রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—একজন কবি, নাট্যকার, সঙ্গীতকার, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে আমাদের কাছে সুপরিচিত। কিন্তু তাঁর জীবনের একটি দিক অনেকটাই উপেক্ষিত, বিশেষত পাঠ্যপুস্তকে—সেটি হলো তাঁর ব্যবসায়িক দক্ষতা ও শিল্প-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা।
শিল্প-সাহিত্য ছাড়াও দক্ষ ‘ব্যবসায়ী’ রবীন্দ্রনাথ :
বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ শুধুই কবি ছিলেন না, ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক এবং দূরদর্শী মানুষও। তিনি জমিদারির দায়িত্ব পালন করে প্রতি মাসে ৩০০ টাকা উপার্জন করতেন, যদিও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একেবারেই সাদামাটা এবং খরচের ক্ষেত্রে সংযত। তাঁর কোনো খারাপ অভ্যাস ছিল না, বরং তিনি সচেতনভাবে সম্পদ ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতেন।
শিলাইদহে জমিদার বাবু :

১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ পারিবারিক জমিদারির তদারকি শুরু করেন শিলাইদহে, যা এখন বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় অবস্থিত। ‘জমিদার বাবু’ হিসেবে তাঁর পরিচিতি তৈরি হয় এই সময়ে। পদ্মা নদীর ঢাকাই বজরায় চড়ে তিনি তদারকি করতেন বিস্তীর্ণ জমিদারির। কিন্তু তাঁর জমিদারিত্ব ছিল একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী—তিনি প্রজাদের সঙ্গে ছিলেন অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ, প্রথাগত কঠোরতা নয়, বরং সহানুভূতির মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন।
আশা করি বিশ্ব বরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্টটি ও আপনার মনের মতন হবে।
প্রজাদের সাথে সম্পর্ক :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি ছিল কেবল অর্থ উপার্জনের উপায় নয়, বরং এক গভীর আত্মিক সংযোগের ক্ষেত্র। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা নিতেন ঠিকই, কিন্তু সেটি ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতীকী এবং নিয়মরক্ষার মতো। আসল উদ্দেশ্য ছিল মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা—প্রজাদের জীবনযাত্রা, সমস্যা ও চাহিদা সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জানা এবং যথাসাধ্য সহযোগিতা করা।
প্রায়শই গ্রামবাসীরা এই মহান কবির আগমনে ভোজ ও সমবেত অনুষ্টানের আয়োজন করতেন, যা ছিল পারস্পরিক সম্মানের প্রতীক।
প্রজাদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ নিজেই উদ্যোগ নেন—পুকুর পরিষ্কারকরণ কর্মসূচি (পুষ্করিণী-সম্মার্জনী) চালু করেন, শুরু করেন দাতব্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয়, যেখানে চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করতেন তিনিই। নারীশিক্ষার প্রসারে স্থাপন করেন মেয়েদের জন্য পাঠশালা, এবং কৃষকদের সুবিধার জন্য স্থাপন করেন গ্রামীণ ঋণব্যবস্থা।
আশা করি রবীন্দ্র জয়ন্তীর শুভেচ্ছা বার্তা, রবীন্দ্রনাথের অমূল্য বাণী সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্টটি ও আপনার মনের মতন হবে।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর সেই পুরস্কারের অর্থের একটি বড় অংশ তিনি পতিসরে স্থাপিত গ্রামীণ ব্যাঙ্কে বিনিয়োগ করেন, যাতে প্রজারা অল্প সুদে কৃষিঋণ পেতে পারে এবং মহাজনদের চক্র থেকে মুক্তি পায়।
সাহিত্যচর্চার উর্বর সময় :
এই জমিদারির অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ লেখেন ৬৯টি ছোটগল্প, যা বাংলা ছোটগল্পের এক নতুন ধারার সূচনা করে। ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘কথা ও কাহিনী’—এই সময়েই রচিত হয়। এ ছাড়াও একাধিক উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ রচনা করেন তিনি।
আশা করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের উক্তি ও ছবি সম্পর্কিত আমাদের এই পোস্টটি ও আপনার মনের মতন হবে।
শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক ভাবনা :
রবীন্দ্রনাথ ব্যবসার পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও ছিলেন দূরদর্শী। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন যে, শিক্ষা শুধু তথ্যগত নয়, বরং মানবিক এবং সার্বিক বিকাশের দিকেও নজর দেওয়া উচিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুই কবি বা সাহিত্যিক ছিলেন না, ছিলেন একজন আধুনিক মানুষ—যিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পাঠ্যবই তাঁর সাহিত্যচর্চাকে যেমন গুরুত্ব দেয়, তেমনই প্রয়োজন তাঁর এই কম আলোচিত বাস্তবধর্মী এবং ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার দিকটিও তুলে ধরা। কেননা, এই দিকগুলোই রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ মানুষ ও মহান শিল্পী করে তোলে।