ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ ও প্রতিকার, Breast cancer; Symptoms and Treatment in Bengali 

ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ ও প্রতিকার

ক্যান্সার একটি বহুল পরিচিত রোগ। একসময় এই রোগের নাম শুনলেই আতঙ্ক অনুভব হত, কারণ পূর্বের সময়ে এর কোনো সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি, এমনকি সঠিক নির্ণয় প্রক্রিয়াও ছিল না, আর সঠিক সময়ে নির্ণয় এবং চিকিৎসা না করা গেলে ক্যান্সারের প্রকোপ মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।

তবে বর্তমানে ক্যান্সার নির্ণয় প্রক্রিয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। রোগের বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে যদি ক্যান্সার সনাক্ত করা যায় তাহলে চিকিৎসার প্রভাবে রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্যান্সার হতে পারে। স্তন ক্যান্সার তাদের মধ্যে অন্যতম। আজ আমরা স্তন ক্যানসার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

স্তন ক্যানসার কি ? What is breast cancer?

 স্তন ক্যান্সার সাধারণত মহিলাদের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার হওয়া একান্ত অসম্ভব নয়। এই রোগ আমাদের শরীরে অজ্ঞাতে বৃদ্ধি পায়। তবে এমনটা হওয়ার প্রধান কারণ হল এই রোগ সম্বন্ধে আমাদের অসচেতনতা।

প্রায় সব প্রকারের ক্যান্সারের এক সাধারণ বৈশিষ্ট হল আক্রান্তের দেহে কোষের অস্বাভাবিক, অনিয়মিত বৃদ্ধি এবং দ্রুত প্রক্রিয়ায় কোষ বিভাজন হওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্যান্সার-আক্রান্ত কোষগুলো রোগীর শরীরে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পরে। এর প্রভাবে রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এরজন্য অনেকের ক্ষেত্রে স্তন কেটে ফেলে দেওয়া হয় যাতে কোষগুলো আর দেহে ছড়িয়ে না পড়ে।

স্তন ক্যানসার কি

কিভাবে স্তন ক্যান্সার সৃষ্টি হয়? How is breast cancer caused?

মানুষের স্তনে উপস্থিত কোষগুলি যদি হঠাৎ করে স্বাভাবিকতা হারিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে বাড়তে শুরু করে, মূলত তখনই ক্যান্সারের উৎপত্তি হয়। স্তনের বিভিন্ন কোষগুলির মধ্যে যে কোন কোষেই এই রোগ সৃষ্টি হতে পারে। তবে সাধারণত মাতৃ দুগ্ধ উৎপাদনের সাথে যুক্ত কোষেই এই ধরনের ক্যান্সার বেশি দেখা যায়।

তাই এই রোগে মহিলারাই সর্বাধিক আক্রান্ত হন। স্তনের বিভিন্ন কোষগুলির অতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে স্তনের স্বাভাবিক আকার বা আকৃতির পরিবর্তন হয়। স্তনের অভ্যন্তরে কোনো মাংসল পিণ্ড আছে বলে অনুভূত হয়। যদিও এরূপ কোনো পিণ্ডের মতন কিছু স্তনের মধ্যে অনুভব করা মানেই ক্যান্সার বলে ধরা যায় না।

এটি একটি সাধারণ টিউমার হতে পারে। তবে যদি সেটা ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হয় তবে তা সময়ের সাথে মারাত্মক ক্যান্সারের আকার নেয়। আর এই ম্যালিগন্যান্ট স্তন ক্যান্সার আমাদের দেহে থাকা রক্ত এবং লসিকা বাহিকার মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই অবস্থা কে মেটাস্টেসাইজড বলা হয়।

কিভাবে স্তন ক্যান্সার সৃষ্টি হয়?

স্তন ক্যান্সারের প্রকারভেদ কি কি ? Types of breast cancer

Infiltrating (invasive) ductal carcinoma – এই ধরনের স্তন ক্যান্সার এর সূচনা হয় স্তনের দুগ্ধ-নালি তে। সময়ের সাথে সাথে নালির গাত্র ভেদ করে ক্যান্সার কোষ ধীরে ধীরে স্তনের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। 

Ductal carcinomaOpens in a new tab.  – একে প্রি-কান্সারাস পর্যায়ের স্তন ক্যান্সার বলা হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসা করলে রোগ সফল ভাবে নির্মূল করা সম্ভব। 

Infiltrating (invasive) lobular carcinoma – এর উৎপত্তি হয় স্তনের দুগ্ধ উৎপাদক কোষগুলিতে। ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ১০% থেকে ১৫% স্তন ক্যান্সার এই প্রকারের হয়। 

Lobular carcinomaOpens in a new tab. – লবুলার ক্যান্সারে আক্রান্ত মহিলাদেরকে নিয়মিত ম্যামোগ্রাম বা অনুরূপ টেস্ট করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এটিও প্রি-কান্সারাস পর্যায়ভুক্ত হয় এবং এই অবস্থা থেকে ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সারে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।  

Triple negative breast cancer – সাধারণ ভাবে দেখা গেছে যে প্রায় 15% স্তন ক্যান্সার এই প্রকারের হয়। তবে এই ধরনের ক্যান্সারের নির্ণয় এবং সফল চিকিৎসা অত্যন্ত দূরহ। 

স্তন ক্যান্সারের প্রকারভেদ কি কি

এছাড়াও আরো দুই ধরনের স্তন ক্যান্সার রয়েছে, যথা – Inflammatory breast cancer এবং Paget’s disease of the breast; যা প্রধানত স্তনের ত্বকের  উপর প্রভাব বিস্তার করে। 

স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ, symptoms of breast cancer

স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা যায় বিশেষ কিছু লক্ষণের মাধ্যমে, নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো জেনে রাখা উচিত, কারণ প্রথম থেকে সজাগ থাকলে আমরা স্তন ক্যান্সার সহ আরো বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে থাকতে পারি। এই সম্ভব্য লক্ষণ গুলি হল-

  • স্তনের কোন কোন অংশ অস্বাভাবিক রকম ফুলে যাওয়া। 
  • স্তনের মধ্যেকার কোষ বৃদ্ধির ফলে আকার পরিবর্তন হওয়া। 
  • অভ্যন্তরে কোন শক্ত পিণ্ডের অস্তিত্ব অনুভূত হওয়া।
  • স্তন বা স্তন বৃন্ততে ব্যথা অনুভব হওয়া। 
  • স্তনের বোঁটা বা ত্বক হঠাৎ করেই লালচে এবং শুষ্ক হয়ে যাওয়া। 
  • স্তন থেকে স্রাবের মত সাদা তরল বা রক্ত মিশ্রিত তরল বেরিয়ে আসা। 
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ

স্তন ক্যান্সার রোগীর দেহে কত দিনে ছড়ায়, How many days does breast cancer spread in the patient’s body

রোগের ক্ষতিকারক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে স্তন ক্যান্সারকে ৫ টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়, লক্ষ্য করা হয়েছে যে প্রায় প্রতি 6 মাসের মধ্যে স্তন ক্যান্সার এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে বেড়ে উঠতে পারে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ই সতর্ক হওয়ার জন্য স্তনের আকার এবং গঠনের পরিবর্তন খুব ভাল করে পরীক্ষা করা উচিত। এতে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব। পর্যায়গুলো হল :

  • স্টেজ 0 – উক্ত পর্যায়ে স্তনের ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ গুলি তেমন আক্রমণাত্মক হয় না, যার ফলে শরীরের অন্য অংশে বা সারা স্তনে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। 
  • স্টেজ I – এই পর্যায়ে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলো পার্শ্ববর্তী স্বাস্থ্যবান কোষগুলির উপর আক্রমণ করতে শুরু করে।
  • স্টেজ II – সাধারণত ক্যান্সার কোষ এর কারণে সৃষ্ট পিণ্ডের আকার এই পর্যায়ে 2 সেন্টিমিটার এর থেকে ছোট থাকে এবং সময়ের সাথে বৃদ্ধি পেয়ে তা 5 সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। 
  • স্টেজ III – এই পর্যায়ে ক্যান্সার সারা স্তনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই সময় দেহের লসিকা-বাহেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে ফলে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। 
  • স্টেজ IV – এটি হল ক্যান্সারের অন্তিম পর্যায় এবং এক্ষেত্রে রোগীর পক্ষে আর কোনো সফল চিকিৎসার সুযোগ থাকে না। এই পর্যায়ে ক্যান্সার কোষ হাড়, ফুসফুস, লিভার এবং মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, ফলে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দেয়, যায় ফলে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ রোগীর মৃত্যু সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি।

উপরিউক্ত পর্যায়গুলোর মধ্য দিয়েই ক্যান্সার এর মাত্রার বৃদ্ধি ঘটে। তবে সকলের শরীরে ক্যান্সারের বৃদ্ধির হার এক রকম নাও হতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, খাদ্যাভ্যাস তথা জীবনধারার উপর ভিত্তি করেও ক্যান্সার বৃদ্ধির প্রক্রিয়া কম বা বেশি হয়। 

স্তন ক্যান্সারের কারণ কি কি হতে পারে ? Causes of breast cancer

এখন পর্যন্ত স্তন ক্যান্সারের সঠিক কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞান জানতে পারে নি। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশি দেখা গেছে যেসব কারণে সেগুলি হল :  – 

  • জেনেটিক্স বা বংশ-গত কারণ। 
  • নিয়মিত তথা অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান করার ফলে।
  • শরীরে মেদ-বাহুল্যতা 
  • হরমোন থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
নিয়মিত তথা অতিরিক্ত ধূমপান বা মদ্যপান করা

স্তন ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা, Breast cancer diagnosis and treatment

বর্তমান সময়ে স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে বেশ উন্নত পদ্ধতির আবিস্কার করা হয়েছে। সেগুলি হল : 

ম্যামোগ্রাম –

এই পদ্ধতি এক্স-রের সাহায্যে কোনো ব্যক্তির স্তনের আকার এবং গঠনে কোনোও রকম অস্বাভাবিক পরিবর্তন সহজে লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে ভয়ে কিছু নেই কারণ এই প্রক্রিয়া আমাদের দেহে কোনরকম ক্ষত সৃষ্টি করে না এবং এতে প্রাথমিক পর্যায়েই কান্সারের উপস্থিতি ধরা পড়ে।

ম্যামোগ্রাম

আলট্রাসনোগ্রাম –

শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে স্তনের অভ্যন্তরের কোষ সমষ্টির ছবি তোলা যায় এই পদ্ধতিতে, এতে স্তনের আকারের অস্বাভাবিক পরিবর্তন চোখে পড়ে। 

পি-ই-টি স্ক্যান –

এই ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ রঞ্জকের ব্যবহার হয়, যার মাধ্যমে ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষ গুলি রঞ্জিত হয় এবং স্ক্যান হওয়ার সময় এই বিশেষ ভাবে রঞ্জিত কোষগুলি খুব সহজেই ধরা পড়ে। উক্ত পরীক্ষায় ক্যান্সারের বৃদ্ধির হার সহজে বোঝা যায়।

এম-আর-ই –

এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে চুম্বকীয় এবং রেডিও তরঙ্গের সাহায্যে কান্সার-আক্রান্ত কোষ গুলিকে নির্দিষ্ট করা যায়। 

ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে পর্যায় নির্ধারণ করে সেই ভিত্তিতে চিকিৎসা করা হয়, কোষের বৃদ্ধি কতটা দ্রুত বা ধীর গতিতে হচ্ছে সেই হিসাবে ওষুধের মাত্রা ঠিক করা হয়। টিউমার ক্ষতিকর হয়ে ওঠার পূর্বে যদি একে অপারেশনের মাধ্যমে কেটে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে অনেক সময় ঝুঁকি কম হয়ে যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে কোষ সুপ্ত অবস্থায় থাকে বলে সুস্থ হয়ে ওঠার বেশ কিছু বছর পর আবার ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। ক্যানসারের চিকিৎসায় মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কেমো থেরাপি, রে- থেরাপি ইত্যাদি।

স্তন ক্যান্সারের প্রতিকারে করণীয়, How to prevent cancer

স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা কম করার উপায় গুলি হল – 

  • মদ্যপান সীমাবদ্ধ রাখা, অতিরিক্ত মদ্যপান করার কারণে স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • তামাক জাতীয় পদার্থের নেশা বন্ধ করুন। 
  • শরীরের ওজন স্বাস্থ্যকর স্তরে নিয়ন্ত্রিত রাখুন। 
  • নিয়মিত যোগ, ব্যায়াম ও শরীর চর্চার অভ্যাস করার মধ্য দিয়ে শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন। 
  • শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত, এতে স্তন ক্যান্সারের সম্ভবনা হ্রাস পায়। 
  • অনেকে পোস্টমেনোপজাল হরমোন থেরাপি ব্যবহার করেন, তবে তা সীমিত রাখার চেষ্টা করা উচিত।
নিয়মিত যোগ, ব্যায়াম ও শরীর চর্চা
Two women doing yoga class

স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে কি খাবার খাওয়া উচিত? What foods should be eaten when suffering from breast cancer?

স্তন ক্যান্সার বা যেকোনো ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে কিছু খাবার খাওয়া উচিত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য।

  • তাজা শাক-সবজি এবং ফল। 
  • সুষম আহার। 
  • সারাদিনে প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়ার অভ্যাস।
  • ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম সম্পন্ন খাবার খাওয়া। 

উপসংহার, Conclusion 

সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রেই স্তন ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে, তবে যেকোনো বয়সেই এই রোগ হতে পারে। তাই সর্বদা সতর্ক থাকুন এবং নিজের শরীরে স্তন ক্যান্সারএর লক্ষণ গুলি পর্যবেক্ষণ করুন। উপরিউক্ত লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনোও উপসর্গ দীর্ঘ দিনের জন্য (7 থেকে 10 দিন) দেখা দিলে ডাক্তারের সাথে অবশ্যই যোগাযোগ করুন।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts