কনজাঙ্কটিভাইটিস রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত, A detailed study of conjunctivitis in Bengali 

কনজাঙ্কটিভাইটিস রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত

কনজাঙ্কটিভাইটিস রোগটি আমাদের মধ্যে ‘চোখ ওঠা’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এটির আরেক নাম “জয় বাংলা রোগ”। এইরূপ নাম দেওয়ার নেপথ্যে এক কাহিনী রয়েছে। ১৯৭১ সালে এই রোগ মহামারী আকারে পশ্চিম বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। রোগটি পূর্ব বাংলায় চলা মুক্তিযুদ্ধের কারণ বশত সীমান্ত পার হয়ে চলে আসা বহু বাঙালি শরণার্থীদের কারণেই ছড়িয়েছিলো বলে অনেকের ধারণা। তাই এর নাম দেয়া হয় ‘জয় বাংলা’ রোগ! 

কনজাঙ্কটিভাইটিস কি ? what is conjunctivitis?

কনজাঙ্কটিভাইটিস হল আমাদের চোখের মধ্যে অবস্থিত কনজাঙ্কটিভার প্রদাহ বা ব্যথাজনিত সমস্যা, এটি আমাদের চোখের পাতার নিচে থাকা ঝিল্লির মতো পাতলা পর্দা যা চোখের সাদা অংশকে এবং চক্ষুপল্লবের ভিতরের ভাগকে ঢেকে সুরক্ষিত রাখে। কনজাঙ্কটিভাইটিস মূলত ছোটো বাচ্চাদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়, তবে এটি যেকোনো বয়সের ব্যক্তির হতে পারে। 

কনজাঙ্কটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি, Main symptoms of conjunctivitis 

 কনজাঙ্কটিভাইটিস রোগের ক্ষেত্রে যে উপসর্গগুলি সাধারণত দেখা যায়, সেগুলি হল:

• সংক্রমিত চোখের সাদা অংশটি গোলাপি বা লালচে হয়ে ওঠা।

• চোখ দিয়ে ক্রমাগত জল পড়তে থাকা।

• চোখে জ্বালা অনুভব হওয়া 

•  চুলকানি ভাব এবং অস্বস্তি বোধ হওয়া।

• চোখে অতিরিক্ত পরিমাণে পিঁচুটি আসা।

কনজাঙ্কটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগের প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি

• চোখের পাতা লালচে হয়ে ফুলে ওঠা এবং কনজাঙ্কটিভা ফুলে ওঠা।

• চোখে হঠাৎ হঠাৎ ঝাপসা দেখা।

• সারাক্ষণ ধরে চোখের ভিতরে যেন কিছু একটা রয়েছে বলে অনুভব হওয়া।

• আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা অনুভব হয়।

• সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় চোখের পাতায় চটচটে পদার্থ লেগে থাকা যার কারণে চোখের পাতাগুলো আলাদা করতে অসুবিধা হতে পারে।

কনজাঙ্কটিভাইটিস রোগ সৃষ্টির প্রধান কারণগুলি, Causes of conjunctivitis

কনজাঙ্কটিভাইটিস বা চোখ ওঠার নেপথ্যে কি কি কারণ রয়েছে তা জানতে পারলে আমরা অবশ্যই এই রোগ প্রতিরোধ করতে পারবো। সাধারণত এই সমস্যার মূল কারণই হলো সংক্রমণ, অ্যালার্জি ও পরিবেশ দূষণ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন পদার্থগুলি। তবে চোখের এই সংক্রমণের পেছনে দায়ী হল কিছু ব্যাকটেরিয়া। সাধারণত স্ট্যাফাইলোকক্কাসOpens in a new tab., ক্ল্যামাইডিয়া ও গোনোকক্কাসের মতো ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাসের কারণে কনজাঙ্কটিভাইটিস সংক্রমণ হয়। 

কনজাঙ্কটিভাইটিস রোগ সৃষ্টির প্রধান কারণগুলি

কনজাঙ্কটিভাইটিস সংক্রমণ কিভাবে ছড়ায় ? How does conjunctivitis infection spread?

কনজাঙ্কটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগের সংক্রমণ আক্রান্তের চোখের দিকে তাকালেই ছড়াতে পারে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু এমন হয় না। এর সংক্রমণ সাধারণত পোকার মাধ্যমে, বা সংক্রমিত ব্যক্তির চোখের জন্য ব্যবহার করা কোনো বস্তু থেকে, আবার আক্রান্তের দ্বারা সংক্রমিত কসমেটিক বা প্রসাধনী দ্রব্য থেকেও অন্যদের মধ্যে ছড়াতে পারে। আরো যেসব কারণ থাকতে পারে এই সংক্রমণের পেছনে, সেগুলি হল :

•  বাতাসের মাধ্যমে কখনো চোখে ফুলের রেণু, ধূলো কণা, পশুপাখির লোম/পালক ইত্যাদি দীর্ঘক্ষণ ধরে চোখের ভেতরে থাকার কারণে এরূপ সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

•  শক্ত বা নরম কন্ট্যাক্ট লেন্স একনাগাড়ে বেশিক্ষণ ধরে ব্যবহার করলে চোখের অ্যালার্জি জনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়, এর থেকেও কনজাংটিভায় সংক্রমণ হয়।

• সাধারণত পরিবেশের দূষক পদার্থ যেমন ধোঁয়া, বাষ্প, প্রভৃতি বা সুইমিং পুলের জলে থাকা ক্লোরিন ও বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবেও সংক্রমণ হতে পারে।

• চোখে ভাইরাসের কারণে প্রদাহ সৃষ্টি হলে চোখের জলেই ভাইরাসগুলো ভেসে বেড়ায়। যখন এই অশ্রু কেউ মুছতে যায় তখনই এটি আমাদের হাতে এসে যায়। এরপর সেই হাত দিয়েই আমরা যা কিছুই ছুঁই না কেন, সেই বস্তুগুলিতে ভাইরাস চলে আসে। সেই বস্তু অন্যরা ব্যবহার করলে তাদেরও সংক্রমণ হতে পারে।

কনজাঙ্কটিভাইটিস সংক্রমণ কিভাবে ছড়ায়

কিভাবে কনজাঙ্কটিভাইটিস নির্ণয় করা হয়? How to detect conjunctivitis?

উপসর্গ তথা লক্ষণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতিতে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্তে আসেন যে রোগীর কনজাঙ্কটিভাইটিস হয়েছে কি না। এক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া হয় সেগুলি হল : 

• সংক্রমণের কারণে দেখার অসুবিধা হচ্ছে কি না, ডাক্তার তা পরীক্ষা করে দেখেন।

• চোখের কনজাঙ্কটিভার অবস্থা কেমন, চোখের বাহ্যিক টিস্যু বা কলা ও চোখের ভিতরকার গঠনও খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন চিকিৎসকরা। 

• সাধারণত, এই চোখ ওঠা রোগের সমস্যাগুলো প্রায় চার সপ্তাহ ধরে স্থায়ী হয়।

• সমস্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা চিকিৎসায় সাড়া না মেলে, এক কথায় সংক্রমণ প্রশমিত বা হলে তখন  সোয়াব টেস্ট অর্থাৎ চোখের পিঁচুটির নমুনা/ চোখের নির্গত বর্জ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়।

• এলার্জিক কনজেক্টিভাইটিস এর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অ্যালার্জেনগুলি খুঁজে বের করার জন্য, অ্যালার্জি পরীক্ষা করা যেতে পারে।

কিভাবে কনজাঙ্কটিভাইটিস নির্ণয় করা হয়

কিভাবে কনজাঙ্কটিভাইটিসের চিকিৎসা করা হয় ? Conjunctivitis treatment 

চোখের যেকোনো সমস্যার ক্ষেত্রে একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। রোগীর চোখের সংক্রমণ, রোগের পূর্বেকার ইতিহাস, লক্ষণ, উপসর্গ, ইত্যাদি অনুসারে সঠিকভাবে চক্ষু পরীক্ষার মাধ্যমে, চিকিৎসক কিভাবে চিকিৎসা করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত নেন। সাধারণত কনজাঙ্কটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগের ক্ষেত্রে সংক্রমণের কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। 

• ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ দেওয়া হয়। 

• ভাইরাস-ঘটিত সংক্রমণ হলে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসায় একটু বেশি সময় লাগে। তখন যন্ত্রণা কম করার জন্য গরম সেঁক দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। 

•  অ্যালার্জি ঘটিত কনজাঙ্কটিভাইটিসের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সাধারণত অ্যান্টিহিস্টামিনস ও আই ড্রপ দিয়ে থাকেন।

• চোখে ব্যাথা হলে চিকিৎসকরা আই অয়েন্টমেন্ট ব্যবহার করার পরামর্শ দিতে পারেন।

কনজাঙ্কটিভাইটিসের চিকিৎসা

পরিবারের অন্য সদস্যদের সংক্রমিত হওয়া থেকে বাঁচানোর উপায়, Precaution to be taken against conjunctivitis 

আপনার বা আপনার বাড়ির কোনো সদস্যদের কারও যদি কনজাঙ্কটিভাইটিস হয়, তাহলে নিম্নোক্ত উপায়গুলি দ্বারা আপনি সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে অন্যদেরকে সংক্রমণ এর থেকে বাঁচাতে পারেন :

• আক্রান্ত ব্যক্তিকে সংক্রমিত চোখ/চোখ দুটি বার বার না ছোঁয়ার পরামর্শ দিন।

• আক্রান্ত ব্যক্তির কিছুক্ষণ পর পর হাত ভালো করে ধুয়ে নেওয়া দরকার।

• আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের তোয়ালে ও প্রসাধনী দ্রব্য অন্য কাউকে যেন ব্যবহার করতে না দেয়। 

• কনজাঙ্কটিভাইটিসের সময়ে কন্ট্যাক্ট লেন্সের ব্যবহার পুরোপরি বন্ধ রাখা প্রয়োজন।

• যাদের চোখ উঠেছে তাদের একটি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঠান্ডা জল দিয়ে চোখে সেঁক দিলে আরাম লাগবে।

• সংক্রমণ এক চোখে হলে চোখ মুছতে গিয়ে দুই চোখের জন্য ভিন্ন তোয়ালে ব্যবহার করা উচিত।

• ধুলাবালি, আগুন-আলো-রোদে কম যাওয়া।

• ময়লা-আবর্জনাযুক্ত স্যাতসেঁতে জায়গায় না যাওয়া।

• বাড়িতে এবং বাইরে যাওয়ার সময় চোখে কালো চশমা ব্যবহার করা।

• সংক্রমিত রোগীদের থেকে অন্যদের দূরত্ব বজায় রাখা উচিত।

• টেলিভিশন না দেখা এবং মোবাইলের ব্যবহার বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া না করা।

• হাত না ধুয়ে যখন-তখন চোখ ঘষা বা চুলকানো যাবে না।

পরিবারের অন্য সদস্যদের সংক্রমিত হওয়া থেকে বাঁচানোর উপায়

উপসংহার, Conclusion 

চোখের কষ্ট কখনোই উপেক্ষা করবেন না। সেটা কম হোক কিংবা বেশি, কারণ চোখ আমাদের দেহের একটি সংবেদনশীল অংশ। তাই এর সঠিক খেয়াল রাখা খুব জরুরি। বিশেষ করে একটা কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে চোখ আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারণ এটি ছাড়া আমরা কিছুই দেখতে পারি না ফলে চোখের ছোটো বড় য়ে  কোনো সমস্যাকেই এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। প্রয়োজনে চোখের সাপ্তাহিক চেক আপ করানো উচিত। এভাবে আপনি নিজের চোখের সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে পারবেন এবং চোখকে সুস্থ রাখতে পারেন।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts