খুসখুসে কাশি একটি বিরক্তকর ও বিব্রতকর সমস্যা, যা অনেকের ক্ষেত্রেই আবহাওয়া বদলের সাথে দেখা দেয়। শুকনো কাশি হলে রোগীর একবার কাশি শুরু হলে যেন থামতেই চায় না, বিশেষত রাতে ঘুমানোর সময়। তবে শুধু রাতেই নয় বরং যখন-তখন, যেখানে–সেখানে শুরু হয়ে যেতে পারে কাশি।
কফ বের হওয়া নেই, বুকে ঘড় ঘড় নেই—কিন্তু খুক খুক কাশি লেগেই থাকে, যা বিরক্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক। সবসময় যেন একটা অস্বস্তি গলায়-বুকে লেগেই থাকে। এমতাবস্থায় কি করণীয়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আজকের আমাদের এই প্রতিবেদন।
খুসখুসে কাশি কেন হয় ? Why does dry cough occur?
অনেকের ক্ষেত্রে সারা বছর খুসখুসে কাশি লেগে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ এই বারবার শুকনো কাশি হওয়ার কারণ হিসেবে ফুসফুসে সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু এর নেপথ্যে থাকতে পারেন বিভিন্ন কারণ। সেগুলি হল :
- শ্বাসনালি আক্রান্ত বা সংক্রমণ :
কাশির ক্ষেত্রে সহজেই অনুমানযোগ্য বা সহজ কারণটি হলো, ঠান্ডা বা অন্য কোনো ভাইরাল সংক্রমণ। কাশি কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাসের জন্যও থাকতে পারে। এর কারণ হল ভাইরাসের কারণে রোগীর শ্বাসনালি ফুলে উঠে এবং অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে যেতে পারে। এর ফলে কাশির স্থায়িত্বকালও বেড়ে যেতে পারে। সাধারণত ঋতু বদলের সময় ভাইরাস সংক্রমণ ঘটে থাকে। এর কারণে কাশির প্রকোপ বাড়ে।
জেনে রাখা ভালো যে দীর্ঘদিনের (যেমন তিন সপ্তাহের বেশি) কাশি, ঘুসঘুসে জ্বর, ওজন হ্রাস, কাশির সঙ্গে রক্ত যক্ষ্মার লক্ষণ হতে পারে।
- ধুলোবালি থেকে খুসখুসে কাশি :
সাধারণত ধুলোবালি হাঁপানি, অ্যালার্জি বা খুসখুসে কাশির কারণ হতে পারে। শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়া থাকে, যার কারণে বায়ুতে ধুলার পরিমাণ অন্য সময়ের তুলনায় বেশি থাকে।
অন্যদিকে ধুলার ধরন ও আকার-আয়তনের ওপর নির্ভর করে ক্ষতির মাত্রা। আবার কিছু ক্ষেত্রে ধুলার ঘনত্বের মাত্রার উপর নির্ভর করে দেহের ক্ষতির মাত্রা।
বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় যে সামান্য পরিমাণ ধুলাও তাৎক্ষণিক সমস্যা করতে পারে। যেমন অনেকেরই ধুলোর কারণে চোখ জ্বালাপোড়া, খুসখুসে কাশি, হাঁচি, আল্যার্জিক রাইনাইটিস, হাঁপানি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
আবার শ্বাসকষ্ট নয়, কেবল কাশিও হতে পারে হাঁপানি বা অ্যাজমার লক্ষণ। অ্যালার্জি ও অ্যাজমাও হচ্ছে কাশির কারণ হতে পারে। যদি ধুলাবালু, ফুলের রেণু, এসির ঠান্ডা বাতাস ইত্যাদি কারণে কাশির প্রকোপ বেড়ে যায়, তাহলে হতে পারে যে আপনার কাশি অ্যালার্জিজনিত।
- অ্যাসিডিটি বা অম্লতা থেকে খুসখুসে কাশি :
ভারী বা চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার পর অনেকের বুকে জ্বালাপোড়া বা টক ঢেকুর আসে। আবার কারও ক্ষেত্রে এসবের সঙ্গে খুক খুক কাশিও হতে পারে। পাকস্থলীর অম্ল খাদ্যনালিতে উঠে আসার ফলে এই কাশির সৃষ্টি হয়। অনেক সময় ঠান্ডা–সর্দি লাগা থেকে নাকের পেছন দিক থেকে গলায় নিঃসরণের জন্য শুষ্ক কাশি হতে পারে।
দেহে জলশূন্যতা থেকে খুসখুসে কাশি :
যখন কারও ফ্লু হবে, তখন প্রচুর পরিমাণে তরল পান করতে হবে। জল, জুস ও স্যুপ শ্বাসনালি থেকে কফগুলোকে বা ভেতরে থাকা শ্লেষ্মা পরিষ্কার করতে সহায়তা করে। কিন্তু ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়, যেমন চা বা কফি শরীরে জলশূন্যতা তৈরি করে, যা শ্লেষ্মা পরিষ্কার করার কাজে বাধা দিতে পারে।
- মানসিক চাপ থেকে খুসখুসে কাশি :
মানসিক চাপ যখন তীব্রতর হয়, তখন এটি কাশির স্থায়িত্বকালকে বাড়াতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী কাশির মোকাবিলা করতে অসুস্থ থাকলে, আপনার মধ্যে সৃষ্ট মানসিক চাপ কমিয়ে ফেলুন। নিজের ওপর বেশি চাপ প্রয়োগ করলে আপনি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। প্রশান্তিতে থাকতে প্রচুর পরিমাণে বিশ্রাম নিন, রাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমান।
- ওষুধ থেকে খুসখুসে কাশি :
অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের জন্য সেবন করা ওষুধ এর কারণেও কাশি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে তীব্র শুকনো কাশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
খুসখুসে কাশি নিরাময়ের বিভিন্ন উপায়, Various ways to cure dry cough :
- কাশির একটি অন্যতম কারণ ধূমপান ও বায়ুদূষণ। তাই ধূমপান বর্জন করুন।
- ধুলাবালুতে ঝাড়ু দেওয়া, ঝুল ঝাড়া ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।
- বেশি ঠাণ্ডা জল দিয়ে স্নান করবেন না। খুব ঠান্ডা জল খাবেন না।
- লিকার চা, কুসুম গরম জলে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে পান করা, মাঝে মাঝে গরম স্যুপ খাওয়া; ইত্যাদি কাশি সারাতে সাহায্য করে। খুসখুসে কাশি কমাতে মধু ভীষণ উপকারী। মধুর মধ্যে থাকা অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, অ্যান্টি-মাইক্রোবায়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান গলায় জমা শ্লেষ্মা দূর করতে সহায়ক। তবে ফুটন্ত গরম জলে কখনও লেবু মেশাবেন না।
- হালকা গরম জল দিয়ে গড়গড়া করে, ঘনঘন আদা, লেবু, মধু, লবঙ্গ, দারুচিনি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি গরম চা বা গরম জল পান করলে আরাম পাওয়া যায়।
- রোজ অন্তত একবার গরম জলের ভাপ নিতে পারেন, দীর্ঘদিন ধরে কাশিতে ভুগলে।
- সাধারণত শুকনো কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়ে না, তবে কাশির সঙ্গে জ্বর, গলাব্যথা বা কফ যাওয়া শুরু হলে অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার হতে পারে।
- সকালে ঘুম থেকে উঠে তুলসী পাতা চিবিয়ে খেতে পারেন। তুলসী পাতা খুব দ্রুত খুশখুশে কাশি নিরাময় করে।
- অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টে ভরা এলাচ জীবাণুনাশক। গলাব্যথা এবং খুসখুসে কাশি হলে এলাচ মুখে রাখতে পারেন।
- শুকনা কাশিতে গলা খুসখুস করলে হালকা গরম জলে একটু লবণ দিয়ে কুলকুচি করা যায়। মুখে লবঙ্গ বা আদার টুকরো রাখলেও আরাম মিলে।
- কেউ কেউ কাশির সিরাপ খেয়েও আরাম বোধ করেন। শুকনো কাশির সিরাপ সেবন শুষ্ক কাশির সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য উপসর্গগুলি উপশম করার ক্ষেত্রেও একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।
- শুষ্ক কাশির অন্যান্য প্রতিকার যা কাশি কম করতে সহায়ক হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে পেপারমিন্ট চা, ইউক্যালিপটাস তেলের ব্যবহার ইত্যাদি।
- তেল হালকা গরম করে গলায় ও বুকে লাগাতে পারেন। চাইলে তেল গরম করার সময় তাতে মেথি দানা ও কালোজিরা স্বল্প পরিমাণে দিয়ে দিতে পারেন।
শীতের খুসখুসে কাশি কমানোর উপায়, Ways to reduce dry cough in winter :
শীতের সময় শুকনো কাশি কমাতে উপরিউক্ত উপায়গুলো অবলম্বন করতে পারেন। এসব ছাড়া মূলত যা করা প্রয়োজন, তা কোন ঔষধ সেবন নয়; বরং ধুলাবালু, ঠান্ডা কুয়াশা থেকে দূরে থাকলেই কাশি অনেকটা কমে যাবে।
নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া শীতের দিনে বাইরে না যাওয়ায় ভালো। ঘরের ভেতর সর্বদাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করুন। কোথাও ধুলো ময়লা জমতে দেবেন না। বাইরে যেতে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন।
চিকিৎসকের পরামর্শ কখন নেবেন ? When to consult a doctor?
শুষ্ক কাশির ক্ষেত্রে অনেকে সময় শ্বাস নিতে কিছুটা সমস্যা হয়; তবে কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, রক্ত বের হলে, কাশতে কাশতে শরীর নীল হয়ে গেলে, কাশির পাশাপাশি প্রচণ্ড জ্বর এলে, ইত্যাদি সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পাশাপাশি যেকোনো কাশি দুই বা তিন সপ্তাহের বেশি থাকলে অবশ্যই বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হবেন।
শেষ কথা, Conclusion :
ঋতু পরিবর্তনের সময়ই ইনফ্লুয়েঞ্জা ও প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ে। যার খপ্পরে পড়ে জ্বর, সর্দি, কাশির মতো সমস্যায় ভুগতে থাকেন অনেকেই। সমস্যা তো তখনই বেশি মনে হয় যখন শুকনো কাশি কমে না।
হাতের কাছে মজুত থাকা কয়েকটি ঘরোয়া টোটকাতেই কিন্তু শুকনো কাশিকে অনায়াসে বশে আনা সম্ভব। আপনাদের কারো শুকনো কাশির সমস্যা হলে উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন উপায়গুলো অবলম্বন করে দেখতে পারেন।
Frequently Asked Questions
আপনার নাক এবং গলার অ্যালার্জিক কাশির কারণে শুষ্ক কাশি হতে পারে।
যদি আপনার হাঁপানি (অ্যাস্থমা) বা টিবির মতো শ্বাসযন্ত্রের রোগ থাকে তবে এটাও আপনার শুষ্ক কাশির কারণ হতে পারে।
আপনার যদি কোনও ঠান্ডা, জ্বর বা কোন ধরণের ভাইরাল সংক্রমণ থাকে, তবে এটি আপনার শুষ্ক কাশির জন্য একটি বড় কারণ হতে পারে।
খুসখুসে কাশি কমানোর একটি দ্রুত এবং কার্যকর প্রতিকার হল গরম পানীয় পান করা, কারণ এটি আপনার উপসর্গগুলি অবিলম্বে উপশম করতে পারে । উষ্ণ জল, পরিষ্কার ঝোল, ভেষজ চা শুষ্ক কাশি, গলা জ্বালা, এবং ঠান্ডা লাগা তাৎক্ষণিকভাবে কমাতে পারে
খুসখুসে কাশি বা গলা ব্যথা হলে, চার থেকে পাঁচটা তুলসী পাতা জলে ধুয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিতে হবে। প্রতিদিন অন্তত দুবার, এক গ্লাস গরম জলে এক চা চামচ নুন দিয়ে গার্গল করতে পারেন।