বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর সামরিক সক্ষমতার অন্যতম প্রতীক হলো তাদের বিমানবাহী রণতরী। এই রণতরীগুলো একটি দেশের নৌ-শক্তির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। এদের মধ্যে প্রযুক্তিগত দিক থেকে সবচেয়ে উন্নত এবং ব্যয়বহুল বিমানবাহী রণতরীটি হলো মার্কিন নৌবাহিনীর ফোর্ড ক্লাস (Ford Class)।
এর নির্মাণ ব্যয় ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি যুদ্ধজাহাজে পরিণত করেছে। কিন্তু কী আছে এই জাহাজে যা একে এতটা বিশেষ করে তোলে? চলুন জেনে নিই এই রণতরীর বিশেষত্ব এবং আকাশছোঁয়া দামের কারণ।
মার্কিন ফোর্ড ক্লাস: আধুনিক নৌ-প্রযুক্তির চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত
মার্কিন নৌবাহিনীর ফোর্ড ক্লাস এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার হলো তাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে আধুনিক প্রজন্মের বিমানবাহী রণতরী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮তম প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড আর. ফোর্ড-এর নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। শুধু প্রযুক্তিগতভাবে উন্নতই নয়, পূর্ববর্তী রণতরীগুলোর তুলনায় এটি আরও দক্ষ, শক্তিশালী এবং কার্যক্ষমভাবে উন্নত।
ফোর্ড শ্রেণীর প্রথম জাহাজ, USS Gerald R. Ford (CVN-78), ২০১৭ সালে জলে ভাসানো হয়। প্রায় ৩৩৭ মিটার লম্বা (যা তিনটি ফুটবল মাঠের দৈর্ঘ্যের সমান) এবং প্রায় ১০০,০০০ টন ওজনের এই বিশাল রণতরীটি পারমাণবিক শক্তি দ্বারা চালিত। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই এটি জ্বালানি ছাড়াই বছরের পর বছর সমুদ্রে অবস্থান করতে পারে, যা এর অন্যতম প্রধান বিশেষত্ব।
ফোর্ড ক্লাসের অপ্রতিরোধ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ :
ফোর্ড ক্লাসকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রণতরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে রয়েছে এর কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য:
- পারমাণবিক শক্তিচালিত: ফোর্ড ক্লাস ক্যারিয়ার দুটি অত্যাধুনিক পারমাণবিক চুল্লি দ্বারা সজ্জিত। এই চুল্লিগুলো প্রচলিত জাহাজের তুলনায় অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম, যা রণতরীকে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী অপারেশনাল ক্ষমতা প্রদান করে। এর ফলে জ্বালানি রিফুয়েলিংয়ের প্রয়োজন ছাড়াই এটি দীর্ঘ সময় সমুদ্রে থাকতে পারে।
- উন্নত উড়ান ব্যবস্থা (EMALS): এই রণতরীতে একটি নতুন ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট সিস্টেম (EMALS) স্থাপন করা হয়েছে। এটি বিমান উড্ডয়ন এবং অবতরণের ক্ষেত্রে প্রচলিত বাষ্প-চালিত ব্যবস্থার চেয়ে অনেক উন্নত। EMALS বিমান পরিচালনাকে দ্রুত, নিরাপদ এবং আরও দক্ষ করে তোলে, যা কম সময়ে বেশি বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণে সহায়তা করে।
- অটোমেশন এবং প্রযুক্তি: ফোর্ড ক্লাসে উন্নতমানের অটোমেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যা ক্রু সংখ্যা হ্রাস করে এবং অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও, এটি অত্যাধুনিক রাডার, সেন্সর এবং অস্ত্র ব্যবস্থায় সজ্জিত, যা শত্রুদের হামলা থেকে রণতরীকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
কেন ফোর্ড ক্লাসের দাম আকাশছোঁয়া?
ফোর্ড ক্লাসের মোট নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। এর বিশাল দামের পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:
- প্রযুক্তিগত অগ্রগতি: রণতরীটিতে ব্যবহৃত প্রতিটি নতুন প্রযুক্তিই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। পারমাণবিক চুল্লি, EMALS ক্যাটাপল্ট এবং উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের মতো সিস্টেমগুলো গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তৈরি করা হয়েছে।
- গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয়: এর নকশা ও নির্মাণের আগে বহু বছর ধরে ব্যাপক গবেষণা চালানো হয়েছে, যার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সেগুলোকে একটি কার্যকর কাঠামোতে আনার জন্য এই ব্যয় অপরিহার্য ছিল।
- উপাদান এবং নির্মাণ: এই রণতরীটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উচ্চমানের উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকভাবেই অনেক ব্যয়বহুল। এর নির্মাণ প্রক্রিয়াটিও অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।
- দীর্ঘমেয়াদী পরিষেবা: ফোর্ড ক্লাসকে কয়েক দশক ধরে নিরবচ্ছিন্ন পরিষেবা প্রদানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এর দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্ষমতা এবং ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে চলার ক্ষমতা এর সামগ্রিক মূল্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ফোর্ড ক্লাস শুধু একটি যুদ্ধজাহাজ নয়, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার প্রতীক। এর সক্ষমতা বিশ্বজুড়ে মার্কিন নৌবাহিনীর প্রভাব আরও বাড়িয়ে তোলে।