ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা ~ Everything You Need to Know about Dengue in Bengali


ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত ভাইরাল সংক্রমণ। এডিস মশার কামড়ে মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। একজন মানুষ এই রোগে তখনই আক্রান্ত হয় যখন একটি মশা কোনো সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয় এবং সেই ব্যক্তির শরীর থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করার সময়কালে একজন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড় দেয়। 

ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণকে মোটেই অবহেলা করা উচিত না কারণ এটি গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। আজ এই প্রতিবেদনের মধ্যদিয়ে আমরা ডেঙ্গু সংক্রমণের লক্ষণ ও ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

ডেঙ্গু সংক্রমণ | Dengue Fever Causes

ডেঙ্গুর জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করার পর আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তনালীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়, যার ফলে রক্তনালীতে ছিদ্র তৈরি হয় এবং রক্ত প্রবাহে জমাট বাঁধতে শুরু হয়, এভাবেই প্লেটলেটস এর সংখ্যা কমে যেতে থাকে। এইসব কারণে আক্রান্তের শরীরে শক লাগার মত অনুভব হয়, অনেকের ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত হয়, কিছু ক্ষেত্রে দেহের যে কোন অঙ্গের ক্ষতিও হতে পারে এবং শেষ পরিণতি হিসেবে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।

তবে ডেঙ্গু রোগীর শরীরে গুরুতর উপসর্গগুলির মধ্যে কোন একটিও যদি দেখা দেয় তবে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত, সম্ভব হলে রোগীকে নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত, অন্যথায় রোগীর প্রাণসংকট হতে পারে, তাই এই রোগের ক্ষেত্রে অবহেলা না করে সঠিক চিকিৎসা জরুরী।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ সমূহ কি কি? Dengue Fever Symptoms

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের প্রাথমিকভাবে কোন বিশেষ লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে। কিন্তু কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে যা দেখা দিলে চিকিৎসা করা জরুরি। সেগুলো হল :

  • সাধারণভাবে ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। এই রোগের ক্ষেত্রে জ্বর ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় থাকতে পারে। অনেকটা সময় ধরে জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার কিছু সময় পর ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দিলেও কিছুক্ষণ পর ফের জ্বর আসতে পারে।
  • ডেঙ্গুর আরো একটি অন্যতম লক্ষণ হল শরীরে ব্যথা, সঙ্গে থাকতে পারে মাথাব্যথা এবং চোখে ব্যথা, কিছু ক্ষেত্রে চামড়ায় লালচে দাগ বা র‌্যাশও দেখা দিতে পারে।
  • হঠাৎ করেই শরীর ঠান্ডা হচ্ছে বলে মনে হতে পারে। ক্ষুধা কমে যায়, বেশিরভাগ সময় শরীর ম্যাজম্যাজ করতে পারে।
  • নাক থেকে রক্তপাত।
  • প্রস্রাবে এবং মলের সাথে রক্তপাত।
  • অনিয়ন্ত্রিত পায়খানা।
  • ত্বকে বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
  • রোগীর মধ্যে বিরক্তি এবং অস্থিরতা দেখা যায়।

সিভিয়ার ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে অনেকের তীব্র পেট ব্যথা হয়, অনেক সময় পেট ফুলে যায়, রক্তবমি হয়, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে, শ্বাসকার্য কঠিন বা দ্রুত হয়ে পড়ে, দ্রুত নাড়ি স্পন্দন এবং চেতনা হারানোর মত অনুভব হয়ে থাকে।

উক্ত উপসর্গগুলি সাধারণত ডেঙ্গু সংক্রমণের ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে দেখা যায় এবং ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত এইসব লক্ষণ স্থায়ী হতে পারে। তবে কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে এই রোগের ভয়াভয়তা সাধারণত বৃদ্ধি পায়। তাই পূর্বে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের অতিরিক্ত সতর্কতা মেনে চলা উচিত।

ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা | Dengue Fever Treatment

ডেঙ্গু জ্বরের প্রকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি বা বিশেষ কোন প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, তবে গবেষকরা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগের সংক্রমণ রোধ হয় ঘরোয়া চিকিৎসার মধ্য দিয়েই। চিকিৎসকরা জ্বর কম করার বা জ্বরের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ঔষধ খাওয়া পরামর্শ দিয়ে থাকেন, কিন্তু রোগের মাত্রা অতিরিক্ত ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে গেলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসকদের নজরদারিতে রাখা জরুরী। 

ঘরোয়া চিকিৎসা :

ডেঙ্গু রোগ হলে কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা অবলম্বন করা যেতে পারে, যেমন :

  1. ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ভালোভাবে বিশ্রাম নিতে হবে। 
  2. পর্যাপ্ত পরিমাণে জল এবং তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। শরীরে জলীয় অংশ বেশি থাকলে মাথাব্যথা ও পেশি ব্যথা কম হবে।
  3. ডেঙ্গু রোগীর প্লেটলেটস কমে যায়। তাই প্লেটলেটস বাড়ে এমন খাবার খেতে হবে। যেমন- আদা, সূর্যমুখী বীজ, সাইট্রাস ফল, পালংশাক, দই, গ্রিন টি, ক্যাপসিকাম, কাঠবাদাম, ব্রোকলি, রসুন ও হলুদ।
  4. ডেঙ্গু জ্বরের রোগীকে পেয়ারার শরবত পান করানো যেতে পারে, কারণ ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই পানীয় দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সক্রিয় করে তোলে ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণ উপশম করতে সহায়তা হয়।
  5. নিম পাতার রস রক্তে প্লেটলেটস বাড়াতে ভালো কাজ করে। এটি রক্তে শ্বেত রক্তকনিকার সংখ্যাও বৃদ্ধি করে দেয়, ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিকার করতে কি করা উচিত!

আমরা সকলেই জানি যে, ডেঙ্গু একটি মশা-বাহিত রোগ। তাই এই রোগের প্রতিকারের ক্ষেত্রে সকলকে মশার কামড়ের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। সেক্ষেত্রে যেটা করতে হবে তা হলো :

  • নিজের বাড়ির চারপাশে কোথাও জল জমতে দেবেন না, কারণ সাধারণত বেশ কিছুদিন ধরে জমে থাকা জলে মশারা বংশবিস্তার করে। আমরা যদি জল জমতে না দেই তবে মশাদের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। তাই গাছের টব, ফুলদানি বা আশে পাশে পড়ে থাকা গাড়ির টায়ার ইত্যাদিতে জমে থাকা জল ফেলে পরিষ্কার করে রাখতে হবে। 
  • শরীর ঢাকা থাকে এমন জামা কাপড় পরিধান করা উচিত, যেমন লম্বা-হাতা শার্ট, লম্বা প্যান্ট, পা ঢাকা জুতা ইত্যাদি।
  • ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশাগুলো সাধারণত ভোর থেকে সন্ধ্যার সময় অবধি সক্রিয় থাকে। তাই এই সময়টাতে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। 
  • রোজ রাতে শোবার সময় অবশ্যই মশারী ব্যবহার করা উচিত।
  • খেলতে যাওয়ার সময় মশা নিরোধক কেমিক্যাল ব্যবহার করতে পারেন।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে প্লেটলেটের সংখ্যা সাধারণত কত হয়?

একজন প্রাপ্ত বয়স্ক স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সম্পন্ন মানুষের প্রতি মাইক্রলিটার রক্তে প্লেটলেট সংখ্যা হয় 150,000 থেকে 450,000Opens in a new tab.। তবে ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগীদের এই সংখ্যা 20,000 এর নিচে চলে যেতে পারে, আর এই সময়ই রক্তপাতের ঝুঁকি সর্বোচ্চ হয়ে যায়, যা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ন। অন্যদিকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের ক্ষেত্রে প্লেটলেট সংখ্যা 21-40,000/cumm মধ্যে থাকে। তবে একটা জিনিষ মনে রাখা উচিত যে, ডেঙ্গু সংক্রমণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লেটলেট সংখ্যার দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে। প্লেটলেট সংখ্যা কম হলে এবং রক্তক্ষরণের লক্ষণ প্রকাশ পেলে শীঘ্রই প্লেটলেট প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়, এভাবেই সংক্রমণ কম করার সাথে সাথে রোগীর শরীরে স্বাভাবিকভাবে প্লেটলেট সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। প্লেটলেট সংখ্যা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, ফোলেট এবং পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা। 

ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের ডায়েট কেমন হওয়া উচিত ~ Dengue Fever Diet

  • ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে খাওয়া দাওয়া সঠিকভাবে হওয়া দরকার, কিছু পুষ্টি উপাদান এই রোগে আক্রান্তদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উপকারী হতে পারে, যেমন : 
  • ভিটামিন সি জাতীয় খাবার, যেমন- সাইট্রাস ফল, বেরি এবং শাক-সবজিতে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। 
  • জিঙ্ক থাকে এমন সব খাবার, যেমন – সামুদ্রিক খাবার, মটরশুটি এবং বাদামে জিংক পাওয়া যায়।
  • আয়রন সমৃদ্ধ খাবার। মাংস, মটরশুঁটিতে আয়রন পাওয়া যায়। 
  • সহজপাচ্য কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবারযুক্ত বা ওটমিল জাতীয় খাবার। 
  • সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে জল পান করা দরকার যাতে শরীর হাইড্রেট হয়ে থাকে।

ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে যেসব খাবার খাওয়া অনুচিত :

ডেঙ্গু হলে সহজে হজম হয়না এমন সব খাবার খাওয়া উচিত নয়। যেমন – 

  • চর্বি জাতীয় খাবার।
  • তৈলাক্ত খাবার 
  • ভাজাভুজি জাতীয় খাবার।

উপসংহার

ডেঙ্গু জ্বর প্রাথমিকভাবে একটি সাধারণ রোগ, কিন্তু যদি একে অবহেলা করা হয় তবে এই রোগ মারাত্মকও হয়ে উঠতে পারে। সাধারণভাবে শহরাঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি দেখা যায়, তাই নগরবাসীদের সচেতন থাকতে হবে। এই রোগ সম্পর্কে জনমনে সচেতনতা বৃদ্ধি ভীষণ জরুরী। অবহেলা না করে বরং সামান্য কিছু উপায় মেনে চললেই আমরা ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। তবে যাদের একবার ডেঙ্গু হয়েছে তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকা উচিত, কারণ দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু সংক্রমণ হলে তা মারাত্মক হতে পারে। তাই সকলেই সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন। প্রয়োজন হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts