বৌদ্ধ মঠগুলিতে বা বইয়ের পাতায় বুদ্ধের মূর্তি অথবা ছবিতে তাঁর মস্তক দেখে আমাদের মনে প্রায়শই একটি প্রশ্ন জাগে – মাথার ওপর গোলাকার প্যাঁচানো বস্তুগুলো কী? ছোটবেলা থেকে এই প্রশ্নটি মনের কোণে ঘুরপাক খেলেও এর সঠিক উত্তর হয়তো অনেকেরই অজানা।
আমরা জানি, জ্ঞানার্জনের জন্য গৃহত্যাগের সময় গৌতম বুদ্ধ তাঁর মস্তক মুন্ডন করিয়েছিলেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও মাথা কামানোর দৃশ্য আমাদের পরিচিত। অথচ অধিকাংশ ছবি বা মূর্তিতে বুদ্ধের মাথায় ১০৮টি ছোট ছোট গোলাকৃতি, আংটির মতো প্যাঁচানো চুলের জটা দেখা যায়। কেন শিল্পী বা স্থপতি এমনটা চিত্রিত করেছেন? প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এগুলো চুল নয়। বৌদ্ধধর্মের এক আশ্চর্য কাহিনি অনুসারে, বুদ্ধের মাথায় যা দেখা যায়, সেগুলো আসলে ১০৮টি শামুক!
১০৮ শামুকের আত্মত্যাগের কাহিনি :
এই ১০৮টি শামুকের কাহিনিটি এক গভীর তাৎপর্য বহন করে। লোককথা অনুযায়ী, একদিন ভগবান বুদ্ধ একটি বৃক্ষতলে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। তাঁর ধ্যান এতটাই গভীর ছিল যে, তিনি সময়ের খেয়াল রাখেননি। সূর্য তখন ঠিক মাথার উপরে এসে পড়েছিল এবং তার প্রখর তাপে ধরিত্রী উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। যেহেতু বুদ্ধদেব মুন্ডিত মস্তক ছিলেন, সূর্যের রশ্মি সরাসরি তাঁর মাথায় পড়ছিল।
এই সময় একটি শামুক সেই স্থান দিয়ে যাচ্ছিল। শামুকটি খেয়াল করল যে, ভগবান বুদ্ধ এই প্রচণ্ড গরমে ধ্যানস্থ হয়েছেন। যদিও তিনি একটি গাছের নীচে বসেছিলেন, কিন্তু সূর্য তখন একেবারে মাথার উপরে থাকায় তাঁর মাথায় সরাসরি রোদ পড়ছিল। শামুকটি ভাবল, মাথার ওপর এমন প্রখর রোদ পড়লে মনঃসংযোগ বিঘ্নিত হয়ে খুব শীঘ্রই বুদ্ধের ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়বার না ভেবেই শামুকটি সোজাসুজি বুদ্ধের মাথায় উঠে পড়ল। শামুকটি যেখানে বসেছিল, সেখানে তার আর্দ্র শরীরের শীতল স্পর্শ বুদ্ধের মসৃণ ও কোমল ত্বককে আরাম দিচ্ছিল।

প্রথম শামুকটির দেখাদেখি অন্যান্য শামুকেরাও ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মাথায় উঠে পড়ল এবং বুদ্ধের সম্পূর্ণ মস্তকে একটি শীতল আবরণের সৃষ্টি করল। সর্বমোট ১০৮টি শামুকের শীতল এবং স্যাঁতসেঁতে দেহ অতিরিক্ত প্রায় কয়েক ঘণ্টা অবধি বুদ্ধের ধ্যান বজায় রাখতে সহায়তা করে। প্রখর সূর্যের তাপে এই শামুকগুলি ধীরে ধীরে শুকিয়ে গিয়ে প্রাণ হারায়।
ত্যাগের স্মরণে বুদ্ধমূর্তিতে শামুক
সন্ধ্যাবেলায় যখন বুদ্ধদেব ধ্যানভঙ্গ করে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর মাথা থেকে শামুকগুলি মাটিতে ঝরে পড়ল। তখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর মাথায় ১০৮টি শামুকের একটি আস্তরণ ছিল। এই শামুকগুলি নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল বুদ্ধের জ্ঞানার্জনের পথকে সুমসৃণ ও বাধাহীন করার লক্ষ্যে।
শামুকগুলি যেহেতু বুদ্ধের জন্য তাদের জীবন দিয়েছিল, তাই তারা শহীদের সম্মান পায়। তাদের এই মহান আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই বুদ্ধমূর্তিতে ১০৮টি আংটির মতো শামুকদের অঙ্কিত করা হয়। এটি শুধু একটি শৈল্পিক উপস্থাপনা নয়, বরং ত্যাগ, সহানুভূতি এবং আত্মোৎসর্গের এক শাশ্বত প্রতীক, যা বুদ্ধের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।