“যেখানে শব্দগুলি ছেড়ে যায়, সেখানে সঙ্গীত শুরু হয়।”
সঙ্গীত বা গান হল এমনই এক মধুর বিষয় যা সকলের মন ভালো করে দিতে পারে। তবে অনেকেই গানের নেপথ্যে থাকা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবগত নন। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা গান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
গান বলতে কি বোঝায়? / গান বলতে কি বুঝায়? / গান শব্দের অর্থ কি? What does song mean?
নির্দিষ্ট সুর, তাল ও লয়ে উচ্চারিত ছন্দবদ্ধ রচনা হলো গান। গান দ্বারা গীত, বাদ্য, নৃত্য—এই তিন বিষয়ের সমাবেশকে বোঝানো হয়। স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে গানের সৃষ্টি। গান হলো মানুষের মনের ভাবকে কথার মাধ্যমে সুর-তাল-লয় মিলিয়ে উপস্থাপন করা।
গান সম্পর্কে কিছু কথা, A few words about music :
গান সম্পর্কে কিছু তথ্য:
- গান হলো সুসংবদ্ধ শব্দ ও সুরের সমন্বয়ে গঠিত শ্রবণযোগ্য শিল্প।
- গানের সৃষ্টি হয় স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে। এই ধ্বনি হতে পারে মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, হতে পারে যন্ত্রোৎপাদিত শব্দ অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ।
- গানের চারটি অংশ হলো স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ।
- গান গাওয়া আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক হতে পারে।
- গান গাওয়া ধর্মীয় ভক্তি, শখ, আনন্দ, স্বাচ্ছন্দ্য, আচারের অংশ হিসাবে, সঙ্গীত শিক্ষার সময় বা পেশা হিসাবে করা হতে পারে।
- গানের প্রভাব নিয়ে ট্রেন্ডস ইন কগনেটিভ সায়েন্স জার্নালে প্রায় ৪০০ প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে।
- গান মানুষের দুশ্চিন্তা, যেকোনো শারীরিক ও মানসিক ধকল সামলাতে সাহায্য করে।
গান কত প্রকার ও কি কি? How many types of music and what is it?
গান প্রধানত দুই প্রকার: শাস্ত্রীয় সংগীত, লঘু সংগীত বা দেশীয় সংগীত। এছাড়াও, সঙ্গীতের আরও কিছু প্রকারভেদ হল: প্রাচ্য সঙ্গীত ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত, যান্ত্র সঙ্গীত ও কণ্ঠসঙ্গীত, আধুনিক সঙ্গীত।
গান কী গানের বৈশিষ্ট্য? What are the characteristics of songs?
গানের বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:
- গান কোনো একটি ভাব বা বিষয় নিয়ে রচিত হয়।
- গানের এক লাইনের সঙ্গে পরের লাইনের শেষ শব্দে মিল থাকে।
- গানের সৃষ্টি স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে হয়। এই ধ্বনি মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত হতে পারে, যন্ত্রোৎপাদিত হতে পারে, অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ হতে পারে।
- একটি গান শব্দ বা ছোট কবিতার একটি সেট হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যা গাওয়া এবং একটি নির্দিষ্ট ধরনের সঙ্গীতে সেট করা হয়।
- গান গাওয়া একটি বায়বীয় কার্যকলাপ হিসাবেও গণনা করা হয় কারণ এটি রক্তে আরও অক্সিজেন প্রবর্তন করে যা ভাল সঞ্চালন – এবং একটি ভাল মেজাজ তৈরি করে।
বাংলাদেশে কি কি ধরনের গান আছে? What kind of music are there in Bangladesh?
আবহমান বাংলার মাটির গান :
- ভাটিয়ালী
- ভাওয়াইয়া
- বাউল গান
- গম্ভীরা
- যাত্রাপালা
সারি গান কখন গাওয়া হয়? When are Sari songs sung?
সারি গান নিম্নলিখিত সময়ে গাওয়া হয়: ছাদ পেটানোর সময়, নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতায়, ক্ষেতে কাজ করার সময়, ধান ভানার সময়।
সারি গানের বিশেষত্ব:
- সারি গান তালপ্রধান
- অবস্থাভেদে দ্রুত ও ধীর লয়ে গাওয়া হয়
- নৌকার মাঝি-মাল্লাদের সঙ্গেই বেশি যায়
- নৌকার মাঝি, কর্মজীবী ও শ্রমিকরা দলবদ্ধভাবে বা সারিবদ্ধভাবে কাজের তালে তালে শ্রম লাঘব করার জন্য এ গান গায়।
জারি গান কখন গাওয়া হয়? When is the Jari song sung?
ফার্সি শব্দ ‘জারি’র অর্থ শোক। বাংলা ও বাঙালিদের মহরম উৎসব উদযাপনে কারবালার বিয়োগান্তক কাহিনীর স্মরণে এই গান গাওয়া হয়। জারি গান পয়ার ছন্দে রচিত আখ্যানমূলক গাথা বা পাঁচালি। জারি গান একক কিংবা দ্বৈত গায়কদল গায়। জারির অপরিহার্য ধুয়া, পাঁচালি, ছড়া প্রভৃতি।
ভাটিয়ালি গান কখন গাওয়া হয়? When is Bhatiali song sung?
ভাটিয়ালি গান সাধারণত নৌকার মাঝিরা নদীর স্রোতে যাওয়ার সময় গান। নদীর ভাটির স্রোতে নৌকা বাইতে মাঝিদের তেমন বেগ পেতে হতো না, তাই সেই অবসর ও আনন্দে তারা লম্বা টানে গলা ছেড়ে গান গাইত। কালক্রমে এই গানই ভাটিয়ালি গান নামে পরিচিতি লাভ করে।
ভাটিয়ালি গানের বৈশিষ্ট্য:
- ভাটিয়ালি গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য সুরের দীর্ঘ টান ও লয়।
- এই গানগুলোতে মূলত মাঝি, নৌকা, দাঁড়, গুণ ইত্যাদি উল্লেখ থাকে।
- ভাটিয়ালি গান বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উভয় দেশেই গাওয়া হয়।
গান সম্পর্কে হাদিস / গান সম্পর্কে কুরআনের আয়াত, Hadith about music :
রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই আমার পরে এমন কিছু লোক আসবে যারা যেনা, রেশম, নেশাদার দ্রব্য ও গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে’ (বুখারী হা/৫৫৯০)।
আবু ওমামা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা গায়িকা নর্তকীদের বিক্রয় কর না, তাদের ক্রয় কর না, তাদের গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র শিখিয়ে দিয়ো না, তাদের উপার্জন হারাম (ইবনে মাজাহ, মিশকাত হা/২৭৮০)।
নাফে‘ (রাঃ) বলেন, একদা ইবনু ওমর (রাঃ) বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেলে তিনি তাঁর দুই কানে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা হতে সরে গেলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, নাফে‘ তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ কি? আমি বললাম, না। তিনি তার দুই আঙ্গুল দুই কান হতে বের করে বললেন, আমি একদা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। তিনি বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা হতে সরে গিয়েছিলেন এবং আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন যেভাবে আজ তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম (ছহীহ আবূদাঊদ হা/ ৪৯২৪, সনদ ছহীহ)।
ইবনুল কায়্যিম (রহিঃ) গান-বাজনার ক্ষতিকর দিক ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন,”বাদ্য-বাজনাকে জিনা-ব্যভিচারের প্ররোচনাদানকারি বলা মোটেই ভুল হবেনা, কারন বাদ্য-বাজনার চেয়ে যিনার দিকে প্ররোচনাদানকারী কার্যকর আর কোন মা্ধ্যম নেই।” [ইঘাছাত আল-লাহফান;১/২৪৫]
গান সম্পর্কে কিছু তথ্য, Some information about song :
গান সম্পর্কে কিছু তথ্য:
- গান হল মানুষের মনের ভাবকে কথার মাধ্যমে সুর-তাল-লয় মিলিয়ে উপস্থাপন করা।
- গানের সৃষ্টি হয় স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে। এই ধ্বনি হতে পারে মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, হতে পারে যন্ত্রোৎপাদিত শব্দ অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ।
- গানের নিয়ামক হলো সুর ও তাল।
- গানের বিভিন্ন প্রকার তাল হলো: ত্রিতাল, কাহার্বা তাল, দাদ্রা তাল, খেমটা তাল, তেওরা তাল, রূপক তাল, ঝাঁপতাল, একতাল।
- গানের দুটি বিস্তৃত শ্রেণী হলো শিল্প সঙ্গীত এবং জনপ্রিয় সঙ্গীত।
- শিল্প সঙ্গীত শাস্ত্রীয় ঐতিহ্যগত সঙ্গীত ফর্ম গঠিত।
- জনপ্রিয় সঙ্গীতের অন্তর্ভুক্ত রক, ইলেকট্রনিক, পপ, R&B, ফাঙ্ক, কান্ট্রি, হিপ হপ, পোলকা এবং রেগে।
গান সম্পর্কে আলোচনা, Discussion about music
আধুনিক গানে কথাশিল্প ও সুরশিল্পের সমন্বয় থাকে। বাংলা গানে সুরের প্রাধান্য থাকে না, থাকে কাব্যের প্রাধান্য। সুর তাকে ব্যঞ্জিত ও রসময় করে তোলে।
বাংলা গানের জনক কে? Who is the father of Bengali music?
কাজী নজরুল ইইসলাম ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের জনক।
বাংলা গানের ইতিহাস, History of Bengali music :
বাংলা গানের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু তথ্য:
- বাংলা গানের সূচনা হয়েছিল প্রায় হাজার বছর আগে।
- বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাহিত্য হল চর্যাপদ, যা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসঙ্গীত।
- আধুনিক বাংলা গানের জনক কাজী নজরুল।
- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত একটি গান, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ফাল্গুন ১২৮১ (জানুয়ারি, ১৮৭৫) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
- বাংলা সঙ্গীত বাংলার সহস্রাব্দ প্রাচীন ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সাংগীতিক ঐতিহ্য।
বাংলা গানের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যেমন:
বাউল, রামপ্রসাদী, বিষ্ণুপুরী শাস্ত্রীয়, কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতি, প্রভাত সংগীতা, আগমণি-বিজয়া।
গানের কয়টি অংশ ও কি কি ? How many parts of a song and what are they?
গানের চারটি অংশ হলো স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ।
প্রথমাংশ স্থায়ী, দ্বিতীয় অংশ অন্তরা ও তৃতীয় অংশ হলো সঞ্চারী। গানের শেষ পদ যাতে ভণিতা থাকে তাকে আভোগ বলে।
সংগীতের জনক কে? Who is the father of music?
আর্নল্ড শোয়েনবার্গ ছিলেন একজন ইহুদি-অস্ট্রিয়ান সুরকার যাকে প্রায়শই “আধুনিক সঙ্গীতের জনক” হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
গানের লেখক কে কি বলা হয়? What are the song writers called?
গানের লেখককে গীতিকার বলা হয়। গীতিকাররা গীতিকবি নামেও পরিচিত।
গানের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু শব্দ এবং তাদের অর্থ:
- গানের সুরকার হলেন, যিনি গানের সুর তৈরি করেন।
- গান গেয়ে শোনান ব্যক্তিকে গায়ক বলা হয়।
- গানের কথা এবং সুর সহ তাদের নিজস্ব সঙ্গীত উপাদান লেখেন, রচনা করেন এবং সম্পাদন করেন এমন সঙ্গীতজ্ঞকে গায়ক-গীতিকার বলা হয়।
শেষ কথা, Conclusion :
গান সম্পর্কে আজকের এই আলোচনার মাধ্যমে আশা করি আপনারা অনেক তথ্য জেনে নিতে পেরেছেন। আমাদের এই পোস্ট আপনাদের মনোগ্রাহী হলে অবশ্যই নিজের পরিবার ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।