শরীরের অন্যান্য বিভিন্ন রোগের মতই মনের এক রোগ হল ডিপ্রেশন। অবসন্ন মন, উৎসাহহীনতার অনুভূতি ও শক্তিহীনতা যদি কোনো ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে তবে বুঝে নিতে হবে যে তিনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন। অন্যান্য রোগের মতই ডিপ্রেশনেরও চিকিৎসা সম্ভব। বিভিন্ন লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা ডিপ্রেশন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা কি ? What is depression?
দিনের পর দিন সারা বিশ্বে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা এক ভয়াবহ ব্যাধি হয়ে উঠছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন লোক বিষন্নতায় ভুগছে যা ক্রমশ তাদেরকে অক্ষমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও দিন দিন বিষন্নতায় ভোগা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু দু:খজনক বিষয় হলো এই যে, বিষন্নতাকে একটা রোগ বলে কেউ মনে করে না, একে যেন কেউ রোগ বলে স্বীকার করতে চায় না।
তবে এটা আমাদের সকলেরই জানা থাকা উচিত ডিপ্রেশন এক ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি। যারা এই রোগে ভুগছেন তারা কোন কিছুতে উৎসাহ পান না, ঠিকমত কারো সাথে কথা বলেন না, কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না, আবার অনেক ক্ষেত্রে সারাদিন কান্নাকাটি করেন। নিজের স্বাভাবিক আচরণে পরিবর্তন আসলেও প্রথমে কেউই বুঝতে পারেন না। তাই এই রোগের লক্ষণ জেনে রাখা উচিত।
ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা কেন হয় ? What are the causes of depression?
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে যে এই সমস্যাটি কেন হয়? ডিপ্রেশন একটি জটিল রোগ। এই সমস্যা সৃষ্টির কারণ নির্দিষ্ট করে কারো পক্ষেই তা বলা সম্ভব না। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই কিছু সাধারণ কারণ থাকে যার জন্য এ রোগের উৎপত্তি হতে পারে। সেগুলি হল :
১. অনেক সময় মানসিক বা শারীরিকভাবে অবমাননার স্বীকার হলে অনেকে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে।
২. একাকীত্ব বোধ হওয়ার কারণে বিষন্নতা দেখা দিতে পারে। বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব বা অন্যান্য কাছের মানুষদের সাথে সম্পর্কহীনতা বা মতবিরোধ থেকেও অনেকে বিষন্নতার স্বীকার হয়।
৩. খুব কাছের কোনো মানুষের মৃত্যু অনেকের ক্ষেত্রে বিষন্নতার ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
৪. জীবনে হঠাৎ কোনো বড় কোন পরিবর্তন ঘটলে তা থেকে বিষন্নতা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন চাকরি হারালে, দীর্ঘ সময় ধরে ব্যস্ত সময়সীমা কাটিয়ে অবসরে গেলে, হঠাৎ করে আয় কমে গেলে, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে।
৫. দীর্ঘদিন ধরে নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনের ফলেও অনেকে বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যেমন, ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত আইসোট্রেটিনিয়ন বা অ্যান্টিভাইরাল ‘ইন্টারফেরন-আলফা’ জাতীয় ঔষধ সেবনে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
উপরিউক্ত কারণগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যায় প্রভাবে মানুষ বিষন্নতায় ভুগে থাকে। ব্যক্তিভেদে বিষন্নতার কারণেও বহু পার্থক্য দেখা যায়।
বিষন্নতার লক্ষণগুলো কি? Symptoms of depression
কীভাবে বুঝবেন যে আপনি ডিপ্রেশন বা বিষন্নতায় ভুগছেন?
১. কাজের প্রতি অনীহা
নিজের শখের কাজগুলো করার ক্ষেত্রেও আপনি ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকতে ইচ্ছে হবে। কোন কাজেই উৎসাহ পাবেন না।
২. ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে রোগীর খাদ্যাভাসে পরিবর্তন দেখা যায়।
হয় রোগী স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাবেন, নয়তো তার খাবারে অরুচি দেখা দেবে, এ ফলে ওজন দ্রুতগতিতে বাড়বে বা কমতে থাকবে যা শরীরে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।
৩. দীর্ঘ সময় ধরে অনিদ্রা বিষন্নতার একটি লক্ষণ।
যেসব রোগীর দীর্ঘকালীন অনিদ্রাজনিত সমস্যা রয়েছে তাদের বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৪. বিষন্নতায় আক্রান্ত হলে অবসাদ গ্রাস করবে আপনাকে।
তাই যখন আপনি অবসাদগ্রস্থ হয়ে কোন কিছুতেই উৎসাহ পাবেন না তখন বুঝবেন আপনি ডিপ্রেশনের শিকার।
৫. বিষন্নতার কারণে আপনি নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে থাকবেন।
পরিবার ও বন্ধুবান্ধব, কারও সঙ্গ ভালো লাগবে না। এমন অবস্থায় সামাজিকতা অনেক সময় অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। একাকীত্ব আপনাকে ঘিরে ফেলবে ফলে অসুস্থতা আরো বাড়িয়ে তুলবে।
৬. সবকিছুতেই মনোযোগের অভাব বিষন্নতার ফলে কোন কিছুতেই ঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে পারবেন না।
একটা ঘোরের মধ্যে থাকবেন বেশিরভাগ সময়, অন্যদের কথা মন দিয়ে শুনতে পারবেন না।
৭. সবকিছু নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি।
ডিপ্রেশনে থাকলে দুঃখবোধ, আশাহীনতা ও হতাশা আপনাকে ঘিরে ফেলবে, তখন সবকিছুতেই নেতিবাচক মনোভাব দেখা দেবে।
৮. নিয়মিত মাথা ব্যথা ও হজমে সমস্যা হলে সেটা ডিপ্রেশনের লক্ষণও হতে পারে।
ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় বিভিন্ন থেরাপির ব্যবহার, The use of various therapies in the treatment of depression
লক্ষণের উপর ভিত্তি করে ডিপ্রেশন দূর করার জন্য বিভিন্ন থেরাপির ব্যবহার করা হয়, সেগুলি হল :
ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় সাইকোথেরাপির ব্যবহার :
উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় একজন দক্ষ থেরাপিস্টের কাছে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত রোগী নিজের মানসিক অবস্থার কথা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য করণীয় বিষয়ে জানতে পারেন। সাইকোথেরাপি বা মনোচিকিৎসাকে ‘কথা চিকিৎসা’ বলা হয়।
তবে সাইকোথেরাপির কয়েকটি ধরন রয়েছে, একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক ধরনের সাইকোথেরাপি কার্যকরী ভূমিকা রাখে:
১। সিবিটি বা জ্ঞানভিত্তিক আচরণীয় থেরাপি :
এই থেরাপির ক্ষেত্রে একজন থেরাপিস্ট রোগীর ব্যবহার, আচরণ এবং নিজের প্রতি বিশ্বাসে খারাপ প্রভাব ফেলছে এমন সব চিন্তাধারাগুলো খুঁজে বের করবেন। এরপর থেরাপিস্ট ধীরে ধীরে রোগীর নেতিবাচক ধারণাগুলোকে ইতিবাচক ধারণায় রূপান্তর করার চেষ্টা করবেন।
২। সাইকোডাইনামিক থেরাপি :
এক্ষেত্রে রোগীর অতীত থেকে শুরু করে বর্তমান জীবন এর সময় অবধি পুরো ইতিহাসটাই থেরাপিস্ট অনুসন্ধান করবেন, রোগীর সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে দিনের পর দিন কীভাবে একজন রোগীর মনে বিভিন্ন চিন্তাধারার পরিবর্তন হয়েছে, সেই সব কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। উক্ত সকল তথ্য জানার মধ্য দিতে থেরাপিস্ট রোগীকে ডিপ্রেশন থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করতে পারবেন।
৩। ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ইসিটি) বা শক থেরাপি
যদি কারো ডিপ্রেশন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাদের চিকিৎসায় ইসিটি পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়। উক্ত থেরাপিতে রোগীর মস্তিষ্কের কোষগুলোকে উজ্জীবিত করে সেগুলোর কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে ব্যক্তির কপালে খুব অল্প এবং নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে রোগীকে অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয় যেন তিনি পদ্ধতির কোনোকিছু টের না পান। উক্ত প্রক্রিয়াটির জন্য প্রায় ৫-১০ মিনিট এর মত সময় লাগে। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখা ভালো যে, এই থেরাপি গ্রহণ করলে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, পেশি ব্যথা ও ক্ষত, বিভ্রান্তি ইত্যাদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হতে পারে।
৫। মেডিটেশন থেরাপি
সাধারণত বেশিরভাগ ব্যক্তির ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বাড়ায় দৈনন্দিন কাজের চাপ, ভয়, রাগ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে মেডিটেশনের সাহায্য নিয়ে এসব অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পিইউবি মেড সেন্ট্রালের গবেষণা অনুযায়ী, মেডিটেশন মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলোকে কম করে আনতে সাহায্য করে।
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে কি কি করবেন, what you’ll you do to get rid of depression?
ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির জন্য সাধারণ কিছু সতর্কতা :
- রুটিনমাফিক চলাফেরা করতে হবে : ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে চাইলে জীবনকে একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। নিত্যদিনের কাজ-কর্মকে একটা নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলা হলে ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে।
- নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা : কোনো কিছু করতে গেলে প্রথমে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। ডিপ্রেশনে থাকলে যেহেতু কোন কাজ করতে ইচ্ছা হয় না, কিছু ভালো লাগে না, তাই প্রতিদিন একটু একটু করে কিছু না কিছু কাজ করার উদ্দেশ্যে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
- নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত : প্রতিদিন অল্প কিছু সময় ব্যায়াম নিয়ম করে করলে আপনার শরীর এবং মনকে সুস্থ রাখবে।
- সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত : ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে হলে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। রোগ খাবারে যেন প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেসব খাবারে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এ্যাসিড এবং ফলিক এসিড থাকে সেগুলো ডিপ্রেশন কম করতে সহায়তা করে।
- পর্যাপ্ত ঘুম : পর্যাপ্ত ঘুম ডিপ্রেশন কম করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ডিপ্রেশনের রোগীদের সাধারণত নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়। তাই, ঘুম সমস্যার সমাধান করতে হবে।
- সর্বদা ইতিবাচক চিন্তা করার চেষ্টা করুন : ডিপ্রেশনে ভুগলে সাধারণত মানুষের মনে বিভিন্ন রকম নেতিবাচক চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু রোগীরা এটা বুঝতে পারেন না যে এই চিন্তাগুলোই সুস্থ হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে ওঠে। তাই, এই চিন্তাগুলোকে মন থেকে সরিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করার চেষ্টা করতে হবে।
- আনন্দদায়ক কাজ ও পছন্দের মানুষের সাথে সময় কাটানো : নতুন কোনো মজার কাজ করার চেষ্টা করুন। যেমন, নতুন কোথাও ঘুরতে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, মজার কোন বই পড়া। এক কথায় মন ভালো রাখার মত সম্ভব সব চেষ্টা করতে হবে, কারণ মন ভালো থাকলে ডিপ্রেশন খুব সহজেই দূর হয়ে যাবে।
শেষ কথা, Conclusion
ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা শুধুমাত্র একটি মানসিক ব্যাধি নয় এটি আপনার শরীর, সামাজিক অবস্থান এবং সবকিছু ওলটপালট করে দিতে পারে। ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির জন্য নিজের প্রতিদিনের কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া, জীবনপ্রণালী এমনকি চিন্তা-ভাবনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। শারীরিক ও মনসিকভাবে নিজের খেয়াল রাখুন। তবেই যেকোনো রোগ থেকে দূরে থাকা সহজ হবে।