ভারতের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও মর্মান্তিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে ১৯৯১ সালের ২১ মে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর মৃত্যু। তামিলনাডুতে নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় এলটিটিই-র (লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলম) এক আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ হারান তিনি। হত্যার আগের রাতের ঘটনাবলি, ষড়যন্ত্রের জাল ও আত্মঘাতী স্কোয়াডের মনস্তত্ত্ব—সব কিছু যেন এক রুদ্ধশ্বাস চলচ্চিত্রের মতো।
ইতিহাসের পটভূমি
রাজীব গান্ধীর মা ইন্দিরা গান্ধী শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন। গোল্ডেন টেম্পলে সেনা অভিযান চালানোর নির্দেশের ফলে তিনি নিজ দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হন। মায়ের মতো রাজীব গান্ধীও বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে সক্রিয় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় তিনি শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই ও সরকারের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠান। এলটিটিই এই পদক্ষেপকে শত্রুতা হিসেবে নেয় এবং তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
ষড়যন্ত্রের ছক
১৯৯০ সালের অক্টোবর থেকে এলটিটিই নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ রাজীব গান্ধীকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী শিবারাসনকে প্রধান পরিকল্পনাকারী করা হয়। তামিলনাডুতে স্থানীয় ডিকে কর্মী ভাগ্যনাথনের মাধ্যমে নলিনী ও অন্যান্যদের নিয়োগ করা হয়। গড়ে ওঠে একটি সুসংগঠিত আত্মঘাতী স্কোয়াড।
সিনেমা ও হত্যার আগের রাত

হত্যাকাণ্ডের আগের রাত ছিল অদ্ভুতভাবে স্বাভাবিক। শিবারাসন ও ধানুসহ অন্যান্যরা মিলে মাদ্রাজে সিনেমা দেখেন। ধানু ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, যেন পরদিন জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর মিশনে অংশ নিতে যাচ্ছেন না। এটি প্রমাণ করে, কী নিখুঁতভাবে ব্রেইনওয়াশ ও প্রশিক্ষিত ছিলেন তাঁরা।
ঘটনার দিন: ২১ মে ১৯৯১
সেদিন বিকেলে নলিনী, ধানু, শুভা, শিবারাসন ও ফটোসাংবাদিক হরিবাবু রওনা দেন শ্রীপেরুমবুদুরের সভাস্থলের দিকে। হরিবাবুর দায়িত্ব ছিল ছবি তোলা এবং ধানুকে রাজীবের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করা। ধানুর কোমরে বাঁধা ছিল বিস্ফোরক বেল্ট।
রাত ১০টার দিকে রাজীব গান্ধী সভায় পৌঁছালে ধানু তাঁর পা ছোঁয়ার ভান করে বোমার সুইচে চাপ দেন। মুহূর্তেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে রাজীব গান্ধী, ধানু, হরিবাবুসহ ১৬ জন নিহত হন।
পরে কী হলো?
ঘটনার পরপরই আত্মঘাতী স্কোয়াডের অন্যান্য সদস্যরা পালানোর চেষ্টা করে। কিছুদিনের মধ্যে সবাই ধরা পড়ে। তদন্তে জানা যায়, এলটিটিই-র শীর্ষ নেতারাই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। ১৯৯৮ সালে আদালত ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে বেশ কয়েকজনের সাজা হ্রাস পায়। ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট শেষ সাতজনকেও মুক্তি দেন।
রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ড ছিল শুধু একজন নেতার মৃত্যু নয়, বরং এটি ছিল ভারতীয় রাজনীতির এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। একজন তরুণ, সম্ভাবনাময় নেতা যিনি হয়তো আবার দেশের নেতৃত্বে ফিরতেন, তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল—এলটিটিই-এর দীর্ঘমেয়াদি বিদ্বেষ ও জটিল কূটনৈতিক পরিস্থিতির কারণে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের গল্প আজও ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ভয়াবহ এক স্মৃতি হয়ে জ্বলজ্বল করছে।