ফাস্টফুড সকলের প্রিয়, তাই সবাই কম বেশি ফাস্ট ফুড খায়। তেলে ভাজা খাবার খেতে সকলেরই পছন্দ, সুস্বাদু খাবার বলেই এর এত চাহিদা। কিন্তু এটি আমাদের কতটা ক্ষতি করে আমরা তা খাবার সময় যেন মনেই রাখতে পারি না। এছাড়াও যেকোনো চর্বিযুক্ত খাবার আমাদের হৃদপিণ্ডের সুস্থতার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টিকারী ভূমিকা পালন করে।
আমাদের অজান্তেই রক্তনালীতে কোলেস্টেরল জমা হয়ে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্ট করে, আর এইসব হচ্ছে তৈলাক্ত তথা চর্বিযুক্ত খাবারের প্রভাবে; ফলে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। তবে ধমনীর রক্তপ্রবাহে সৃষ্ট বাধা দূর করতে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির মত চিকিৎসা পদ্ধতি রোগীকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়। আজ এই প্রতিবেদনে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আলোচনা করবো।
করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি কি ? What is coronary angioplasty?
করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি মূলত হৃদপিণ্ডের সুস্থতার জন্য ব্যবহৃত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি হল সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া (স্টেনোটিক) করোনারি আর্টারির চিকিৎসার একটি থেরাপটিক পদ্ধতি।
করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির উদ্দেশ্য কী? What is the main aim of coronary angioplasty?
করোনারি ধমনীতে কোনো কারণে ফ্যাট জমা হলে বা অনেক সময় এক বা একাধিক ধমনীতে বাধা সৃষ্টি হলে তখন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি প্রয়োজন হয়। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি সেই বাধা পড়া করোনারি ধমনীটি খুলে দিয়ে হার্টের ক্ষতি কম করতে সাহায্য করে।
হার্টের অবস্থার ভিত্তি তে করোনারি এনজিওপ্লাস্টি, Coronary angioplasty based on heart condition
হার্টের কোন কোন অবস্থার ভিত্তি তে করোনারি এনজিওপ্লাস্টি সুপারিশ করা হয়:
- অস্থির অ্যাজিনা (অ্যাজিনা হলো এক ধরণের কার্ডিয়াক বুকে ব্যথা)
- এনএসটিেমি (নন-এসটি এলিভেশন মায়োকার্ডিয়াল ইনফারশন হলো একটি নরমাল ধরণের হার্ট অ্যাটাক)
- স্টেমি (এসটি-এলিভেশন মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন- এক ধরণের হার্ট অ্যাটাক যা আরও তীব্র হয়)।
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির প্রস্তুতি, Preparation for angioplasty
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার পূর্বে রোগীর নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষা করা হয়। সেগুলি হলো :
- সিবিসি (সম্পূর্ণ রক্ত পরীক্ষা),
- ইসিজি (ইলেক্ট্রো কার্ডিওগ্রাফি),
- লিভার ফাংশন টেস্ট,
- কিডনি ফাংশন টেস্ট
- অ্যানেশেসিয়া ট্রায়াল।
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি কিভাবে করা হয়? How is angioplasty done?
প্রথমে অ্যানেস্থিসিয়া দিয়ে সন্নিবেশের স্থানটি অজ্ঞান করে দেওয়ার পরে, রোগীর বাহুতে বা পায়ের ধমনীতে একটি ক্যাথেটার একটি শিটের সাহায্যে ঢোকানো হয়। রোগীর করোনারি ধমনীটির দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চলগুলির আরও ভাল ধারণা পেতে কনট্রাস্ট ডাইয়ের সাথে ইনজেক্ট করা হয়। এছাড়াও একটি বিশেষ ক্যামেরা ব্যবহার করা হয় রোগীর করোনারি ধমনী এবং হৃৎপিণ্ডের অভ্যন্তরের সমস্যার ক্ষেত্রগুলি খুঁজে পাওয়ার জন্য।
ক্যাথিটারের গতিপথ এক্স-রে গাইডেড ভিডিও দ্বারা লক্ষ্য করা হয়। ক্যাথিটার ধমনীর বাধা পড়া জায়গায় পৌঁছে দিয়ে, সেটা থেকে একটা বেলুন আক্রান্ত স্থানে পৌঁছে দিতে ব্লক হয়ে যাওয়া অংশটাকে চওড়া করার জন্য বেলুনটিকে ফুলিয়ে দেওয়া হয়। এই ডিফ্ল্যাটেড বেলুনটিকে বের করে আনার সময় ধমনীর ভিতরে লেগে থাকা ফ্যাট সরে যায়, ফলে রক্ত বাঁধাহীন ভাবে ধমনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।
স্ফীত বেলুনের সাহায্যে কার্ডিওলজিস্ট ক্যথেটারের সাইটে স্টেন্ট ফিট করে দেন, যাতে রক্ত সহজেই হৃদয়ের পেশীগুলিতে প্রবাহিত হয়। স্টেন্ট লাগানোর পর বেলুনটি অপসারণ করে ফেলা হয়। কিছু স্টেন্টে ওষুধ থাকে এবং ধমনীতে ব্লক হওয়ার ঝুঁকি কমানোর জন্যই এটি ডিজাইন করা হয়।
স্টেন্ট কি ? What is a stent?
আপনারা হয়তো ভাবছেন উল্লেখিত সেন্টটি আসলে কি ! এটি হল ধাতু, ফ্যাব্রিক, সিলিকন বা বিভিন্ন পদার্থের মিশ্রনের দ্বারা তৈরী করা সরু টিউবের মত একপ্রকার জালক। সাধারনত করোনারি আর্টারিতে ধাতব স্টেন্ট বসানো হয়, বড় ধমনীতে (যেমন অ্যাওর্টাতে) ফ্যাব্রিক এবং শ্বাসনালীতে বসানো হয় সিলিকনের স্টেন্ট।
তবে স্টেইনলেস স্টীল দিয়ে তৈরী স্টেন্টই সব থেকে ভাল। এর কারণ হল স্টেইনলেস স্টীলের তৈরী সেন্ট এক্স-রেতে খুব ভালভাবে দৃশ্যমান হয়। তাছাড়া এর স্থিতিস্থাপকতাও উন্নত মানের। অন্যদিকে এটি চুপসে যাওয়া ধমনীতে খুব ভাল কাজ করে।
করোনারি স্টেন্টের প্রকারভেদ, Types of coronary stents
স্টেন্ট দুটি ধরণের হতে পারে:
- বি-এম-এস বা বেয়ার মেটাল স্টেন্ট, এটি হল প্রথম জেনারেশন স্টেন্ট। উক্ত স্টেন্টগুলি করোনারি ধমনীর চুপসে যাওয়া থেকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে আক্রান্ত জায়গায় আবার ব্লকেজের সমস্যা ফিরে আসে কয়েক মাস পর থেকেই।
- ডি-ই-এস বা ড্রাগ-ইলুটিং স্টেন্ট, এটি হল এমন একধরনের স্টেন্ট যা ওষুধের সাথে লেপযুক্ত। ধমনীতে হওয়া ব্লক এর সংখ্যার উপর নির্ভর করে একজন রোগীর একাধিক স্টেন্ট স্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে। এই সেন্ট ধমনীতে ধীরে ধীরে ওষুধ ছড়িয়ে দেয় যা রক্ত জমাট বাঁধা রোধ করে।
রোগীর করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে কত সময় লাগে ? How long does it take for a patient to undergo coronary angioplasty?
রোগীর করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘন্টা মতো সময় লেগে যেতে পারে। তবে যদি কোনো রোগীর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র অ্যানজাইনার জন্য করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করানো হয় তাহলে সেই দিনেই বা তার পরের দিনেই রোগী বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু যদি কখনই হার্ট অ্যাটাকের কারণে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা হয় তবে সেক্ষেত্রে কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে।
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি পরে যত্ন কিভাবে নিতে হয় ?How to take care after angioplasty?
- কোনো রোগী যদি জরুরী অবস্থায় অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করিয়ে থাকেন তবে তাদের স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য দীর্ঘতর হাসপাতালে ডাক্তারদের পর্যবেক্ষণে থাকা উচিত। সাধারণত রোগীদেরকে অ্যানজিওপ্লাস্টির এক সপ্তাহের মধ্যে বা ক্যাথেটার অপসারণের 12-24 ঘন্টা পর বাড়ি যেতে দেওয়া হয়। তবে ঘরে ফিরে রোগীদের নিম্নলিখিত যত্ন নিতে হবে:
- চিকিৎসকের দেওয়া রক্ত পাতলা ওষুধ অর্থাৎ রক্ত জমাট বাঁধা থেকে রোধ করার ওষুধ সময়সূচি অনুযায়ী গ্রহণ করা উচিত।
- অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির পরে, রোগীর রুটিনে বেশকিছু স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন করতে হয়; যেমন অ্যালকোহল এবং ধূমপান ছেড়ে দেওয়া, যোগব্যায়াম করা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা, কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
- রোগীর যতটুকু সম্ভব তরল খাবার গ্রহণ করা উচিত।
- ক্যাথেটার সন্নিবেশ বা জ্বর, দুর্বলতা, বুকে ব্যথা অথবা শ্বাসকষ্ট হলে বা কোনো অংশ ফোলা এবং ব্যথা অনুভব হোক অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
- অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির পরে রোগী যদি ভাল ফলাফল না পান তবে হার্টের সমস্যা কমাতে বাইপাস সার্জারির পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসকেরা।
- কিছুক্ষেত্রে সিবিসি, কিডনি এবং লিভার ফাংশন টেস্টগুলি পর্যায়ক্রমে করা প্রয়োজন হতে পারে।
- ৩ থেকে ৪ মাস হার্ট স্টেন্ট সহ রোগীর ফলোআপটি নিয়মিতভাবে করা উচিত।
করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির ফলে কি উপকার পাওয়া যায়? What are the benefits of coronary angioplasty?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হার্ট আটাকের পর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির দ্বারা বহু মানুষের জীবন রক্ষা হয়েছে। করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির ফলে যেসব উপকার পাওয়া যায় সেগুলি হল :
- হার্ট আটাকের পর যত দ্রুত করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করানো হবে, তত তাড়াতাড়ি রোগীর হৃদপিন্ডে রক্ত সংবহন সঠিক মাত্রায় ফিরে আসবে, যার ফলে হৃদপেশির ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমে যায়।
- এই চিকিৎসা পদ্ধতি রোগীর বুকে ব্যাথা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে।
- এই চিকিৎসা পদ্ধতি রোগীর শ্বাসকষ্ট কমায়।
- করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির ক্ষেত্রে ওপেন হার্ট সার্জারির অস্ত্রোপচারের তুলনায় রোগীর সুস্থ হয়ে উঠতে অনেক কম সময় লাগে।
- করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি রোগীর আবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম করে দেয়।
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার ঝুঁকি, Risks of angioplasty
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির পরে অনেকে বিভিন্ন জটিলতা বা ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন, যথা :
- এলার্জি প্রতিক্রিয়া।
- ক্যাথেটার 3 সাইটে রক্তপাত, অর্থাৎ যেস্থানে ছিদ্র করা হয় সেখানে থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে বা লাল হয়ে ফুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন।
- রক্ত জমাট বাঁধা।
- রক্তনালীতে কোনো রকম আঘাত প্রাপ্তি।
- বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি বোধ হওয়া।
- কিডনির ক্ষতি হাওয়া।
- হার্টের ভালভের ক্ষতি হতে পারে।
- স্ট্রোক।
- কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপরিউক্ত সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষ করে রোগীর বয়স বেশি হলে এইসব ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।
শেষ কথা, Conclusion
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি সাধারণত রোগীর ক্ষেত্রে একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়া, কিন্তু অনেক সময় হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকির মতো জরুরী পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা জরুরী পদ্ধতি হিসাবে রোগীদের অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করেন। কখনো বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন এবং পা ও পায়ে ফোলাভাব দেখা দিলে অবিলম্বে কার্ডিওলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে এবং হার্টের পরীক্ষা করাতে হবে।