থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি গলগণ্ড বা গয়টার বলে পরিচিত। গলগন্ড রোগ হল এমন একটি অবস্থা যেক্ষেত্রে আমাদের থাইরয়েড গ্রন্থি অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যায়। গলগন্ড সাধারণত ব্যথাহীন হয়, কিন্তু গ্রন্থি যদি খুব বড় হয়ে যায়, তাহলে এটি খাবার গিলতে বা শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আজ এই প্রতিবেদনে আমরা গলগণ্ড বা গোয়টার রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
গলগণ্ড রোগ হওয়ার কারণগুলো কি, Causes of goitre
সাধারণত, আমাদের দেহে আয়োডিনের অভাব দেখা দিলে গলগন্ড রোগ হতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থিকে থাইরয়েড হরমোন তৈরি করার কাজে সাহায্য করার জন্য আয়োডিন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন আমাদের দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়োডিন না থাকে, তখন থাইরয়েড হরমোন তৈরি করার ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থিকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, ফলে গ্রন্থিটি বড় হতে পারে।
গলগন্ড বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত বা কম উৎপাদনের কারণে হয়ে থাকে। থাইরয়েড গ্রন্থির এই সমস্যার ক্ষেত্রে গলগন্ডের আকার, উপসর্গ এবং রোগ সৃষ্টির কারণের উপর নির্ভর করে চিকিৎসা করা হয়ে থেকে। গলগন্ড ছোট আকারের হলে সেটা লক্ষণীয় হয় না এবং কোনও সমস্যা সৃষ্টি করে না, তাই সাধারণত এমন অবস্থায় কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
গলগন্ড রোগের উপসর্গ, Symptoms of goitre
গলগন্ড রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হল ঘাড়ে ফোলাভাব। থাইরয়েডে নোডিউলগুলি বিভিন্ন কারণে আকারে খুব ছোট থেকে খুব বড় পর্যন্ত হতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থিতে এই নোডুলসের উপস্থিতিও ফোলাভাব বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী হতে পারে। এসব ছাড়াও অন্যান্য কিছু উপসর্গ হল :
- গিলতে বা শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া।
- কাশি হওয়া।
- হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘোরা
- কণ্ঠে কর্কশতা ইত্যাদি।
বাতজ গলগন্ডের লক্ষণঃ
এই ধরনের গলগন্ড বেদনাযুক্ত হয় এবং রোগের তীব্রতা বেড়ে গেলে তালু, গলার শোষ ও মুখের বিরস ভাব হয়।
কফজ গলগন্ডের লক্ষণঃ এক্ষেত্রে কাশি এবং কফের সমস্যা দেখা দেয়।
মেদজ গলগন্ডের লক্ষণঃ
এক্ষেত্রে গ্রন্থিতে চুলকানি অনুভব হয়; আর রোগ বেড়ে গেলে অনেক সময় দেহের ওজনে ঘাটতি বা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। তবে দেহের ওজন বাড়লে গলগণ্ডও বাড়ে; তাছাড়া রোগ বেড়ে গেলে অনেকের ক্ষেত্রে গলায় অবাঞ্ছিত শব্দ উৎপন্ন হয়।
গলগন্ডের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে :
গ্রেভস ডিজিজ
গ্রেভস ডিজিজ হল এমন এক পরিস্থিতি যেক্ষেত্রে আপনার থাইরয়েড গ্রন্থি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে। এই সমস্যাটি হাইপারথাইরয়েডিজম নামেও পরিচিত। যেহেতু হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন হয় তাই এক্ষেত্রে থাইরয়েডের আকারও বাড়াতে পারে।
প্রদাহ :
থাইরয়েডের প্রদাহের কারণেও গলগন্ড হতে পারে।
নোডুলস :
থাইরয়েড গ্রন্থির উপর অনেকসময় কঠিন বা তরলযুক্ত সিস্ট দেখা দেয়, যার ফলে গ্রন্থি টি ফুলে যায়। তবে এই নোডুলগুলি সাধারণত ক্যান্সারবিহীন হয়, ফলে তেমন সমস্যার সৃষ্টি হয় না।
থাইরয়েড ক্যান্সার :
ক্যান্সার কোষ থাইরয়েডকে প্রভাবিত করে, ফলে গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থা :
গর্ভাবস্থার কারণেও অনেকের থাইরয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে যেতে পারে।
গলগন্ড রোগের প্রকারভেদ, Different types of goiter
বিভিন্ন কারণে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে, তাই গলগন্ড রোগেরও একাধিক প্রকার রয়েছে। সেগুলি হল :
সরল গলগন্ড –
থাইরয়েড গ্রন্থি যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ হরমোন তৈরি করতে অক্ষম হয় তবে গ্রন্থি বড় হয়ে যেতে পারে।
এন্ডেমিক গলগন্ড –
এন্ডেমিক গলগন্ড কলয়েড গলগন্ড হিসাবে পরিচিত। এক্ষেত্রে খাদ্যে আয়োডিনের অভাবের কারণে থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে কষ্ট হয় বলে গ্রন্থি ফুলে যায়।
মাল্টিনোডুলার গলগন্ড –
থাইরয়েডে নোডুলস নামক পিণ্ডগুলি যখন বৃদ্ধি পায় তখন একে মাল্টিনোডুলার গলগন্ড বলে।
তবে একটা বিষয় সম্পর্কে জেনে রাখা উচিত যে, একটি গলগন্ড যখন হাইপারথাইরয়েডিজমের সাথে যুক্ত হয়, তখন একে বিষাক্ত হিসাবে ধরে নেওয়া হয়।
গলগন্ড রোগের প্রতিকার ও চিকিৎসা, Treatment of goitre
চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে গলগন্ড ও তার কারণ নির্ণয় করতে পারেন। পরীক্ষাগুলো হল :
হরমোন পরীক্ষা
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে থাইরয়েড এবং পিটুইটারি গ্রন্থি দ্বারা উৎপাদিত হরমোনের মাত্রা নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থি নিষ্ক্রিয় হলে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম থাকে।
অ্যান্টিবডি পরীক্ষা
গলগন্ডের প্রভাবে দেহে অস্বাভাবিক অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে। রক্ত পরীক্ষা দ্বারা এই অ্যান্টিবডিগুলির উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়।
আল্ট্রাসনোগ্রাফি
এই পরীক্ষা পদ্ধতিতে, ট্রান্সডুসার নামক একটি কাঠির মতো যন্ত্র ঘাড়ে ধরে রাখা হয়, যার প্রভাবে একটি কম্পিউটার স্ক্রিনে থাইরয়েড গ্রন্থির ছবি দেখতে পাওয়া যায়। এভাবে গ্রন্থিতে কোনও নোডিউল রয়েছে কিনা তাও দেখতে পাওয়া যায়।
থাইরয়েড স্ক্যান
এই পদ্ধতিতে, তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ হাতের কনুইয়ের শিরাতে ইনজেকশন দিয়ে তারপর টেবিলে শুইয়ে একটি বিশেষ ক্যামেরা দিয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনে আপনার থাইরয়েডের একটি চিত্র তৈরি করে। এরূপ থাইরয়েড স্ক্যানগুলি থাইরয়েড গ্রন্থির প্রকৃতি এবং আকার সম্পর্কে তথ্য প্রদান করতে সক্ষম।
বায়োপসি
এক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে বিশেষ সুই এর মাধ্যমে, টিস্যু বা তরল নমুনা নিয়ে পরীক্ষার করা হয়।
চিকিৎসা , Treatment
কোনো রোগীর গলগন্ড হওয়ার কারণ তথা রোগটা কতটা গুরুতর, এর উপর নির্ভর করে ডাক্তাররা চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন। যেসব উপায়ে চিকিৎসা করা হয় সেগুলি হল :
ঔষধ :
গলগন্ড রোগের ক্ষেত্রে থাইরয়েড হরমোন প্রতিস্থাপনের জন্য চিকিৎসকরা বিশেষ কিছু ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যেমন প্রদাহজনিত গলগন্ডের ক্ষেত্রে অ্যাসপিরিন বা কর্টিকোস্টেরয়েড ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।
সার্জারি :
সার্জনরা প্রয়োজনে থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্ত বা কিছুটা অংশ অপসারণ করেন। কিন্তু এর ফলস্বরূপ, অনেকসময় রোগীকে সারা জীবনের জন্য থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনকারী ওষুধ সেবন করতে হতে পারে।
তেজস্ক্রিয় আয়োডিন :
অত্যধিক সক্রিয় থাইরয়েড গ্রন্থির চিকিৎসার ক্ষেত্রে আয়োডিনের বড়ি গ্রহণ করতে হতে পারে, যা থাইরয়েডকে সঙ্কুচিত করতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন ধরনের খাবারের সঙ্গে গলগণ্ডের সম্পর্ক, Relationship of goitre with different types of food
আমরা বিভিন্ন ধরনের খাবার খাই যেগুলোতে বিভিন্ন উপাদান থাকে, এইসব উপাদানের মধ্যে কিছু আছে যা থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে বাধা দেয়, যার ফলে গলগণ্ড হতে পারে। কিছু কিছু সবজি যেমন বাঁধাকপি, শালগম, ফুলকপি, ব্রাসেলস স্প্রাউটস, ব্রকলি এবং সয়া-সমৃদ্ধ খাবার যেমন সয়া দুধ, সয়া সস ইত্যাদি গলগন্ড রোগ সৃষ্টির কারণ হিসেবে অন্যতম।
নিঃসন্দেহে এগুলো পুষ্টিকর খাবার, তবে স্বাভাবিক পরিমাণে খেলেও এগুলো থেকে ক্ষতি হাওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না। তাছাড়া সবজিগুলো যদি ভালোভাবে সেদ্ধ করে খাওয়া হয় তবে এদের মধ্যে থাকা ক্ষতিকর উপাদানগুলোর প্রভাব অনেক কমে যায়। তাই গলগণ্ড রোগ হলে উক্ত খাবারগুলো খাওয়া থেকে একেবারে বিরত থাকার প্রয়োজন নেই, তবে সাবধানতা বজায় রাখা উচিত।
তবে এমন কোনো রোগী যারা থাইরক্সিন বড়ি খান এবং যাদের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতির আশঙ্কা থাকে তাদের সয়া-সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক থাকা জরুরি।
উপসংহার, Conclusion
সাধারণত ছোট গলগন্ড কোন শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে না, তাই সেটা তেমন উদ্বেগের বিষয় নয়, তবে বড় গলগন্ড একাধিক জটিলতা সৃষ্টি করে, ফলে এর উপযুক্ত চিকিৎসা করা জরুরি। তবে গ্রন্থির ফুলে যাওয়ার কারণ বুঝে সেই অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। চিকিৎসকের থেকে পরামর্শ না নিয়ে নিজের থেকে কোনও ওষুধ সেবন না করাই ভালো।