রান্না ঘরে সর্বদাই মজুদ থাকা একটি সবজি হল পেঁয়াজ। আমিষ রান্নার ক্ষেত্রে প্রায় সব তরকারিতেই এর ব্যবহার করা হয়। পেঁয়াজে রয়েছে নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান, যা নিয়মিত খেলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। সাথে বৃদ্ধি পায় ক্যান্সার প্রতিরোধের ক্ষমতাও। তাছাড়া পেঁয়াজের ভিটামিন C এবং ক্যালসিয়াম ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। অন্যদিকে হজমশক্তি বৃদ্ধিতেও দারুণ কাজ করে পেঁয়াজ। পাশাপশি চুল, ত্বক ও রক্তের সঠিক চলাচলেও কার্যকর ভূমিকা রাখে এই পেঁয়াজ। বলতে গেলে এর উপকারিতা রয়েছে প্রচুর।
প্রতিদিন একটি করে পেঁয়াজ খেলে কি হয়? What happens if you eat an onion every day?
যাদের বদহজমের মত সমস্যা রয়েছে তারা প্রতিদিন একটু করে কাঁচা পেঁয়াজ খেতে পারেন। কারণ, পেঁয়াজের মধ্যে রয়েছে ফাইবার এবং প্রিবায়োটিক্স হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। পেঁয়াজ খাবার হজমের জন্য বিভিন্ন রকম প্রয়োজনীয় এনজাইম বাড়াতে সাহায্য করে। এর ফলে পেঁয়াজ খেলে দ্রুত খাবার হজম হয়ে যায়।
পেঁয়াজের রস খেলে কি উপকার হয়? What are the benefits of eating onion juice?
পেঁয়াজে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং জিঙ্ক রয়েছে, যা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। তাই পেঁয়াজের রস খেলে আপনার স্বাস্থ্য ভাল থাকে। পেঁয়াজে এমন অনেক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে, যা আপনার মেটাবলিজমের উন্নতিতে সাহায্য করে। আপনি যদি খালি পেটে পেঁয়াজের রস খান করেন তবে তা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
পেঁয়াজের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ, Benefits and Nutritional Properties of Onion :
পেঁয়াজে আছে ভিটামিন B1 (থায়ামিন), B2 (রিবোফ্লাবিন), B3 (নিয়াসিন), B5 (প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড), B6, B9 (ফোলেট) ও ভিটামিন C। পেঁয়াজ শরীরে শক্তি জোগায়, বিভিন্ন ভিটামিনের গুণ দিয়ে দেহকে সাবলীল রাখতে কাজ করে। পেঁয়াজ খেলে হার্টের কার্যক্ষমতা ও কার্ডিভাসকুলার কার্যকারিতা ঠিকঠাক রাখতে সহায়তা করে। বলাই বাহুল্য যে, নানা রোগের প্রতিকার হিসেবে পেঁয়াজ ব্যবহার হয়ে থাকে। সেই রোগগুলো হল :
- সর্দি–জ্বর: জ্বর অনুভব হলে বা সর্দি হলে পেঁয়াজের রস নাক দিয়ে একটু টানলে সর্দি বেরিয়ে যাবে এবং জ্বর ভাবও চলে যাবে।
- হার্টের সমস্যায় কার্যকর : যাদের কার্ডিভাসকুলার জনিত সমস্যা আছে, তাদের প্রতিদিন দুই চা–চামচ পেঁয়াজের রস খাওয়া উচিত, আর নিয়মিত এভাবে খেলে হার্টের সমস্যা হবে না। হার্টের সমস্যা থাকলে প্রতিদিন খাবারের মধ্যে সালাদ খাওয়া উত্তম অভ্যাস, এই সালাদে একটি বড় উপাদান পেঁয়াজ থাকা জরুরি।
- দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়: নিয়মিত পেঁয়াজের রস খাওয়ার ফলে যাদের দৃষ্টির সমস্যা রয়েছে, তাদের সমস্যা ঠিক হয়ে যায়। তবে বয়সজনিত ক্ষীণ দৃষ্টির সমস্যায় পেঁয়াজ কতটা কার্যকরী হবে সেটা বলা কঠিন। তবে পেঁয়াজের রস দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়।
- অ্যাজমার সমস্যায় পেঁয়াজ কার্যকরী: অ্যাজমার সমস্যা যদি থাকে তবে নিয়মিত দুবেলা এক চা–চামচ করে পেঁয়াজের রস খেতে পারেন, এতে অ্যাজমার সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন। রাতে শোবার আগে এক কাপ গরম জলে এক চা–চামচের চার ভাগের এক ভাগ হলুদের গুঁড়া নিয়ে, এক চা–চামচ পেঁয়াজের রস এর সাথে মিশিয়ে খেলে অ্যাজমাজনিত সমস্যার উপশম হয়।
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে: এক টেবিল চামচ পেঁয়াজের রস নিয়ে তাতে সমপরিমাণ গরম জল মিশিয়ে পান করলে পেট পরিষ্কার হবে। দুপুরে সবজি, সালাদে পেঁয়াজসহ খেতে পারলে কোষ্ঠকাঠিন্য কমতে থাকবে এবং পায়ুপথের যেকোনো সমস্যাই সমাধান হতে থাকবে।
- প্রস্রাব হওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি : প্রস্রাব ধারণক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক পেঁয়াজ। অনেক সময় প্রস্রাবের বেগ হলে মনে হয় যেন আর দাঁড়ানো যাবে না, বেসামাল অবস্থা হয়। এ ক্ষেত্রে ১ চা–চামচ পেঁয়াজের রস আধা কাপ জলে মিশিয়ে রাতে শোবার আগে খেতে পারেন। ৪ সপ্তাহ খেলে, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
- নাক থেকে রক্ত পড়লে: গরমকালে অনেক সময় শরীর গরম হয়ে নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। এক্ষেত্রে পেঁয়াজের রস নাকে টানলে রক্ত পড়া বন্ধ হবে।
- অর্শ রোগ প্রতিরোধ করে : অর্শের সমস্যার কারণে রক্ত পড়তে থাকলে বেশিরভাগ মানুষের শরীর দুর্বল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ১ চা–চামচ পেঁয়াজের রস সমপরিমাণ জল মিশিয়ে খেলে এই সমস্যা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে।
- অত্যধিক গরম পড়লে: প্রচণ্ড গরম পড়লে সালাদের সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ খেলে পিপাসা কম লাগবে এবং পথেঘাটে হিটস্ট্রোকের ভয় থাকে না।
- হেঁচকি উঠলে: ১ চা–চামচ পেঁয়াজের রস ২ চা–চামচ জলের মধ্যে মিশিয়ে নিয়ে ২-৩ বার একটু একটু করে খেলে হেঁচকি ওঠা বন্ধ হয়ে যাবে।
- কানে পুঁজ জমলে : অনেক সময় কানে ঘা হয়ে পুঁজ হয়ে যায়; বাচ্চা বা বয়স্ক যেকোনো ব্যক্তির এই সমস্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজের রস একটু গরম করে ২-১ ফোঁটা কানে দিলে ঘা সেরে যায়। আয়ুর্বেদ অনুসারে, এটা কানের জন্য অব্যর্থ ওষুধ।
- বমি বমি ভাব হলে: ৪-৫ ফোঁটা পেঁয়াজের রস ১ কাপ কুসুম গরম জলে মিশিয়ে নিয়ে তা পান করলে বমি ভাবও থাকবে না এবং বমিও বন্ধ হবে।
- বিষফোড়া উঠলে: ফোড়া টন টন করছে, কিন্তু ফাটছে না! এক্ষেত্রে কার্যকরী হতে পারে পেঁয়াজের রস, একটু গরম করে পেঁয়াজের রস ফোড়ায় লাগিয়ে দিলে তা ধীরে ধীরে আপনা আপনি ফেটে যাবে।
- মাথাধরা সারায় পেঁয়াজের রস : সর্দি–জ্বরের কারণে মাথাব্যথা হলে ২-৩ ফোঁটা পেঁয়াজের রস নাক দিয়ে টানলে তৎক্ষণাৎ মাথাধরা এবং ব্যথা কমে যাবে।
- মুখে কোনোও ইনফেকশন: মুখের ভেতর এবং দাঁতের কোনো রোগ ও ইনফেকশন থাকলে প্রতিদিন ১-২টি করে কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। এতে উক্ত সমস্যাগুলো দূর হবে।
কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়ার উপকারিতা কি? What are the benefits of eating raw onions?
পেঁয়াজের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার যা ইমিউনিটি বাড়ায়, হাড় শক্ত করে। এর মধ্যে থাকা ভিটামিন C শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। পেশীর গঠনে সাহায্য করে। পেঁয়াজ কোয়ারসেটিনের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, যা কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে পরিচালিত করে। কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়া রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে, উচ্চ রক্তচাপ কমাতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছাড়া পেঁয়াজের মধ্যে থাকা ভিটামিন বি, বি নাইন, বি সিক্স মেটাবলিজম বাড়ায়। শরীরে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তার থেকেও রক্ষা করে পেঁয়াজ। এতে থাকা উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাই কাঁচা পেঁয়াজ স্বাস্থ্যকর। তবে মুখে দুর্গন্ধ হওয়ায় অনেকে এটি এড়িয়ে চলেন।
ভাতের সাথে কাঁচা পেঁয়াজ খেলে কি হয়? What happens if you eat raw onions with rice?
রোজ ভাতের সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ খেলে যেসব উপকারিতা পাওয়া যায় সেগুলো হল :
- রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ে
- বাতের ব্যথা কমে।
- হাড় মজবুত থাকে।
- স্মৃতিশক্তি বাড়ায়।
- শর্করা মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- ত্বক ভালো রাখে
কাঁচা পেঁয়াজ বেশি খেলে কি হয়? What happens if you eat too much raw onion?
সাধারণত পেঁয়াজ থেকে অ্যালার্জির আশঙ্কা প্রায় থাকে না বললেই চলে। তবে অত্যধিক পরিমাণে কাঁচা পেঁয়াজ খেলে অনেক ক্ষেত্রে দেহে অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন হতে পারে। এই কারণে চুলকানি, ব়্যাশের মতো সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। তাই অত্যধিক পেঁয়াজ খাওয়ার অভ্যাস থাকলে আজই ছেড়ে দিন।
লাল পেঁয়াজ খাওয়া কি ভালো? Is it good to eat red onion?
ফুড রিসার্চ ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্থোসায়ানিন এবং কোয়ার্সেটিন উচ্চ মাত্রার থাকার কারণে সাদা পেঁয়াজের তুলনায় লাল পেঁয়াজ মানুষের ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলতে বেশি কার্যকর।
পেঁয়াজের রস চুলে দিলে কি উপকার হয়? What is the benefit of using onion juice on the hair?
পেঁয়াজের তেল মাথার ত্বকের পিএইচ’য়ের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এতে মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে ও চুলের বৃদ্ধি দ্রুত হয়। চুলের গোড়া শক্ত করতে ও মাথার ত্বক সুস্থ রাখতে উপকারী পিঁয়াজের রস। পিঁয়াজের রসে রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা চুলে ঘনভাব আনে ও উজ্জ্বলতা বাড়ে।
পেঁয়াজের তেল না পেঁয়াজের রস, চুলের জন্য কোনটা ভালো? Onion oil or onion juice, which is better for hair?
পেঁয়াজের রস এবং পেঁয়াজের তেলের মধ্যে পছন্দ করার ব্যাপারটা ব্যক্তিগত পছন্দ এবং জীবনধারার উপর নির্ভর করে। পেঁয়াজের রস ঘরে তৈরি প্রতিকারের জন্য আদর্শ, যখন পেঁয়াজের তেল ব্যস্ত সময়সূচীর জন্য ব্যবহারকারী একটি সহজ সমাধান।
শেষ কথা, Conclusion :
পেঁয়াজ খেয়ে উপকার পেতে হলে কাঁচা খাওয়াই জরুরি, অথবা রস করে খেতে পারেন। আমরা সাধারণত রান্না করা পেঁয়াজ খাই, যা থেকে কিছু উপকার পাওয়া গেলেও ঔষধি গুণের কোনো উপকার পাওয়া যাবে না। তাই প্রতিদিন পেঁয়াজসহ সালাদ খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। এভাবে শরীর সুস্থতা থাকবে, কোনো রোগে আক্রান্ত থাকলে সেটাও নিরাময় হবে।
Frequently Asked Questions
অত্যধিক পরিমাণে কাঁচা পেঁয়াজ খেলে অনেক ক্ষেত্রে দেহে অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন হতে পারে। এই কারণে চুলকানি, ব়্যাশের মতো সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
পেঁয়াজের রস চুলে দিলে মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে ও চুলের বৃদ্ধি দ্রুত হয়।
পেঁয়াজ এর পুষ্টিগুণ আমাদেরকে বিষণ্নতার সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করে এবং ঘুমকে ভালো করতে সহায়তা করে।
ফুড রিসার্চ ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্থোসায়ানিন এবং কোয়ার্সেটিন উচ্চ মাত্রার থাকার কারণে সাদা পেঁয়াজের তুলনায় লাল পেঁয়াজ মানুষের ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলতে বেশি কার্যকর।