বাত বা আর্থ্রাইটিস হল ব্যথা, ফোলা এবং জয়েন্টের প্রদাহের সাথে যুক্ত একটি ব্যাধি। বাত বা আর্থ্রাইটিস আমাদের শরীরের এক বা একাধিক জয়েন্টকে প্রভাবিত করতে পারে। এই রোগ সাধারণত ৬৫ বছরের বেশি বয়সী অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশী দেখা যায়, তবে অনেকসময় এই সমস্যাটি শিশু তথা অল্প বয়স্কদের মধ্যেও দেখা যায়। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা বাতের ব্যথা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে আলোচনা করবো।
- 1 আর্থ্রাইটিস কি? What is arthritis?
- 2 আর্থ্রাইটিস বিভিন্ন ধরনের কি কি? Different types of arthritis
- 3 আর্থ্রাইটিসের কারণ এবং ঝুঁকিগুলি কী কী? Causes and risks related to arthritis
- 4 বাত বা আর্থ্রাইটিসের লক্ষণগুলো কী? Symptoms of arthritis
- 5 বাত নির্ণয় কিভাবে করতে হয়? How to diagnose arthritis
- 6 বাত বা আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা কিভাবে হয়? Treatment of arthritis
- 7 বাতের জন্য কিছু ঘরোয়া প্রতিকার, home remedies of arthritis
- 8 উপসংহার, Conclusion
আর্থ্রাইটিস কি? What is arthritis?
আর্থ্রাইটিস রোগে শরীরের একাধিক জয়েন্টে ব্যথা অনুভব হয়, কখনো ব্যথাযুক্ত অংশটি শক্ত হওয়া এবং প্রদাহ হয়। সাধারণত পা, হাত, পিঠের নিচে, হাঁটুতে আর্থ্রাইটিসের বেশি প্রভাব দেখা যায়। এটি এমন সমস্যা যা বয়সের সাথে আরও কষ্টদায়ক হয়।
আর্থ্রাইটিস বিভিন্ন ধরনের কি কি? Different types of arthritis
আর্থ্রাইটিস বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কিছু সাধারণ প্রকারের মধ্যে রয়েছে:
অস্টিওআর্থারাইটিস: এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরনের আর্থ্রাইটিস যা কখনো জোরে আঘাত পাওয়া বা বয়স বৃদ্ধির কারণে ঘটে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: এটি মূলত একটি অটোইমিউন ধরনের আর্থ্রাইটিস। এক্ষেত্রে যখন শরীরের ইমিউন সিস্টেম অসুস্থ কোষের বদলে ভুল করে শরীরের সুস্থ কোষকে আক্রমণ করতে শুরু করে তখন এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সংক্রামক আর্থ্রাইটিস: কোনো সংক্রমণ যা শরীরের অন্য অংশ থেকে জয়েন্টের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করে তাকে সংক্রামক আর্থ্রাইটিস বলে।

জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস: এই সমস্যা ১৬ বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস: সোরিয়াসিস রোগীদের মধ্যে এই ধরনের আর্থ্রাইটিস দেখা যায়। এটি একটি অটোইমিউন ডিসঅর্ডার যার কারণে ত্বকে জ্বালা সৃষ্টি হয়ে থাকে।
গেঁটেবাত: এটি হল বেদনাদায়ক আর্থ্রাইটিস যা ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি হওয়ার কারণে ঘটে। এই সমস্যাটি সাধারণত পায়ের বুড়ো আঙুলে দেখা যায়, পরে অন্য অংশে প্রভাব ফেলে।
আর্থ্রাইটিসের বিভিন্ন কারণগুলি হল-
- পারিবারিক ইতিহাস :- যদি বাবা-মা বা ভাইবোনদের কারোর মধ্যে এই ব্যাধি থাকে তবে আপনারও আর্থ্রাইটিস হওয়ার প্রবণতা থাকে।
- অটোইমিউন ডিজিজ :- এই ক্ষেত্রে, শরীরের ইমিউন সিস্টেম হাড়ের জয়েন্ট ক্যাপসুলের আস্তরণে আক্রমণ করে, যার ফলে হাড়ে ফোলাভাব সৃষ্টি হয়, ক্রমে ব্যথা এবং অন্যান্য বিভিন্ন সমস্যা বেড়ে ওঠে।
- ভাইরাল ইনফেকশনের প্রভাবে :- অন্যান্য স্থান থেকে জয়েন্ট ক্যাভিটিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ফলে ফোলা ও ব্যথা হতে পারে, সেই কারণে আর্থ্রাইটিসের সমস্যা দেখা দেয়।
- জয়েন্টগুলিতে বারবার চাপ পড়ার কারণে :- ক্রীড়াবিদদের বিভিন্ন ভাবে- জয়েন্টে আঘাত পড়ে যার কারণে এটি ফুলে যায় এবং সেই জয়েন্টে আর্থ্রাইটিসের সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- ব্যায়াম না করার ফলে :- ব্যায়াম না করার ফলে জয়েন্টগুলো শক্ত হয়ে যায় এবং আপনার আর্থ্রাইটিস হতে পারে।
- স্থূলতা- বয়সের তুলনায় শরীরের ভারী ওজন হাঁটু, নিতম্ব এবং মেরুদণ্ডের জয়েন্টগুলিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, সেজন্যই স্থূলকায় লোকেদের আর্থ্রাইটিস হওয়ার প্রবণতা বেশি।

তবে সাধারণত মহিলাদের ক্ষেত্রে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের সমস্যা বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে পুরুষদের গাউট ধরনের আর্থ্রাইটিস বেশি হয়।
বাত বা আর্থ্রাইটিসের লক্ষণগুলো কী? Symptoms of arthritis
বাত বা আর্থ্রাইটিসের বিভিন্ন ধরণ এবং রোগের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে এর লক্ষণগুলিও পরিবর্তিত হয়। লক্ষণগুলি হল:
- হাড্ডির সংযোগ স্থলে ব্যথা।
- জয়েন্ট ফুলে যাওয়া।
- আক্রান্ত জয়েন্টের উপরের ত্বকে লালভাব
- জয়েন্টের শক্ত হয়ে যাওয়া।
- ত্বকে উষ্ণতার অনুভূতি হওয়া।
- জয়েন্ট এর নড়াচড়ার পরিসর হ্রাস পাওয়ার কারণে প্রতিদিনের স্বাভাবিক কার্য সম্পাদনে সমস্যা দেখা দেয়।

বাত নির্ণয় কিভাবে করতে হয়? How to diagnose arthritis
বাতের সমস্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন লক্ষণের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসকেরা প্রথমে রোগীর শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। তবে কোনো চিকিৎসা শুরু করার পূর্বে বাতের রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস এবং পারিবারিক ইতিহাস ডাক্তারের কাছে উল্লেখ করা জরুরী। রোগ নির্ণয়ের জন্য যা করা হয় :
চিকিৎসক রোগীর জয়েন্টগুলির গতি এবং গতিশীলতার পরিসর পরীক্ষা করেন, পাশাপাশি জয়েন্ট অঞ্চলের চারপাশে কোমলতা বা ফোলাভাব রয়েছে কি না তাও বুঝতে চেষ্টা করেন।

আর্থ্রাইটিস রোগ আছে কি না তা নিশ্চিত করার জন্য ডাক্তারেরা আক্রান্ত রোগীর জয়েন্টের নিম্নলিখিত পরীক্ষা করানোর জন্য পরামর্শ দেন-
- এক্স-রে
- এম.আর. আই স্ক্যান
- আল্ট্রাসাউন্ড
- রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গাউট নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, চিকিৎসকেরা রক্তে প্রদাহজনক প্রোটিন বা ইউরিক অ্যাসিডের উপস্থিতি আছে কি না তা বোঝার জন্য রক্ত পরীক্ষারও সুপারিশ করতে পারেন।
বাত বা আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা কিভাবে হয়? Treatment of arthritis
চিকিৎসা শাস্ত্রে আর্থ্রাইটিসের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে লক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করে সমস্যাগুলো বেশ কিছুটা প্রশমিত করা যায়, চিকিৎসার ক্ষেত্রে যা যা করা হয় :-
- ওষুধ সেবন : আর্থ্রাইটিসের সাথে সম্পর্কিত উপসর্গগুলি থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যথা এবং প্রদাহবিরোধী ওষুধগুলি সাহায্য করতে পারে।
- ফিজিওথেরাপি : কিছু বিশেষ ব্যায়াম আছে যা বাতের সমস্যাগুলোকে প্রভাবিত করে এবং জয়েন্টের চারপাশে থাকা পেশীগুলির গতিশীলতা এবং শক্তির উন্নতিতে সাহায্য করে।
- থেরাপিউটিক ইনজেকশন : ইনজেকশনগুলি জয়েন্টগুলিতে প্রদাহ এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- ভিসকোসপ্লিমেন্টেশন: বাত ব আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে, জয়েন্ট শক্ত হয়ে গেলে, একটি লুব্রিকেন্ট ইনজেকশন দেওয়া হয় জয়েন্টের মসৃণ নড়াচড়া করানোর জন্য ।
- অস্ত্রোপচার : আর্থ্রাইটিসের সমস্যাগুলোর খুব গুরুতর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে, কারণ অনেক সময় এমন কিছু সমস্যা দেখা দেয় যা অন্যান্য ধরনের চিকিৎসার দ্বারা নিরাময় করা যায় না। সাধারণত জয়েন্ট প্রতিস্থাপন করার জন্য সার্জারি করতে হয়ে পারে। এক্ষেত্রে নতুন কৃত্রিম জয়েন্ট দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জয়েন্ট প্রতিস্থাপন করা হয়, এভাবে জয়েন্টের কার্যকারিতা সংরক্ষণ হয় এবং জয়েন্টের নাড়াচাড়া স্বাভাবিক করতে সহায়তা করে। জয়েন্ট প্রতিস্থাপনের উদাহরণ হল : হাঁটু প্রতিস্থাপন, গোড়ালি প্রতিস্থাপন এবং কাঁধ প্রতিস্থাপন।

বাতের জন্য কিছু ঘরোয়া প্রতিকার, home remedies of arthritis
বাতের সমস্যার প্রভাব নিজের দেহ থেকে কম করার জন্য কিছু ঘরোয়া প্রতিকার কাজে লাগাতে পারেন। নিত্যদিনের খাবারের পাশাপাশি নিম্নলিখিত বিশেষ প্রতিকারমূলক খাবার খেয়ে দেখুন :
- লেবুর রস খান: আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন যে লেবুতে অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য আছে যা বাতের ব্যথা কমাতে খুবই উপকারী।
- বাথুয়ার রস: বাথুয়া হল একটি সবুজ শাক। যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং ক্যালসিয়াম থাকে, যা আমাদের মাংসপেশির সচলতার জন্য খুবই ভালো। বাতের ব্যথা প্রশমনের ক্ষেত্রেও এই বাথুয়ার রস বিশেষভাবে কার্যকর।
- অ্যালোভেরা জেল: অ্যালোভেরা জেলকে অনেক রোগের ওষুধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাতের ব্যথায় এটি খুবই উপকারী। এতে রোগী অনেক আরাম পাবেন।
- অশ্বগন্ধা গুঁড়ো: আমাদের শরীরের সব ধরনের ব্যথায় অতি উপকারী ভূমিকা পালন করে। বাতের ব্যথা উপশম করতে অশ্বগন্ধার গুঁড়ো খেতে পারেন জলে অশ্বগন্ধা গুঁড়ো মিশিয়ে সকাল বা সন্ধ্যায় পান করুন।
- আলুর রস: আলুর রস খেলে বাতের ব্যথা উপশম হয়। তাই আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এটি উপকারী।

উপরিউক্ত সকল ঘরোয়া উপায় ছাড়াও বাতের ব্যথা অনুভব হলে ক্যাস্টর অয়েল দিয়ে জয়েন্টে ভালোভাবে মালিশ করুন। এই তেলে এমন সব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা ব্যথা শোষণ করে নেয়। তাই বাতের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে রোজ জয়েন্টে ক্যাস্টর অয়েল মালিশ করে দেখতে পারেন।
উপসংহার, Conclusion
বাত বা আর্থরাইটিস তেমন মারাত্বক রকমের রোগ না হলেও অনেক কষ্টদায়ক। এর নির্মূল সম্ভব নয়, তবে বিভিন্ন উপায়ে প্রশমিত করা যায়। আশা করি আপনাদের আজকের এই নিবন্ধের মাধ্যমে আপনারা আর্থ্রাইটিস এবং বাত সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছেন। লক্ষণ বুঝে উপরে উল্লেখিত ঘরোয়া প্রতিকার কাজে লাগিয়ে দেখতে পারেন, তবে প্রয়োজনে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী।