর্যন্ত এই স্তম্ভটি সকল দর্শনার্থীর জন্যই উন্মুক্ত ছিল কিন্তু এই একই সালে শহীদ মিনারের নীচের বারান্দা থেকে একজন পর্যটক লাফিয়ে পড়ে যাওয়ার পর থেকে এই মিনারে ওঠা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীতে স্মৃতিস্তম্ভটিতে ওঠার জন্য পুলিশের থেকে পূর্বের অনুমতি নেওয়ার নিয়ম রাখা হয়।

তবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার সম্প্রতি স্থানীয় জনসাধারণ এবং পর্যটক উভয়ের জন্য স্মৃতিস্তম্ভটিকে উন্মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে । তাছাড়া আবারও পুনর্নির্মাণের কাজ করা হয় ২০১১ সালের শেষদিকে থেকে। উক্ত পর্যায়ে পর্যটক এবং স্থানীয় মানুষ উভয়ই যেন স্মৃতিস্তম্ভের শীর্ষে উঠতে পারেন সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়, অন্যদিকে স্মৃতিসৌধের সামনে বিভিন্ন স্টল বসানোরও পরিকল্পনা তথা আশেপাশের পথগুলি পরিষ্কার করা এবং ফুল গাছ দিয়ে পথ সুসজ্জিত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়। এই সংস্কারের খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা।

মিনারকে ভিতর ও বাইরে থেকে আলোকিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মিনারটি নতুন করে রংও করা হয়েছে। এছাড়াও মিনারের পাদদেশে একটি অস্থায়ী মঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়, ফলে রাজনৈতিক সমাবেশের সময় ডোরিনা ক্রসিংয়ে যানজটের সমস্যা কম হবে। তাছাড়া শহীদ মিনারের দক্ষিণ দিকে সুবিস্তৃত বিশাল একটি মাঠ রয়েছে, যা শহীদ মিনার ময়দান বা ব্রিগেড গ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত। এই জায়গাটি বেশ কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

শহীদ মিনার ময়দানে প্রথম রাজনৈতিক সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে। উক্ত অনুষ্ঠানে তিনি ১৯৩১ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা হিজলি জেলে তরুণ বন্দিদের হত্যা করার ঘটনাকে নিন্দা করেছিলেন।

২০১১ সালের সৌধটির সংস্কারের কাজ

উপসংহার, To conclude

কলকাতার শহীদ মিনারের ইতিহাস সম্পর্কে তথা অন্যান্য বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে আমাদের এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি এই স্মৃতিসৌধ সম্পর্কে বেশ কিছু জরুরী তথ্য আপনারা জানতে পেরেছেন। কলকাতার এই বিশেষ দর্শনীয় স্থানটি অবশ্যই একবার হলেও প্রদর্শন করে আসুন। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মবলিদানের নিমিত্তে নামাঙ্কিত এই সৌধটি বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের মনে আরো বাড়িয়ে তুলবে।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts