অসহযোগ আন্দোলন কি? What is non-cooperation movement?

অসহযোগ আন্দোলন

অসহযোগ আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত এই অহিংস আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের একতা ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে।

সূচিপত্র: hide

অসহযোগ আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়, Different phases of non-cooperation movement

অসহযোগ আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে এই আন্দোলনে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে অসহযোগ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আন্দোলনটি বিভিন্ন পর্যায়ে পরিচালিত হয়েছিল।

প্রাথমিক পর্যায়

  • শুরু: ১৯২০ সালের ১ আগস্ট
  • উদ্দেশ্য: ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সচেতন করা এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করা।
  • কর্মসূচি: ব্রিটিশ শাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন, বিদেশি বস্ত্র বর্জন, ব্রিটিশ আদালতে মামলা না করা, ব্রিটিশ সরকারি চাকরি ত্যাগ করা, বিদেশি পণ্য বর্জন।

মধ্যবর্তী পর্যায়

  • জনসাধারণের উৎসাহ: আন্দোলন জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
  • সরকারের প্রতিক্রিয়া: ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে।
  • চৌরিচৌরার ঘটনা: ১৯২২ সালে উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরা গ্রামে একটি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে, যাতে পুলিশের উপর আক্রমণ করা হয়।

শেষ পর্যায়

  • আন্দোলন স্থগিত: চৌরি চৌড়ার ঘটনার পর মহাত্মা গান্ধী আন্দোলন স্থগিত করেন।
  • কারণ: গান্ধীজি মনে করেন যে, আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে পড়ছে।
  • পরিণাম: আন্দোলন স্থগিত হলেও জনসাধারণের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আরও জোরদার হয়।

অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধীজির অবিস্মরণীয় ভূমিকা, Gandhiji’s unforgettable role in non-cooperation movement :

মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অধ্যায়। গান্ধীজি এই আন্দোলনের মূল নেতা ছিলেন। তাঁর অসামান্য নেতৃত্বগুণের কারণে দেশবাসী এই আন্দোলনে একত্রিত হয়েছিল।

আসুন জেনে নিই এই আন্দোলনে গান্ধীজির কী ভূমিকা ছিল।

  • অহিংসা: গান্ধীজি সবসময় অহিংসার পথ অনুসরণ করতেন। তিনি আন্দোলনকে হিংসার পথে যেতে দেননি।
  • সত্যাগ্রহ: তিনি সত্যাগ্রহের ধারণা দিয়েছিলেন। এই ধারণার মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
  • স্বদেশী: গান্ধীজি স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। তিনি স্বদেশী বস্ত্র পরিধান করতে এবং স্বদেশী পণ্য ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছিলেন।
  • জনগণকে সংগঠিত করা: গান্ধীজি গ্রামে গ্রামে গিয়ে জনগণকে সংগঠিত করেছিলেন। তিনি তাদেরকে আন্দোলনে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছিলেন।

এক কথায়, মহাত্মা গান্ধীজির নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গান্ধীজির অসামান্য নেতৃত্বগুণ এবং তাঁর অহিংসার পথই এই আন্দোলনের সফলতার মূল কারণ।

অসহযোগ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য, Features of non-cooperation movement:

অসহযোগ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল:

  • এটি ছিল মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে একটি গণবিক্ষোভ।
  • এটি ছিল ভারতের ব্রিটিশ সরকারকে স্বরাজ প্রদানের জন্য প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে সংগঠিত আন্দোলন।
  • এটি ছিল গান্ধীর বৃহৎ আকারের আইন অমান্যের প্রথম সংগঠিত কর্মগুলির মধ্যে একটি।
  • এটি ছিল ভারতীয়দের ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সাথে সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানানো আন্দোলন।
  • এটি ছিল অহিংস গণ-আইন অমান্য আন্দোলন।
  • এটি ছিল ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা আন্দোলন।
  • এই আন্দোলনে বিদেশী পণ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আইন আদালত বয়কট করা হয়েছিল।
  • এই আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য, Objectives of Non-Cooperation Movement :

  • ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা: ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।
  • স্বরাজের স্বপ্ন: ভারতবাসীর স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
  • স্বদেশি আন্দোলন: বিদেশি পণ্য বর্জন করে দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করা।
  • সামাজিক সমস্যা সমাধান: অস্পৃশ্যতা নিরসন এবং নারীদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি করা।

অসহযোগ আন্দোলনের মূল কৌশল, Basic strategy of non-cooperation movement

  • সরকারি চাকরি ত্যাগ: সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে ব্রিটিশ সরকারকে অসহযোগ করা।
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ: সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীদের বের করে আনা।
  • বিদেশি পণ্য বর্জন: স্বদেশি পণ্যের ব্যবহার বাড়িয়ে বিদেশি পণ্যের বয়কট করা।
  • আইন অমান্য: অবিচারপূর্ণ আইন অমান্য করে সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানো।

অসহযোগ আন্দোলনের সময়কাল, The period of non-cooperation movement

অসহযোগ আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি অহিংস প্রতিরোধের প্রতীক হিসাবে পরিচিত।

অসহযোগ আন্দোলন কবে কোথায় শুরু হয়েছিল? Where did the non-cooperation movement begin?

অসহযোগ আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯২০ সালে শুরু হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলন মূলত ভারতব্যাপী একটি আন্দোলন ছিল। তবে, এই আন্দোলনের সূচনা এবং প্রসার ঘটেছিল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। কংগ্রেসের নেতারা বিভিন্ন প্রদেশে গিয়ে জনসাধারণকে এই আন্দোলনের জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন গ্রামীণ ভারতে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-ছাত্রী সকলেই এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

অসহযোগ আন্দোলনের কিছু উল্লেখযোগ্য স্থান, Some notable places of non-cooperation movement:

  • আহমেদাবাদ: গুজরাটের আহমেদাবাদ শহর ছিল অসহযোগ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মহাত্মা গান্ধী এই শহরে বসবাস করতেন এবং এখান থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন।
  • বারডোলি: গুজরাটের বারডোলি তালুকায় কৃষকরা ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে রাজস্ব বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছিলেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
  • চৌরি চৌরা: উত্তরপ্রদেশের চৌরি চৌরা গ্রামে একটি ঘটনা ঘটেছিল যার ফলে অসহযোগ আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায়।
  • জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড: ১৯১৯ সালে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে ব্রিটিশ বাহিনী নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। এই ঘটনা ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রোষ বাড়িয়ে তোলে।
  • খিলাফত আন্দোলন: তুর্কি খিলাফতের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। গান্ধীজি এই আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেন।

অসহযোগ আন্দোলন কখন শেষ হয়েছিল? When did the non-cooperation movement end?

১৯২২ সালে চৌরি-চৌরা ঘটনার পর গান্ধীজি এই আন্দোলন স্থগিত করে দেন।

অসহযোগ আন্দোলন কতদিন চলেছিল? How long did the non-cooperation movement last?

অসহযোগ আন্দোলন প্রায় দুই বছর চলেছিল।

আন্দোলনের প্রভাব, Effect of non-cooperation movement

  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি: ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগরণ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি।
  • সামাজিক পরিবর্তন: সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ ও সমাজে নতুন চেতনা সঞ্চার।
  • স্বদেশি শিল্পের উন্নতি: বিদেশি পণ্য বর্জনের ফলে স্বদেশি শিল্পের উন্নতি।
  • ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দুর্বলতা প্রকাশ: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেওয়া।

অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা ও কারণ, Causes of failure of non-cooperation movement

  • চৌরি চৌরা ঘটনা: চৌরি চৌরা ঘটনায় গান্ধীজি আন্দোলন স্থগিত করলে অনেকে হতাশ হয়ে পড়েন। ১৯২২ সালে উত্তরপ্রদেশের চৌরি-চৌরা গ্রামে কিছু আন্দোলনকারী পুলিশ স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনায় গান্ধীজি আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মনে করেন যে, আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে পড়ছে।
  • একতার অভাব: হিন্দু-মুসলিম একতার অভাব আন্দোলনের শক্তিকে দুর্বল করে।
  • ব্রিটিশ সরকারের দমন: ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়ন আন্দোলনকে দুর্বল করে।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন কি ? What is non-violent non-cooperation movement?

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ছিল মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের ব্রিটিশ শাসনকে প্রতিরোধ করার জন্য সংগঠিত একটি বড় স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই আন্দোলনটি ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল:

  • ভারতকে স্ব-সরকার বা স্বরাজ প্রদান করা
  • পাঞ্জাব ও তুরস্কের প্রতি অবিচার রক্ষা করা
  • সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ করা

সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন কি? What is the Total Non-Cooperation Movement?

সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন বলতে বোঝায়, পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকা আন্দোলন। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের একতরফা ঘোষণার পরে বঙ্গবন্ধু এই আন্দোলনের ডাক দেন।

১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন বলতে কি বুঝায়? What does the non-cooperation movement of 1971 mean?

১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন বলতে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) আওয়ামী লীগ এবং সাধারণ জনগণের পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মার্চ মাসে সংঘটিত আন্দোলনকে বোঝায়। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। এই আন্দোলন মোট ২৫ দিন স্থায়ী হয়।

শেষ কথা, Conclusion :

অসহযোগ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি স্বর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবাসী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছিল এবং স্বাধীনতার সংগ্রামকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। যদিও আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছিল, তবে এর প্রভাব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তী ধাপগুলিতে গভীরভাবে অনুভূত হয়েছিল।

RIma Sinha

Rima Sinha is working as a writer and also as a journalist. she got her bachelor of arts degree from Tripura University. She has also completed Master of Arts in Journalism and mass communication from Chandigarh University.

Recent Posts