ইনসুলিন কথাটির সাথে বর্তমান সময়ে অনেকেই পরিচিত। এর কারণ নিজের পরিচিত অথবা পরিবারের কেউ না কেউ ডায়বেটিসে আক্রান্ত। বলতে গেলে এখন যেন ঘরে ঘরে ডায়বেটিস রোগী আছেন। এইসব রোগীদের অনেকেই ইনসুলিন ইনজেকশন ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু এই ইনসুলিন কি ? অনেকেই হয়তো এবিষয়ে অজ্ঞাত। তাই আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা ইনসুলিন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ইনসুলিন আবিষ্কার করেন কে? Who invented insulin?
ফ্রেডেরিক গ্র্যান্ট ব্যানটিং (১৪ নভেম্বর, ১৮৯১ – ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১) একজন কানাডীয় চিকিৎসক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং ইনসুলিন এর সহ-আবিষ্কারক। তিনি বিজ্ঞানী চার্লস বেস্টের সঙ্গে একত্রে ১৯২২ সালে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন।
ইনসুলিন কেন ব্যবহার করা হয়? Why is insulin used?
অগ্ন্যাশয় যখন শরীরে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, অর্থাৎ, শরীর যখন রক্তের চিনিকে (গ্লুকোজ) ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখনই ‘ডায়াবেটিস’ বা ‘বহুমূত্র রোগ’ হয়। এমন পরিস্থিতিতে মানবদেহকে সুস্থ রাখার জন্য বাইরে থেকে কৃত্রিম ইনসুলিন দিতে হয়।
ইনসুলিন গ্লুকোজকে শরীরের কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে, যেখানে এটি শক্তির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে বা ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
শরীরে কিভাবে ইনসুলিন উৎপাদিত হয়? How the body produces insulin?
ইনসুলিন অগ্ন্যাশয়ের একটি বিশেষ অংশে উৎপাদিত হয়। সেই অংশের নাম ল্যাঙ্গারহ্যান্সের দ্বীপ। ল্যাঙ্গারহ্যান্সের দ্বীপগুলি হল অগ্ন্যাশয়ের অঞ্চল যেখানে এর অন্তঃস্রাবী (হরমোন-উৎপাদনকারী) কোষ রয়েছে। উক্ত অংশের বিটা কোষগুলি ইনসুলিন তৈরি করে।
খাবার খাওয়ার পর যখন রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়, এই বিটা কোষগুলি রক্ত প্রবাহে ইনসুলিন ছেড়ে দেয় যা শর্করাকে ভাঙতে সহায়ক।
অন্যদিকে দেহে ইনসুলিনের উৎপাদন বিভিন্ন কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যেমন আমাদের রক্তে শর্করার মাত্রা, হরমোন (গ্লুকাগনের মতো), এবং আমাদের স্নায়ু থেকে আসা কোনো সংকেত।
অনেক সময়, অটোইমিউন রোগ (যেমন টাইপ 1 ডায়াবেটিস) বা অগ্ন্যাশয়ের কোনোও ক্ষতিও ইনসুলিনের উৎপাদনকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলো কী কী? What are the symptoms of hypoglycemia?
রক্তে শর্করার পরিমাণ ৪ মিলিমোল বা ৭০ একরের নিচে নেমে গেলে তাকে চিকিৎসার পরিভাষায় ‘হাইপোগ্লাইসেমিয়া’ বলা হয়। হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় রক্তের গ্লুকোজ বা শর্করা হঠাৎ নেমে যায়।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে কাঁপুনি, ঘাম, বিভ্রান্তি, বিরক্তি, মাথা ঘোরা এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
হাইপারগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলো কী কী? What are the symptoms of hyperglycemia?
হাইপারগ্লাইসিমিয়া হচ্ছে এমন একটি শারীরিক অবস্থা যখন রক্তরসে গ্লুকোজের পরিমাণ সাধারণ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যায়।
হাইপারগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির রোগ, সেপসিস, এনসেফালাইটিস, মস্তিষ্কের টিউমার মেনিনজাইটিস, খিচুনি ইত্যাদি।
শরীরে ইনসুলিন কমে গেলে কি হয়? What happens when insulin decreases in the body?
- দুর্বলতা
- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
- কাজে মনোযোগ দিতে কষ্ট হওয়া
- বিভ্রান্তি
- অসংলগ্ন আচরণ, কথা জড়িয়ে যাওয়া ও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়া (মাতাল হলে যেমনটা হয়)
- ঘুম ঘুম লাগা
- খিঁচুনি
- জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি।
ইনসুলিন এর অপর নাম কি? What is another name for insulin?
ইনসুলিন(ইংরেজি: Insulin), হলো অগ্ন্যাশয়ের প্রধান হরমোন,এক ধরনের পলিপ্যাপটাইড, যা গ্লুকোজকে রক্ত থেকে কোষের মধ্যে প্রবেশ করা নিয়ন্ত্রণ করে। মূলত ডায়েবেটিস মেলাইটাস এ ইনসুলিন ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
অগ্ন্যাশয়ের কোন কোষ থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়? Which cells of the pancreas form insulin?
অগ্ন্যাশয় β-কোষ ইনসুলিন নিঃসরণ করে গ্লুকোজ হোমিওস্ট্যাসিসে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে, যা রক্তে গ্লুকোজের ঘনত্ব কমাতে সক্ষম একমাত্র হরমোন।
ইনসুলিন কিভাবে নিতে হয়? How to take insulin?
ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হলো শরীরের চর্বিযুক্ত স্থান। যেমন: তলপেট (নাভির নিচের অংশ), উরু অথবা নিতম্ব। প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ইনজেকশন নেওয়া উচিত। তবে দিনে যদি একাধিকবার ইনজেকশন নিতে হয় তবে আগে যেখানে ইনসুলিন নিয়েছেন তার থেকে থেকে অন্তত ১ সেন্টিমিটার বা আধা ইঞ্চি দূরে পরের ইনজেকশনটি দেওয়া উচিত।
রক্তে শর্করার পরিমাণ কত হলে ইনসুলিন প্রয়োজন? When it is necessary to take insulin dose following the amount of sugar?
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা 300 থেকে 350 মিলিগ্রাম প্রতি dL (16.7 থেকে 19.4 mmol প্রতি L) বা তার বেশি হলে বা A1C 10% থেকে 12% এর বেশি হলে ইনসুলিন প্রতিস্থাপন থেরাপি শুরু করার কথা বিবেচনা করুন। তবে একটা কথা জেনে রাখা ভালো যে, ইনসুলিন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সবসময় রক্তের গ্লুকোজের মাত্রার উপর নির্ভর করে না।
রোগী কোন ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, সেই বিষয়টির উপর রোগীকে ইনজেক্ট্যাবল ইনসুলিন নিতে হবে নাকি হবে না, তা নির্ভর করছে ।
সাধারণত একজন টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগী, যার শরীরে ইনসুলিন পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই; তাকে ঔষধ, ডায়েট, এক্সারসাইজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়েও যখন সুগার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তখন রোগীকে কৃত্রিম ইনসুলিন দেওয়া হয়।
ইনসুলিনের এর মাত্রা কম হলে কি সমস্যা হয় ? What problem occur if the level of insulin is low?
ইনসুলিনের নিঃসরণ কম হলে রক্তে এর ভারসাম্য বজায় থাকে না। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যাগুলো হলো:
১) হাইপারগ্লাইসেমিয়া:
ইনসুলিনের এর মাত্রা কম হলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যার ফলে হাইপারগ্লাইসেমিয়া হয়।
২) টাইপ 1 ডায়াবেটিস:
ইনসুলিন কম উৎপাদন হলে টাইপ 1 ডায়াবেটিস হতে পারে।
৩) Diabetic Ketoacidosis:
ইনসুলিনের কম উৎপাদন ডায়াবেটিক কেটোঅ্যাসিডোসিস এর দিকে পরিচালিত করতে পারে, এটি হল ডায়াবেটিসের একটি গুরুতর জটিলতা।
অতিরিক্ত ইনসুলিন খেলে কি হয়? What happens if you take too much insulin?
যখন রক্তে অত্যধিক ইনসুলিন থাকে, কোষগুলি তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চিনি শোষণ করে, তাছাড়া ইনসুলিন ওভারডোজের লক্ষণগুলি হল হাইপোগ্লাইসেমিয়া।
ওষুধ ছাড়াও প্রাকৃতিক ভাবেই ইনসুলিন বাড়ায় যেসব খাবার, Foods that increase insulin naturally without medication :
১) ঢ্যাঁড়স
ডায়টরি ফাইবার সমৃদ্ধ ঢেঁড়স রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল করতে সহায়তা করে। এই বিশেষ খাদ্যটি ইনসুলিনের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি এর ক্ষরণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অন্যদিকে এর বীজ আলফা-গ্লুকোসিডেস ইনহিবিটর সমৃদ্ধ যা স্টার্চকে গ্লুকোজে রূপান্তর করতে বাধা দেয়।
২) করলা
করলার স্বাদ বেশ তেতো, তবে এতে অগ্ন্যাশয়কে উদ্দীপিত করার ক্ষমতা রয়েছে। এতে চারেন্টিন, ভিসিন এবং একটি পলিপেপটাইড-পির মতো উপাদান আছে। করলা খাওয়ার কিছু বিশেষ উপায় হল : করলার চা, জুস বা তরকারি।
৩) মেথি বীজ
মেথি এমন বীজ যাতে ট্রাইগোনেলাইন রয়েছে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে পরিচিত। বিভিন্ন রূপে মেথি সেবন করা যেতে পারে – যেমন গুঁড়ো মেথি বীজ গরম জলে ভিজিয়ে, সারারাত ভিজিয়ে সেই জল খাওয়া যায়। মেথির অঙ্কুরিত বীজগুলিকে সালাড এর সাথে যোগ করা যেতে পারে। এতে আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা কম হবে।
৪) হলুদ
হলুদের নির্যাস অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষে সরাসরি কাজ করে যা প্রাকৃতিকভাবে ইনসুলিন বাড়াতে সাহায্য করে।
৫) দারুচিনি
এটি মশলা হিসেবে পরিচিত হলেও, দারুচিনি মানবদেহের কোষগুলোকে ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে না এবং অগ্ন্যাশয়ের প্রাকৃতিক ইনসুলিনের মতোই কাজ করে।
৬) নারিকেল
গবেষণায় দেখা গেছে যে উচ্চ গ্লাইসেমিক সূচকযুক্ত খাবারগুলি ইনসুলিনের ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করতে পারে। উচ্চ গ্লাইসেমিক সূচকযুক্ত খাবারগুলির ক্ষেত্রে নারকেল উপকারী। এছাড়াও এতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম। এতে প্রাকৃতিক স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকায় নারকেল রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
শেষ কথা, Conclusion :
রক্তপ্রবাহে গ্লুকোজ বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হিসাবে আপনার অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয় । ভাল ব্যায়াম করা, পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া এবং অসম্পৃক্ত চর্বি এবং দ্রবণীয় ফাইবার সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ডায়াবেটিস সহ ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। আশা করি আজকের আলোচনার মাধ্যমে আপনারা ইনসুলিন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।
Frequently Asked Questions
না, Insulin মৌখিকভাবে নেওয়া যায় না কারণ এটি এক ধরণের প্রোটিন যা পাকস্থলীর এনজাইম দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায়।
এই হরমোন প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়, এটি অন্যান্য রোগ যেমন Cystic Fibrosis (সিস্টিক ফাইব্রোসিস) এর চিকিৎসার জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া