কালোজিরার দানাগুলো দেখতে ছোটো হলেও এর গুণাবলী প্রচুর। এর উপকারিতা সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক তথ্য রয়েছে। আপনারা কালোজিরার স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে খোঁজ করলে হয়তো অবাক হয়ে যাবেন যে এই ছোটো দানাগুলো আমাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে কতটা উপযোগী।
সংক্ষেপে যদি বলা হয় তবে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিধন থেকে শুরু করে শরীরের কোষ ও কলার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এই কালোজিরা। প্রত্যেকের রান্নাঘরেই কালোজিরা থাকে, যা বেশিরভাগ সময় পাঁচ ফোড়ন হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই কালোজিরার আরো আশ্চর্য কিছু উপকারিতা আছে যা অনেকেরই অজানা। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা সেইসব তথ্যই তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
কালোজিরার বিভিন্ন নাম, Different names of Black cumin
রান্নায় ব্যবহৃত এই ছোটো কালো বীজ বাঙালিদের মধ্যে কালোজিরা নামে পরিচিত হলেও বিভিন্ন স্থানে এর ভিন্ন নাম আছে, যেমন- কালো কেওড়া, রোমান করিয়েন্ডার বা রোমান ধনে, হাব্বাটুসউডা, ফিনেল ফ্লাওয়ার, নিজেলা ও কালঞ্জি ইত্যাদি। কালোজিরার বৈজ্ঞানিক নাম nigella sativa। তবে একে যে নামেই ডাকা হোক না কেন এ কথা মানতেই হবে যে এই কালো বীজের স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিসীম।
উপাদান, Components
কালোজিরাতে থাকে ফসফেট, লৌহ ও ফসফরাস। এসব ছাড়াও আছে ক্যানসার প্রতিরোধক কেরটিন, রোগ প্রতিরোধকারী বিভিন্ন উপাদান এবং অম্ল রোগের প্রতিষেধক।
কালোজিরার উপকারিতা, Benefits of black Cumin
আমরা অনেকেই এ ব্যাপারে অজ্ঞাত যে কালোজিরা আমাদের দেহ থেকে বহু রোগ দূরে রাখতে সক্ষম। অরুচি হোক কিংবা পেটে ব্যথা, অথবা পেটের অন্য বিভিন্ন সমস্যা যেমন ডায়রিয়া, আমাশয়, ইত্যাদি সারাতেও কালোজিরা উপযোগী। তাছাড়াও জন্ডিস, জ্বর, গলা ও দাঁতে ব্যথা, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, সর্দি, কাশি, মাইগ্রেন, চুলপড়া, শ্বেতি, দাদ, একজিমা, এমনকি হাঁপানিতেও কালোজিরা অব্যর্থ ঔষধ হিসেবে কাজ করে।
এটি উচ্চরক্তচাপ হ্রাসকারক, ক্ষতিকর ভাইরাস প্রতিরোধক, গ্যাসট্রিক আলসার, টিউমার এবং ক্যান্সার প্রতিরোধক, ব্যাকটেরিয়া এবং কৃমিনাষক, যকৃতের বিষক্রিয়ানাষক, এলার্জি প্রতিরোধক, বাতব্যথা নাশক হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। কালোজিরা সেবনের ফলে পেটের যাবতীয় রোগ-জীবাণু ও গ্যাস দূর হয়, ক্ষুধা বেড়ে যায় এবং এটি দেহের কাটা-ছেঁড়া তাড়াতাড়ি শুকানোর ক্ষেত্রেও বিশেষ উপযোগী। এছাড়া কোনো কারণে শরীরে ঘা, ফোঁড়া, অথবা চামড়ার কোনো ধরনের ছোঁয়াচে রোগ হলে তিলের তেলের সঙ্গে কালিজিরা বাটা বা কালোজিরার তেল মিশিয়ে লাগালে তাড়াতাড়ি উপশম হয়।
কালোজিরার কিভাবে সেবন করলে উপকার পাওয়া যায় জেনে নিন, How to take Black cumin to get it’s full benefits
মাথা ব্যাথা নিরাময়ে সহায়ক, relief from headache
মাথা ব্যাথা নিরাময়ে কালোজিরা খুব উপযোগী। ১/২ চা-চামচ কালোজিরার তেল ভালোভাবে মাথায় লাগাতে পারেন, এতে মাথার যন্ত্রণা কম হবে। এছাড়াও মাথা ব্যাথা এড়িয়ে যেতে ২/৩ সপ্তাহ এক চা চামচ কালোজিরার তেল ও সমপরিমাণ মধুসহ দিনে তিনবার করে সেবন করতে পারেন।
সর্দি সারাতে কালোজিরা সেবন, relief from cough and cold
এক চা-চামচ কালোজিরার সাথে তিন চা-চামচ মধু ও দুই চা-চামচ তুলসী পাতার রস মিশিয়ে খেতে পারেন, এতে জ্বর, ব্যাথা, সর্দি-কাশি দূর হয়। সর্দি যদি বসে যায় তবে কালিজিরা বেটে কপালে প্রলেপ দিন। একই সাথে একটি পাতলা পরিষ্কার সুতি কাপড়ে কালিজিরা বেঁধে নিয়ে শুঁকতে থাকুন, বুকে জমে থাকা শ্লেষ্মাগুলো তরল হয়ে ঝরে পড়বে। তবে যদি দ্রুত ফল পেতে চান, তাহলে বুকে ও পিঠে কালিজিরার তেল মালিশ করুন।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন রাখতে কালোজিরা, controlling blood pressure
প্রতিদিন সকালে সমস্ত শরীরে কালোজিরার তেল মালিশ করতে হবে, এরপর সূর্যের তাপ কমপক্ষে আধাঘন্টা সময় গায়ে লাগাতে হবে। কালোজিরা বা কালোজিরা তেল বহুমুত্র রোগীদের রক্তের শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং নিম্ন রক্তচাপকে বৃদ্ধি করে ও উচ্চ রক্তচাপকে হ্রাস করে।
শ্বাস কষ্ট বা হাঁপানি রোগ সারাতে কালোজিরার ব্যবহার, remedy for asthma
যারা হাঁপানী বা শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য কালোজিরা খুব উপকারী। তাই প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় কালোজিরা বাটা রাখুন, কারণ এই কালোজিরা হাঁপানি বা শ্বাস কষ্টজনিত সমস্যা উপশম করে। এছাড়াও শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি কাপ নিয়ে তাতে এক চা-চামচ কালোজিরার তেল, এক কাপ চায়ের সাথে দৈনিক ৩ বার করে নিয়মিত সেবন করতে পারেন।
ডায়বেটিজ নিয়ন্ত্রণে কালোজিরার সেবন, controlling blood sugar
ডায়াবেটিকদের রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কাজে লাগে এই কালিজিরা। এরজন্য এক চিমটি পরিমাণ কালিজিরা একটি গ্লাসে নিয়ে তাতে জল যোগ করুন। কিছুক্ষণ রেখে দিন এবং প্রতিদিন সকালে এই জল খালি পেটে খেয়ে দেখুন, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
অনিয়মিত মাসিক রোগের ক্ষেত্রে কালোজিরার ব্যবহার, a remedy to irregular periods
এক কাপ কাঁচা হলুদের রস অথবা আতপ চাল ধোয়া জল নিয়ে এর সাথে এক কাপ চা-চামচ কালোজিরার তেল মিশিয়ে দৈনিক ৩ বার করে নিয়মিত সেবন করুন। অনিয়মিত মাসিক রোগের ক্ষেত্রে এটি শতভাগ কার্যকরী ।
দুগ্ধ দান কারিনী মা’দের দুধ বৃদ্ধির জন্য, production of milk for breastfeeding mothers
শিশু প্রসবের পর যেসব মায়েদের বুকে পর্যাপ্ত দুধ থাকেনা, তাদের জন্য মহৌষধ হল কালিজিরা। মায়েরা প্রতি রাতে শোয়ার আগে ৫-১০ গ্রাম কালিজিরা গুঁড়ো করে দুধের সঙ্গে খেতে পারেন, দেখবেন মাত্র ১০-১৫ দিনে বুকের দুধের প্রবাহ বেড়ে যাবে।
ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে কালিজিরার সেবন, For youthful skin
ত্বকের প্রভা বৃদ্ধির জন্য কালোজিরা বিশেষ উপযোগী, কারণ এতে লিনোলেইক এবং লিনোলেনিক নামক এসেনশিয়াল ফ্যাটি এসিড থাকে যা আপনার ত্বককে পরিবেশের প্রখরতা, স্ট্রেস ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে এবং আপনার ত্বককে মসৃণ, সুন্দর করে তোলে ও ত্বকের তারুণ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
লিভারের সুরক্ষায় কালোজিরার ভূমিকা, good for liver
লিভারের সুরক্ষায় এই ক্ষুদ্র আকৃতির ভেষজটি অনন্য। কালিজিরা লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী আফলাটক্সিন নামক বিষকে ধ্বংস করতে সক্ষম ।
চুল পড়া বন্ধ করতে, for hair fall remedies
কালিজিরা সেবনে চুল পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়। ফলে চুল পড়া কমে যায়। আরো ভালো ফল পেতে হলে চুলের গোড়ায় কালোজিরার তেল মালিশ করতে পারেন, কারণ কালোজিরার তেল চুলের কোষ ও ফলিকলকে সতেজ করে ও শক্তিশালী করে তোলে যার ফলে নতুন চুল গজায়। এছাড়াও কালোজিরার তেল আমাদের চুলের গোড়া শক্ত করে দেয় ফলে চুল পড়া হ্রাস পায়।
দাঁত ব্যথা দূরীকরণে কালোজিরা কার্যকরী, for prevention of tooth ache
কখনও দাঁতে ব্যথা হলে কুসুম গরম জল নিয়ে তাতে আধা চামচ কালোজিরা দিয়ে কুলকুচি করলে ব্যথা কমে; তাছাড়া এভাবে জিহ্বা, তালু, দাঁতের মাড়ির জীবাণুও মরে যায়।
ত্বক ভালো রাখতে যেভাবে কলোজিরা ব্যবহার করতে হবে, usage of black Cumin for keeping your skin healthy
· মধু ও কালোজিরার পেস্ট বানিয়ে ত্বকে লাগিয়ে আধাঘন্টা বা একঘন্টা রাখে ধুয়ে ফেলুন, এতে ত্বক উজ্জ্বল হবে।
· যদি আপনার ব্রণের সমস্যা থাকে তাহলে আপেল সাইডার ভিনেগারের সাথে কালোজিরা মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিন। নিয়মিত লাগালে ব্রণ দূর হবে।
· শুষ্ক ত্বকের জন্য কালোজিরার গুঁড়া ও কালোজিরার তেলের সাথে তিলের তেল মিশিয়ে ত্বকে লাগান। এক সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখতে পাবেন।
গ্যাষ্ট্রীক বা আমাশয় নিরাময়ে কালোজিরা সেবন : remedy to gastritis
এক চা-চামচ তেল এবং সমপরিমাণ মধু একসাথে নিয়ে দিনে ৩ বার করে সেবন করুন।
জন্ডিস বা লিভারের বিভিন্ন সমস্যার দূরীকরণে কালোজিরা :
একগ্লাস ত্রিফলার জলের সাথে এক চা-চামচ কালোজিরার তেল মিশিয়ে রোজ সকালে খেতে পারেন।
সতর্কতা, Precautions
গর্ভাবস্থায় কোনো মা ও দুই বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের কালোজিরার তেল সেবন করা উচিত নয়। তবে বাহ্যিক ভাবে ব্যবহার করা যাবে। আরো একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে কালোজিরা অতিরিক্ত সেবনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিন সেবনে কালোজিরার বিভিন্ন অপকারিতা লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে ত্বকের প্রদাহ, পাকস্থলীর সংকোচন, বুক জ্বালা ও বমিবমি ভাব হতে পারে। বিশেষ করে যারা নিয়ম করে তিনমাসের অধিক সময় ধরে সেবন করে যাচ্ছেন। এছাড়াও গর্ভবতী মহিলারা অকাল গর্ভপাতের সম্মুখীন হতে পারেন।
উপসংহার, Conclusion
কালোজিরা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলে। তাছাড়া নিয়মিত কালোজিরা সেবনে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সতেজ থাকে ও বিভিন্নভাবে আমাদের সুস্থ থাকতে সহায়তা করে। প্রাচীন কাল থেকেই কালোজিরার ব্যবহার হয়ে আসছে একাধিক ক্ষেত্রে। রান্নার মশলার পাশাপাশি কালোজিরার বিশেষ ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে, যার কারণে বহুকাল ধরে বিভিন্ন চিকিৎসায় কালোজিরা ব্যবহার হয়ে আসছে।