যেকোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর সেই রোগ সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট বহু সমস্যা দেখা দেয়, যা আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে অনেকটা প্রভাবিত করে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা বুঝতেই পারি না কি রোগ হয়েছে। আবার অনেক সময় নিজেই ঘরে বসে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে থাকি, আমাদের এহেন কাজ সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে।
তাই যেকোনো রোগের নিরাময়ের জন্য এর লক্ষণ বুঝে সময় থাকতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সঠিভাবে চিকিৎসা করা খুব জরুরী। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা ব্রঙ্কাইটিস রোগের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ব্রংকাইটিস কি? What is bronchitis?
শ্বাসনালীর ভিতরে আবৃত ঝিল্লিতে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণকে ব্রংকাইটিস বলে। ব্রংকাইটিস হল ফুসফুসের এমন এক অবস্থা যেখানে সংক্রমণের ফলে শ্বাসনালীর আবরণের ঝিল্লিতে প্রদাহ হয় এবং ফুলে যায়। এক্ষেত্রে ফুসফুসে বাতাস চলাচলের স্থান সরু হওয়ার কারণে শ্বাসপ্রশ্বাসে অসুবিধা সৃস্টি করে। এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর অনবরত কাশি ও ঘন শ্লেষ্মা উঠতে দেখা যায়। ব্রংকাইটিস তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
ব্রঙ্কাইটিসের প্রকারভেদ, different types of bronchitis
ব্রঙ্কাইটিস রোগের প্রভাব দুই রকমের হতে পারে।
১) অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিস : কোনোভাবে ঠান্ডা লাগার কারণে বা অন্য কোনো শ্বাসযন্ত্র জনিত সংক্রমণ এর কারণে অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিস হতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণত রোগীর বিশেষ কোনো সমস্যা হয় না, কারণ এটি খুবই সাধারণ রোগ এবং প্রতিবছর এই রোগে প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হন। রোগের লক্ষণ কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
২) ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস : ব্রঙ্কাইটিস রোগের এই অবস্থাটি খুবই গুরুতর, কারণ ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসে শ্বাসনালীর ঝিল্লির প্রদাহ বারেবারে ফিরে আসে এবং সাধারণত এটি পুরোপুরি সারে না। ধূমপানকেই এরূপ সমস্যা সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসাবে ধরা হয়। চিকিৎসা শাস্ত্রে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসকে “ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ” এর আওতায় ফেলা হয়।
ব্রঙ্কাইটিস রোগের প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি, Main symptoms of bronchitis
আমাদের দেহে প্রকাশ পাওয়া লক্ষণগুলো দেখেই আমরা ধারণা করতে পারি যে আমাদের কি রোগ হয়েছে। ব্রংকাইটিস রোগের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলি সংক্রমণের পর্যায়ের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন হয়। যদিও বেশ কিছু উপসর্গ এমনও আছে যেগুলি তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিসের ক্ষেত্রে সাধারণ থাকে, সেগুলি হল :
ব্রংকাইটিসের ক্ষেত্রে প্রকাশ পাওয়া সাধারণ উপসর্গগুলি:
• বুক শক্ত হয়ে যাওয়া এবং নিঃশ্বাসের কমতি
• হাল্কা জ্বর এবং শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
• কাশির সাথে মিউকাস যেটা পরিষ্কার, সবুজাভ অথবা ফ্যাকাশে হলুদ, এবং কখনও রক্ত মাখা হতে পারে।
তীব্র ব্রংকাইটিসের ক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা যায়:
• হাল্কা-মাত্রার জ্বর
• শরীরে ব্যথা
• কাশি
• কাশির সময়ে বুকে ব্যাথা হওয়া
• শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শীস দেওয়ার মতো শব্দ হওয়া।
তবে এই ধরনের উপসর্গগুলির বেশীরভাগ সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়, তবে কাশি আরো দীর্ঘ হতে পারে। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের ক্ষেত্রে রোগলক্ষণ ৩ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিসের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো হল :
• বারে বারে কাশি হওয়া
• কাশির সমস্যা মৃদু বা খুব খারাপ হতে পারে
• কম করে তিন মাস ধরে কাশি হওয়া
ভাইরাসের কারণে হোক কিংবা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফলে হোক না কেনো, ব্রংকাইটিস রোগ হলে রোগীদের শ্বাসনালী ফুলে যায় ও বুকে অতিরিক্ত পরিমানে কফ উৎপাদন হয়ে যেতে পারে। এর ফলে শ্বাসনালীর ভিতরের পথটি সাধারণত সরু হয়ে যায় যার প্রভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাতাস ফুসফুসে যেতে পারে না, ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়।
ব্রঙ্কাইটিস রোগের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কাদের ক্ষেত্রে বেশি থাকে, Who is more likely to suffer from bronchitis
বিভিন্ন কারণে রোগ ছড়ায়, তাই যেকোনো রোগ যেকোনো ব্যক্তিকে আক্রান্ত করতে পারে। তাও ব্রঙ্কাইটিস রোগের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণত যাদের ক্ষেত্রে বেশি থাকে :
• যেসব ব্যক্তি অতিরিক্ত ধূমপান করেন।
• অ্যাজমা ও অ্যালার্জির সমস্যা থাকলে।
• রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি দুর্বল হয়ে থাকে। অন্য কোনো রোগে দীর্ঘদিন ভুগলে সাধারণত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
• পরিবারে যদি কেউ ফুসফুসের কোনও রোগে আক্রান্ত থাকে।
• সাধারণত পুরুষ ধূমপায়ীদের থেকে মহিলা ধূমপায়ীরা অনেক বেশি সমস্যার মুখে পড়ে থাকেন।
ব্রংকাইটিস রোগ হওয়ার প্রধান কারণগুলি কি কি? Main causes of bronchitis
ব্রংকাইটিস রোগ সৃষ্টির জন্য বিশেষ কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস নয়, বরং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতই ঠান্ডা লাগা এবং ফ্লু সৃষ্টিকারি সাধারণ ভাইরাসগুলো দায়ী। তবে, দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিসের সমস্যার ফলে গ্যাস্ট্রিক রিফ্লাক্স, ফুসফুসে উত্তেজক পদার্থের সৃষ্টি হতে পারে। এগুলো সাধারণত ঘরে বা কাজের জায়গায় ক্ষতিকর রাসায়নিক, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা বা সিগারেট অধিক পরিমাণে খাওয়ার কারণেও হয়।
ব্রংকাইটিস রোগ কিভাবে নির্ণয় করা হয় ? How is bronchitis diagnosed?
যেকোনো রোগের সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার পূর্বে রোগ নির্ণয় সঠিকভাবে হওয়া খুব জরুরী। রোগ সৃষ্টির কারণ এবং রোগের সংক্রমণ কতটা হয়েছে এর উপর ভিত্তি করেই সঠিক চিকিৎসা সম্ভব। বিশেষত প্রারম্ভিক পর্যায়ে, ব্রংকাইটিসকে সাধারণ ঠান্ডা লাগার ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো থেকে আলাদা করা মুশকিল হতে পারে। তবে বিভিন্ন লক্ষণের উপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করতে চিকিৎসকরা সচরাচর নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলি করানোর পরামর্শ দেন :
• অ্যালার্জি বা অন্যান্য রোগের নির্ণয়ের জন্য থুতুর পরীক্ষা।
• পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণয়।
• স্পিরোমিটার নামক এক যন্ত্রের সাহায্যে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নির্ণয়।
• কফ পরীক্ষা
• নিউমোনিয়া বা এই ধরনের অন্যান্য সমস্যাগুলির যা ফুসফুসের সমস্যা বোঝায় তা নির্ণয় করতে বুকের এক্স-রে করা হয়।
• ধূমপানকারীদের ক্ষেত্রে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা এবং এম্ফিসেমা ও অ্যাজমার লক্ষণ থাকলে, সেইক্ষেত্রে পালমোনারী ফাংশন টেস্ট ধার্য করা হয়।
ব্রংকাইটিস রোগের চিকিৎসা কিভাবে করা হয়? Treatment of bronchitis
কোনো রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারলে উপযুক্ত চিকিৎসা সম্ভব; একথা আমরা সকলেই জানি। রোগের অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসকরা চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু করেন। বেশীরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, তীব্র ব্রংকাইটিস সৃষ্টিতে ভাইরাস দায়ী হয়, তাই এই রোগ নিরাময়ে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় না।
একিউট ব্রঙ্কাইটিসের ক্ষেত্রে প্রায়শই, দুই দিনের মধ্যেই রোগটি নিজের থেকেই ঠিক হয়ে যেতে শুরু করে। তবে রোগীর বিভিন্ন সমস্যা অনুযায়ী সাধারণত চিকিৎসকেরা ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে কাশির সিরাপ খাওয়ার পরামর্শ দেন এবং বুকের জ্বালা কম করবার জন্য ও কম হওয়া শ্বাসপ্রশ্বাস চলাচল স্বাভাবিক করে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত কিছু ওষুধ দেন।
অনেকের ক্ষেত্রে বুকে অতিরিক্ত কফ জমা হয়ে গেলে, সেই কফকে সহজ ভাবে বের করার জন্য যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যাদের আগে থেকে অ্যাজমা বা ফুসফুসের অন্যান্য কোনো অসুখ থাকে তাদের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়।
তাছাড়া রোগ নিরাময়ে শ্বাসের ব্যায়াম, অক্সিজেন থেরাপি, ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ, তরল পদার্থ বেশী করে খাওয়ার পরামর্শ এবং বাষ্প অন্তঃশ্বসন হল অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এগুলি ব্রংকাইটিস সহ ফুসফুসের অন্য রোগের উপসর্গগুলিকেও উপশম করতে সাহায্য করে।
ব্রংকাইটিস রোগীদের জন্য কিছু সতর্কতা, Some precautions for bronchitis patients
ব্রঙ্কাইটিস রোগীদের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। সেই সতর্কতাগুলি হল:
• যখন বাড়ি থেকে বাইরে কোথাও যাওয়া হয় তখন মাস্ক ব্যবহার করুন।
• হিউমিডিফাইয়ার ইনডোরস্ ব্যবহার করা উচিত।
• দূষক ও উত্তেজক পদার্থগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
• বারবার ব্রংকাইটিস হওয়ার প্রবণতা আটকাতে ফ্লুয়ের টীকা নিয়ে নিতে পারেন, তবে সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নেওয়া শ্রেয়।
• ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। তাছাড়া কেউ ধূমপান করলে সেই জায়গা থেকেই দূরে সরে যাওয়া উচিত।
ব্রঙ্কাইটিস রোগীদের আরাম পাওয়ার কিছু উপায়, Ways to get relief for bronchitis patients are:
ব্রঙ্কাইটিস এর ক্ষেত্রে আরাম পাওয়ার জন্য রোগীরা যা যা করতে পারেন, সেগুলি হল—
• রোজ দু’বার গরম জলে আদা ফুটিয়ে গার্গল করুন।
• স্নানের সময় গরম জলের ব্যবহার করুন।
• ফুটন্ত গরম জলে ভিক্স বা সেই জাতীয় কিছু মিশিয়ে ভাপ নিন।
• রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এমন খাবার গ্রহণ করুন।
শেষ কথা, Conclusion
আমরা প্রায়ই কোনো না কোনো রোগে ভুগি, সেটা বড় রকমের কোনো সমস্যা হোক কিংবা ছোটো, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার প্রভাবে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু রোগের লক্ষণগুলো জেনে রাখলে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া যায়। আশা করি আজকের এই প্রতিবেদন পড়ে আপনারা ব্রঙ্কাইটিস রোগ সম্পর্কে জরুরী সকল তথ্য জানতে পেরেছেন।