ছোটবেলায় আমরা পাঠ্যবই তে ডিপথেরিয়া নামটির উল্লেখ বহুবার পেয়েছি। তাই বলা যায় যে ডিপথেরিয়া নামটির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। কিন্তু ডিপথেরিয়া আসলে কি? এই রোগ কতটাই বা ভয়াবহ? কিভাবে ক্ষতি করে এই রোগ ? এসব সম্পর্কে হয়তো আমাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। জেনে রাখা ভালো যে অন্যান্য মারাত্মক রোগের মতো ডিপথেরিয়াও কিন্তু ভয়ঙ্কর একটি ব্যাধি। যদি সঠিক সময়ে এই রোগের চিকিৎসা না করা হয় তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা ডিপথেরিয়া রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ডিপথেরিয়া কি? What is diphtheria?
ডিপথেরিয়া মূলত একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ, যা গলা ও নাকের মিউকাস মেমব্রেন বা শ্লেষ্মা ঝিল্লিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। তবে এই রোগের প্রভাব আমাদের টনসিলের উপর বেশি পড়ে। Corynebacterium diphtheriae নামক ব্যাকটেরিয়া ডিপথেরিয়ার জন্য দায়ী। এই রোগে গলার নিম্নাংশে পরিলক্ষিত পুরু পর্দার আচ্ছাদনকে বলা হয় ডিপথেরিক মেমব্রেন।
সাধারণত শীতকালে এই সমস্যা দেখা দেয়। ডিপথেরিয়া রোগটি প্রায় সকল বয়সেই হতে পারে। তবে এটি ১ থেকে ৫ বছরের বাচ্চাদেরকে বেশি প্রভাবিত করে। এই রোগের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াটি বিশেষত নাক ও গলায় প্রভাব ফেলে, তবে কিছু ক্ষেত্রে ত্বকেও সংক্রমণ হতে পারে। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে গলার পিছন দিকটি এক পুরু আস্তরন দ্বারা ঢেকে যায়, ফলে খাবার গিলতে সমস্যা হয়।
ডিপথেরিয়ার প্রধান লক্ষণ তথা উপসর্গগুলি কি কি? Causes and main symptoms of diphtheria
যেকোনো রোগের চিকিৎসা করার পূর্বে সঠিকভাবে রোগের লক্ষণগুলো জেনে রাখা অত্যন্ত জরুরি। ব্যকটেরিয়াল সংক্রমণের ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই সাধারণত ডিপথেরিয়া রোগের উপসর্গগুলি দেখা দেয়। এই রোগে সাধারণ যে লক্ষণগুলো পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হলো:
- জ্বর হওয়া।
- ঠাণ্ডা অনুভব হয়।
- খুব বেশিদিন ধরে কাশি লেগে থাকা।
- মুখ দিয়ে প্রায়ই লালা বের হওয়া।
- গলায় ব্যথা অনুভব হওয়া।
- খাবার গিলতে অসুবিধা।
- নাক দিয়ে হঠাৎ করেই রক্তপাত বা জল ঝরা।
- ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি হওয়া বা কালশিটে পড়া।
- কথা বলার মধ্যে জড়তা।
- ঘাড়ের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
- নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া।
- দুর্বলতা।
- প্রচন্ড মাথা ব্যথা।
ডিপথেরিয়া রোগের প্রধান কারণ কি কি?
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ডিপথেরিয়া রোগটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংক্রমণ ব্যক্তির কাশি বা হাঁচির মাধ্যমে শ্বাসযন্ত্রেও ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাকটেরিয়াটি আমাদের শ্বাসযন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে বলেই উপসর্গগুলি গলায় ও নাকে প্রকাশ পায়। ব্যাকটেরিয়াটি অনেক সময় ত্বকে সৃষ্ট ঘা বা ফমিটস এর মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ডিপথেরিয়া রোগের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে :
১) দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়ে যাওয়ার ফলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
২) সময়মতো যদি টিকা না নেওয়া হয় তবে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
৩) অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
৪) কারও ক্ষেত্রে উপরিউক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলে সময় থাকতে যদি এর সঠিক চিকিৎসা না করা হয় তবে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডিপথেরিয়া রোগ কিভাবে নির্ণয় করা হয়? How is diphtheria diagnosed?
রোগের চিকিৎসার জন্য রোগ নির্ণয় করা জরুরি। রোগ কি কারণে সৃষ্টি হয়েছে এবং রোগের সংক্রমণ কতটুকু সেটা বুঝতে পারলেই সঠিকভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব। ডিপথেরিয়া প্রাথমিকভাবে একটি শারীরিক পরীক্ষা দ্বারা নির্ণয় করা যেতে পারে, যা চিকিৎসককে গলার পিছনে মৃত টিস্যুর ও ধূসর বর্ণের আস্তরন পরীক্ষা করতে সাহায্য করবে। এছাড়াও অন্যান্য পরিক্ষাগুলি নিচে দেওয়া হল:
সংক্রমণ পরীক্ষা করার জন্য গলনালি থেকে শ্লেষ্মার নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
সিরোলোজিকাল পরীক্ষা এবং রক্ত পরীক্ষা করা হয়, যেমন সম্পূর্ণ রক্তের গণনা, ডিপথেরিয়ার অ্যান্টিবডির উপস্থিতি, ডিপথেরিয়া অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়।
লক্ষণগুলো দেখে সময়মত এই রোগটি নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নয়তো সমস্যা ক্রমে বেড়ে গিয়ে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারলেই সঠিক চিকিৎসা সম্ভব।
ডিপথেরিয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি, Treatment of diphtheria
ডিপথেরিয়ার চিকিৎসার সাথে অ্যান্টিটক্সিনের ব্যবহার জড়িত। ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা সংক্রমণ হয় বলে, সংক্রমণের ক্ষেত্রে টক্সিনের উৎপাদনকে বাধা দেওয়ার জন্য ও ভবিষ্যতের ক্ষতি এড়ানোর উদ্দেশ্যে অ্যান্টিটক্সিনের ব্যবহার করা হয়। এছাড়া যে ব্যাকটেরিয়ার কারণে রোগটি সৃষ্টি হয়েছে, তাকে দমন বা নিস্ক্রিয় করার জন্য অ্যান্টিবায়টিকের ব্যবহার করা হয়।
রোগ সারাতে ওষুধগুলির ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করা হয়, যাতে রোগীর অস্বস্তি বোধ কম করা যায়, সেই উপায়গুলি হল:
- শিরার মাধ্যমে ঔষধ প্রদান করা।
- নিশ্বাস নিতে টিউবের ব্যবহার।
- টিউবে বাতাস চলাচলের পথ সর্বদা পরিষ্কার করে রাখা।
- চিকিৎসক যতক্ষণ না পর্যন্ত নিশ্চিত হন যে রোগী আর সংক্রমণ ছড়াতে পারবে না, ততক্ষণ অবধি ডিপথেরিয়ায় সংক্রামিত ব্যক্তিকে অন্যদের থেকে আলাদা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
- ডিপথেরিয়া রোগীর আশে পাশে থাকা সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি, তাছাড়া রোগীর যথেষ্ট বিশ্রাম গ্রহণ করাও বাঞ্ছনীয়।
ডিপথেরিয়া রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়গুলো কি, Ways to prevent and cure diphtheria
কথায় আছে, প্রতিরোধ রোগের চিকিৎসার চেয়ে বেশী ভাল, অর্থাৎ পরে সমস্যা সমাধান করার চেয়ে সমস্যা যাতে না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখা ভালো। তাই নিজের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখা উচিত যাতে সহজে কোনো রোগ আমাদের ক্ষতি না করতে পারে। ডিপথেরিয়া রোগ প্রতিরোধের উপায়:
১) সঠিক সময়ে শিশুদেরকে প্রয়োজনীয় সকল টিকা গ্রহণ করাতে হবে। বিশেষত ডিপথেরিয়ার টিকা, যাকে বলে DTaP। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে উক্ত টিকাটি নির্দিষ্ট সময়ে শিশুদের দিতে হবে।
২) ডিপথেরিয়ার টিকা নিলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ১০ বছর পর্যন্ত থাকে। তাই শিশুর ১০ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে পুনরায় এই টিকা নিতে হবে।
৩) স্বাস্থ্যকর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার চেষ্টা করুন। নিজের বাড়ি ঘর তথা চারপাশ পরিষ্কার রাখুন।
৪) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক খাবারগুলো খেতে হবে।
ডিপথেরিয়া রোগের প্রতিকারের কথা বলতে গেলে যা করণীয় সেগুলো হল :
ডিপথেরিয়ার প্রকোপ কমাতেও আয়ুর্বেদে সবচেয়ে উপকারি প্রতিষেধক হিসেবে উল্লেখ রয়েছে রসুনের। টক্সিন দূর করতে রসুন অব্যর্থ ওষুধ। শরীরকে ডি-টক্সিফাই করতে রসুন অত্যন্ত কার্যকর। সংক্রমণজনিত অসুখ নিয়ন্ত্রণে আনতে রসুন অত্যন্ত উপকারী। তাই ডিপথেরিয়ার প্রকোপ থেকে বাঁচতে রোজ সকালে খালিপেটে কাঁচা রসুনের কয়েকটি কোয়া থেঁতো করে বা চিবিয়ে খেতে পারেন। তবে বাড়িতে এই রোগের চিকিৎসা করা বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এর কোনো ঘরোয়া প্রতিকার নেই এবং নিজস্ব প্রতিকারের ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিকার করাই শ্রেয়।
উপসংহার, Conclusion
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে ডিপথেরিয়া ব্যাকটেরিয়া ঘটিত মারাত্মক রোগ। এই রোগের ফলে অনেক সময় শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। তাছাড়া এই রোগের প্রভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, প্যারালাইসিস, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যাও দেখা দিতে পারে এবং ফলস্বরূপ রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
অন্যদিকে ডিপথেরিয়ার প্রদাহে শরীরের ত্বক আক্রান্ত হতে পারে। তাই আমাদের সাবধান থাকা খুব জরুরী এবং নিজের স্বাস্থের ব্যপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অবশ্যই আমরা এই রোগ থেকে দূরে থাকতে পারি।